• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
জাকাত দারিদ্র্য মোচনের উপায়

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

জাকাত দারিদ্র্য মোচনের উপায়

  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০২১

বর্তমান পৃথিবীতে কয়েকটি অর্থব্যবস্থা কার্যকর। তার মধ্যে অন্যতম হলো পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা, মিশ্র অর্থব্যবস্থা এবং ইসলামী অর্থব্যবস্থা।  উল্লেখিত চারটির মধ্যে প্রথম তিনটি অর্থব্যবস্থা মূলত আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাথে গড়ে ওঠে। কিন্তু ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এখন থেকে প্রায় পনেরোশ বছর আগে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, জাকাত দাও, রাসুলের আনুগত্য করো, আশা করা যায় তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করা হবে।’ (আল কোরআন, ২৪:৫৬)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের ধন-সম্পদ প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (আল কোরআন, ৫১:১৯)

ইসলাম একটি ধর্ম হয়েই কেবল আসেনি বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে এসেছে। মানব জীবনের এমন কোনো দিক ও বিভাগ নেই যা নিয়ে ইসলামে আলোচনা নেই। হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব ভিত্তির ওপর তার মদিনা রাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থা দাঁড় করান, তার মূলে ছিল জাকাত ব্যবস্থা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এসব সদকা বা জাকাত হচ্ছে ফকির-মিসকিনের জন্য। এর ব্যবস্থাপনার ওপর নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য। যাদের অন্তঃকরণ দ্বীনের প্রতি অনুরাগী করা প্রয়োজন তাদের জন্য। এটা কোনো ব্যক্তিকে গোলামি বন্ধন থেকে আজাদ করার জন্য। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঋণ মুক্তির জন্য। আল্লাহর পথে সংগ্রামী ও মুসাফিরদের জন্যে অর্থ ব্যয় করা যাবে। এটা আল্লাহতায়ালার নির্ধারিত ফরজ; নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং তিনি হচ্ছেন বিজ্ঞ কুশলী।’ (আল কোরআন, ৯:৬০)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনার ধনীদের কাছ থেকে জাকাত আদায় করে গরিবের মাঝে বণ্টন করেন। এভাবে নবীজির আমলে মদিনায় ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমে আসতে থাকে। ইতিহাস সাক্ষী খোলাফায়ে রাশেদার দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর আমলে জাকাত খাওয়ার মতো মানুষের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। এর কারণ হলো তখন রাষ্ট্রে জাকাত ব্যবস্থা পুরোপুরি কার্যকর ছিল।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০০ সালে বাংলাদেশের হতদারিদ্র্যের হার ছিল ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২০ এর আলোকে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ দুটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় বিশেষ করে এমডিজি এবং এসডিজি দারিদ্র্য এবং চরম দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য। কিন্তু এক্ষেত্রে রিমার্কেবল পরিবর্তন ঘটেনি। এর কারণ হলো, আজকের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় জাকাত ব্যবস্থা প্রচলিত নয় বরং এখানে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা প্রচলিত। যদিও মুসলিম সমাজে মুসলমানরা ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করেন জাকাত আদায় করার জন্য। ‘এরা শুধু আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হই মিসকিন এতিম ও কয়েদিদের খাবার দেয় এবং এরা বলে আমরা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তোমাদের খাবার দিচ্ছি, আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোনো বিনিময় বা প্রতিদান চাই না, কোনো রকম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন চাই না।’ (আল কোরআন, ৭৬:৮-৯)

ব্যক্তিগতভাবে জাকাত প্রত্যেকে আদায় করলেও এর প্রভাব তেমন সমাজে পরিলক্ষিত হয় না। বরং জাকাত আদায়ে চরম বিশৃঙ্খলার জন্য প্রতিবছর অনেক মানুষ হতাহত হওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। মূলত ইসলামী বিধানমতে জাকাত আদায় ও বন্টন নীতি কার্যকর হলে, যেমনিভাবে জাকাত ব্যবস্থায় একটি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে; তেমনি এটার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হবে।

সরকার চাইলে ধর্ম মন্ত্রণালয় বা ইসলামী ফাউন্ডেশনের অধীনে একটি জাকাত ফাউন্ডেশন গঠন করতে পারে। প্রতি বছর যে পরিমাণ জাকাত আদায় হবে; তা যদি চরম দারিদ্র্য শ্রেণীর মানুষের মাঝে সুষম বন্টন করা হয়, তাহলে জরিপে দেখা গেছে যে মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে চরম দারিদ্র্যসীমা শূন্যে নেমে আসবে। কেন দরকার এই উদ্যোগ? আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি যদি এই মুসলমানদের জমিনে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা দান করি তাহলে তারা নামায প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত আদায় করবে, এবং নাগরিকদের সৎ কাজের আদেশ, মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। তবে সব কাজেরই চূড়ান্ত পরিণতি একান্ত ভাবে আল্লাহ তায়ালার এখতিয়ার ভুক্ত।’ (আল কোরআন, ২২:৪১) বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে যদি জাকাত ব্যবস্থাটাও কাজে লাগানো যায় তাহলে এটা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হবে বলে অনেকেই (ইসলামী চিন্তাবিদগণ) বিশ্বাস করেন। কারণ অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের বেশিরভাগ লোকজন ব্যক্তিগতভাবে জাকাত প্রদান করে থাকেন। ফলে এই সেক্টরে অল্প পরিশ্রমে অধিক পরিমাণ জাকাত আদায়ের সুযোগ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘যা-কিছু তোমরা সুদের ওপর দাও, তা অন্য মানুষের মালের সাথে বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে তা বাড়ে না। অপরদিকে যাকাত তোমরা দান করো তা আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে দান করো, তাই বরং বৃদ্ধি পায়, জেনে রেখো এরাই হচ্ছে সেসব লোক যারা জাকাতের মাধ্যমে আল্লাহর দরবারে নিজেদের বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।’ (আল কোরআন, ৩০:৩৯)

এছাড়াও সমাজে প্রতিষ্ঠিত কিছু ইসলামিক স্কলার আছেন যারা এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। যাদের প্রতি সমাজের মানুষের আস্থা রয়েছে তারাও নিজ উদ্যোগে একটি যাকাত ফাউন্ডেশন তৈরি করতে পারেন এবং এর সুষম বন্টনের মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারেন। এরকম হলে দাতা ও গ্রহীতা দুজন বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচবে। কে কাকে যাকাত দিল এবং কে কার কাছ থেকে নিল কেউ জানলো না। ফলে দাতা অহংকার মুক্ত হবে আর গ্রহীতা সংকীর্ণতা থেকে বাঁচবে। ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা যা কিছু দান করো তা যদি প্রকাশ্যভাবে করো ভালো কথা, তবে যদি তোমরা গোপন রাখো এবং অসহায়দের দিয়ে দাও তাতে তোমাদের জন্য উত্তম। তিনি তোমাদের বহু গুনাহর খাতা মুছে দেবেন। (আল কোরআন, ২:৭১)

লেখক : আবু সালেহ

প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, এস আলম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads