• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের ভূমিকা

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের ভূমিকা

  • প্রকাশিত ২২ মে ২০২১

মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা

মানবাধিকার শব্দটি মানব এবং অধিকার এই দুটি শব্দের সমন্বিত রূপ। মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সর্বজনীন, সহজাত, অহস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার। মানবাধিকার একজন ব্যক্তির মর্যাদা ও আত্মসম্মানের সাথে জড়িত একটি বিষয়, যা মানুষ্য সমাজের নৈতিক মানদণ্ডকে প্রকাশ করে। এটি কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নয় বরং গোটা বিশ্ব সমাজের মান মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। কাজেই মানবাধিকার সমুন্নত রাখার দায়িত্ব ব্যক্তির তো বটেই, বিশ্ব সমাজের ও। বিশ্ব ভূখণ্ডে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমানে টউঐজ, ওঈঈচজ, উজউ-সহ প্রমুখ বিশ্ব সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিটা রাষ্ট্র এর সংরক্ষণের জন্য নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করে যাচ্ছে। কিন্তু তথাপিও আজ বিশ্ব ভূখণ্ডে মানবতা ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। বর্তমান বিশ্ব সভ্যতার মোড়ল দাবিদার আমেরিকা নিজেদেরকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিরল দাবি করলেও দেখা যায়, সেখানে ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠিত নয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্রের সংবিধানে মানবাধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোথাও মানবাধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে কালজয়ী চিরন্তন আদর্শ হিসেবে একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ই সকল যুগে মানবাধিকার সুনিশ্চিত করেছে। অসীম জ্ঞানময় নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান ইসলামই মানবাধিকার নিশ্চয়তার গ্যারান্টি। আজকের বিশ্বে মানবাধিকারের যথার্থ বাস্তবায়নের জন্য ইসলামের বিকল্প নেই। ইসলামে জীবন দর্শন যেমনি পরিপূর্ণ, ইসলামে মানবাধিকার ধারণাও তেমনি ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ। ইসলাম মানবাধিকার সংরক্ষণে যে বিধান আরোপ করেছে তার সংক্ষিপ্ত চিত্র পরিবেশন করছি।

১. জীবনের নিরাপত্তার অধিকার : মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলাম মানুষের বেঁচে থাকার তথা জীবনের নিরাপত্তার অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। ইসলাম আদালতে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ প্রমাণিত হওয়া ও আদালত কর্তৃক শাস্তি ঘোষণা ব্যতীত কোনো মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করাকে সমস্ত মানবকুলের হত্যার সমতুল্য অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করল অথবা জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করল, সে যেন সমস্ত মানবমণ্ডলীকে হত্যা করল।’

২. অমুসলিমের ধর্ম পালনের অধিকার : ইসলামী রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের লোক স্বাধীন ও নিরাপদ বসবাস করার এবং নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়েছে। ইসলাম প্রত্যেক ধর্মের উপাস্যদের নিন্দাবাদ ও গালমন্দ করাকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহকে ব্যতীত অন্যকে ডাকে তোমরা তাদেরকে গালি দিও না। (আল-কোরআন)।

৩. নারীর মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকার : প্রকৃতপক্ষে ইসলামই নারীর মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণ করেছে। মায়ের পদ তলে সন্তানের জান্নাত ঘোষণা দিয়ে নারীর মর্যাদাকে সমুন্নত করেছে। হাদিসে উল্লেখিত যে, জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নালোকে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম তিনবার মায়ের সেবা করার কথা বলেছেন, অতঃপর চতুর্থ বারে পিতার সেবা করার কথা বলেছেন। আল কোরআনে নারী-পুরুষ একে অপরের পোশাক বলে মন্তব্য করেছেন। ইসলাম প্রতিটা কন্যা সন্তানকে এক একটা জান্নাত বলে অভিহিত করেছে। ইসলাম নারীকে যে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে তা বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে বিরল।

৪. ন্যায্য বিচার প্রাপ্তির অধিকার : ইসলাম ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের সুবিচার প্রাপ্তি এবং আইনের দৃষ্টিতে সমতার বিধান আরোপ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদের সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করো, এটা তাকওয়ার নিকটবর্তী।’ (আল-কোরআন)। হাদিসে উল্লেখ আছে যে, পানি সেচ দেওয়া নিয়ে এক মুসলিম ও বিধর্মীর সাথে ঝগড়ার সৃষ্টি হলে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ঐ বিধর্মীর পক্ষে বিচারের রায় দেন। ফলে মুসলিম ব্যক্তিটি নাখোশ হয়ে হজরত ওমর (রা.)-এর নিকট আপিল করলে হজরত ওমর অপরাধী মুসলিম ব্যক্তির গর্দান বিচ্ছিন্ন করে দেন। এই বিচার ব্যবস্থা দ্বিতীয়টি আজো দেখা যায়নি।

৫. শ্রমিকের অধিকার : ইসলাম শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সোচ্চার। শ্রমিক যেন তার প্রাপ্য অধিকার যথাযথ পায় এ ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কড়া নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ মালিক ও শ্রমিকের মাঝে কোনোরূপ বৈরতা সৃষ্টি হতে দেয়নি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে বলেন, শ্রমিকেরা তোমাদের ভাই, তোমরা যা খাবে তাদেরও তাই খেতে দিবে, তোমরা যা পরবে তাদেরও তাই পরতে দেবে।

৬. মতামত প্রকাশের অধিকার : নির্বিঘ্নে সত্য ও স্বাধীন মত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার ইসলামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সত্য গোপন করে মিথ্যা প্রকাশের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে সত্য ও স্বাধীন মতামত প্রকাশ করাকে সর্বোত্তম জিহাদ বলে ঘোষণা দিয়েছে। কোনো ব্যক্তি সত্য ও স্বাধীন মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে বিরুদ্ধবাদীদের হাতে নিহত হওয়াকে শহীদ বলে ঘোষিত হয়েছে।

৭. দুস্থ-অসহায়ের অধিকার : দুস্থ-অসহায় মানুষের জীবন মান সংরক্ষণের জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা ধনীদের সম্পদে গরিবের হক প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কোনো ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার ওপর জাকাত ফরজ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যম ইসলাম সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মানবতার কল্যাণকামী জীবন ব্যবস্থা ইসলাম। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানব জাতির কল্যাণ সাধন এ জীবন ব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য। ইসলাম মানবতার সকল অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সর্বদা সরব। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেক হকদারের প্রাপ্য হক আদায় করে দাও।’ প্রাচীন ও আধুনিক কোনো ইতিহাসই এমন রাষ্ট্র ব্যবস্থা দেখেনি, যা ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসীদের মাঝে ভারসাম্য স্থাপন করেছে। ইসলাম ব্যতীত অন্য সকল ধর্মীয় ব্যবস্থাই ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার আদায়ে অপারগতা প্রকাশ করেছে। ইসলাম পিতামাতা, ছেলেমেয়ে, নারী-পুরুষকে পৃথক পৃথকভাবে উল্লেখ করে তাদের প্রত্যেকের প্রাপ্য অধিকার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অনুরূপ ভাবে ইসলাম শ্রেণিগতভাবে মুসলমান ও অমুসলিমের উল্লেখ করে সকল শ্রেণি ও ধর্মের অধিকার দিয়েছে। সবিশেষ উল্লেখ্য, একমাত্র ইসলামই মানবাধিকারের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেছেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads