• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
ইসলাম, সমাজ ও জ্ঞানচর্চায় নারী সাহাবাদের অবদান

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ইসলাম, সমাজ ও জ্ঞানচর্চায় নারী সাহাবাদের অবদান

  • প্রকাশিত ২৩ মে ২০২১

মো. মুরাদ হোসেন

মহান আল্লাহর শাশ্বত বাণী ইসলাম প্রচার, ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং জ্ঞানচর্চায় উন্নতি ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে পুরুষদের পাশাপাশি মুসলিম নারীরাও যুগ যুগ ধরে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ ও জ্ঞানচর্চায় নিরলস সাধনার পাশাপাশি পারিবারিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকার স্বাক্ষর রাখছেন মহান রবের অপরূপ সৃষ্টি নারীগণ। নারীরা হলো মানবজাতির ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত যারা আমাদের পারিবারিক জীবনকে শান্তিময় ও সমৃদ্ধশালী করতে সদা সচেষ্ট থাকেন। মানবসভ্যতার ইতিহাসে নারীদের অসামান্য অবদানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো নববী যুগের (রাসুলের সময়কার) নারীগণ। যারা শত বাধা, বহু ত্যাগ স্বীকার করে ইসলাম ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং জ্ঞানচর্চায় অতুলনীয় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। যার ফলে ইসলাম অতিদ্রুত পারিবারিক ও প্রান্তিক পর্যায়ে বিস্তৃত হতে সক্ষম হয়েছে। মানবসভ্যতায় নারীর অবদান নিয়ে আলোকপাত হলে আমাদের মনে হয় ১৮শ শতকের পর থেকে হয়তো নারীরা সামাজিক ও জ্ঞানচর্চায় অবদান রাখার পাশাপাশি তা গ্রহণের অধিকার পেয়েছে। কিন্তু আমরা যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার শুরু সেই সময়ের দিকে থাকাই তাহলে দেখতে পাবো অসংখ্য নারী সামাজিক, রাজনৈতিক ও জ্ঞানচর্চার অধিকার পাওয়ার পাশাপাশি তাতে অসামান্য অবদানের স্বাক্ষর রেখে গিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে তার স্ত্রীদের সাথে পরামর্শ করে নিতেন। এমনি রাসুল জীবনে যতগুলো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন সবগুলো যুদ্ধে তার প্রিয় স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন এবং তাদের কাছ থেকে যুদ্ধের রণকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করে অবগত হতেন।

পৃথীবিতে ইসলাম ও সমাজ প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদান রেখে যাওয়া মানুষদের মধ্যে হজরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইদিল (রা.) প্রথম নারী। যিনি নবুয়াতের পূর্বে থেকেই তাঁর নিজের বিপুল সম্পদরাজি শুধুমাত্র অসহায় মানুষের কাজেই ব্যয় করেননি বরং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সার্বিক কল্যাণ এবং মহান রবের শাশ্বত জীবনবিধান ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজেও ব্যয় করেছেন। এই মহীয়সী নারী ইসলাম ও সমাজের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সদা সচেষ্ট ছিলেন। মানবতার নবী নিজের প্রিয় স্বামীকে ইসলামের প্রারম্ভিক প্রতিকূলতার সেই সময়ে কুরাইশদের নানানমুখী নির্যাতন থেকে আগলে রেখে ইসলাম প্রচারে সাহস ও শক্তি জুগিয়েছেন। রাসুলের প্রচারিত সত্য আদর্শের প্রতি সর্বপ্রথম ঈমান আনয়ন করেন এবং কাফেরদের বিভিন্ন উপায়ের নির্যাতনকে সহ্য করে দয়াময় রবের ওপর পূর্ণ আস্থা ও ধৈর্যের সঙ্গে শত প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে গোপনে নারী সমাজের কাছে ইসলামের সত্য আদর্শ প্রচার করতেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বহুসংখ্যক কুরাইশ রমনী ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসতে শুরু করেন। ধনবান মহিলা হওয়া সত্ত্বেও নিজ হাতে স্বামী রাসুলুল্লাহর সেবা করা, সব প্রতিকূলতাকে ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে মোকাবিলা করার পাশাপাশি সমাজের মানুষের কল্যাণে এতটাই নিবেদিত ছিলেন যে, তার সম্পর্কে  কোরআনের আয়াত পর্যন্ত নাজিল হয়। ইসলামের প্রতি গভীর ভালোবাসাবোধ এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

প্রাচীন আরবে যে কজন মানুষ লিখতে পড়তে জানতেন তাদের একজন ছিলেন হজরত ফাতেমা বিনতে খাত্তাব (রা.)। ইতিহাসে যতদিন উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ও জান্নাতে সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবীদের কথা আলোচনায় আসবে ততদিন তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আলোচিত হবেই। ফাতেমা বিনতে খাত্তাব (রা.) ছিলেন একজন পূর্ণ বিশুদ্ধ অন্তরের নারী যিনি তার জ্ঞানকে সঠিক পথে পরিচর্যা করে জাহেলি যুগের সব অপসংস্কৃতি ও পাপাচার থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছেন এবং সমাজের নারীদেরকেও বিরত রাখতে সদা সচেষ্ট ছিলেন। ইসলাম গ্রহণকারীদের সংখ্যা ১০জনে থাকা অবস্থায় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তিনিই সেই নারী যার দৃঢ় সাহসিকতা ও গভীর ঈমানি শক্তির ফলে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর মতো মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন।  তাঁর জীবনের গল্প আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় অবহেলিত নারীদের কীভাবে ব্যক্তিত্বপূর্ণ ও দৃঢ় মনোবলে বলীয়ান হওয়া যায় তার চিত্র। ইসলামের উষ্ণলগ্নে যেখানে একজন ব্যক্তির ইসলাম গ্রহণই ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার, সেখানে তিনি ইসলামকে পারিবারিক জীবনে চর্চা করতেন। তিনি এবং তাঁর স্বামী একত্রে পবিত্র কোরআন শিখতেন। তাদের হূদয়স্পর্শী তিলাওয়াত পথিকদের কোরআনের প্রতি আকৃষ্ট করত। বিশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থায় কঠিন পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে মহান রবের আনুগত্যের মাধ্যমে কীভাবে শান্তিপূর্ণ বসবাস নিশ্চিত করা যায় তার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত মুসলিম উম্মাহকে দেখিয়ে গিয়েছেন।

ইসলাম ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিক প্রতিকূল সময়ে যারা কঠিন নির্যাতন সহ্য করে আল্লাহর ওপর অবিচল ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথম সারির নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন হজরত ফাতেমা (রা.)। রাসুলে আকরাম (সা.)-এর এই কন্যা হলেন সমগ্র নারীকুলের জন্য আদর্শ ও মুসলিম নারীদের অনুসরণের বাস্তব দৃষ্টান্তের প্রতিনিধি। তিনি এই ধরণীর বুকে স্বল্পকাল বেঁচে ছিলেন কিন্তু শৈশবকাল থেকেই তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও ব্যতিক্রমধর্মী আদর্শিক কাজের জন্য নারী সমাজের কাছে মডেল হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন। তাঁর অগাত জ্ঞান, আমল, তাকওয়াহ, পরহেজগারিতা, সাহসিকতা, লজ্জাশীলতা, পবিত্রতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে আদর্শ ছিলেন তো বটেই বরং মা, কন্যা, স্ত্রী, সমাজের সদস্য এবং নাগরিক হিসেবেও নারীকুলের জন্য তিনি আদর্শ ও অনুসরণীয়। আল্লাহতায়ালা রাসুলের মাধ্যমে তাকে যেই মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন তার মাধ্যমে জাহেলি যুগের অবহেলিত নারীরা মর্যাদা ও অধিকারের দিক থেকে পুরুষের সমপর্যায়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। তিনি সবাইকে দেখিয়েছেন কীভাবে মহান রবের আনুগত্য ও তার বিধিবিধান পালনের মাধ্যমে যে কোনো স্তরের যে  কোনো নারী তাকওয়াবান পুরুষের ন্যায় সমমর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে। অর্থাৎ ফাতেমা (রা.) ছিলেন নারী জাতিকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিতকরণের এক বিপ্লবী পথপ্রদর্শক। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করার সাথে গরিব-দুঃখীকে দান খয়রাত করাও ছিল তাঁর বড় বৈশিষ্ট্য। রাসুলের চাচা আবু তালেব ও স্ত্রী খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পর কঠিন সেই সময় কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। তখন প্রিয় রাসুলের যত্ন ও প্রতিরক্ষায় তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এজন্য নবীজি তাকে উম্মে আবীহা তথা পিতার মা উপাধিতে ডাকতেন। সংসার থেকে যুদ্ধের ময়দান সর্বত্রই তার ভূমিকা ছিল অনন্য। উহুদের ময়দানে রাসুলের রক্তমাখা শরীরের সার্বিক সেবা ও চিকিৎসা তিনিই করেছেন। মুসলিম উম্মাহর জন্য তার এই ত্যাগ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

দীন ইসলামের জন্য আত্মত্যাগের স্বমহিমায় উজ্জীবিত হয়ে যারা নিজেদের প্রাণকে রবের দরবারে সঁপে দিয়েছেন তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম শাহাদাত বরণকারী ব্যক্তি হলেন হজরত সুমাইয়া বিনতে খায়্যাত (রা.)। ইসলামের জন্য তার কর্মপ্রচেষ্টা ও জীবন উৎসর্গতা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে মানুষ হওয়ায় প্রতিনিয়ত কুরাইশ নেতাদের লোমহর্ষক নির্যাতনের শিকার হতেন। কিন্তু শত নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও ইসলামের সত্য আদর্শ থেকে একচুল পারিমাণও সরে যাননি। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াহ গ্রন্থে বর্ণিত আছে, তাকে মরুভূমিতে সূর্যের তাপে উত্তপ্ত হওয়া বালুতে শুইয়ে রেখে বর্বর নির্যাতন চালানো হতো। ইসলামের জন্য তার এই ত্যাগ দেখে রাসুল বলতেন, হে সুমাইয়ার পরিবার, তোমরা ধৈর্যধারণ কর। কারণ জান্নাত হলো তোমাদের প্রতিশ্রুতির স্থান। শত নির্যাতনের পরেও ইসলাম থেকে তার মুখ ফিরাতে না পারায় আবু জাহেল অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে তার লজ্জা স্থানে বর্শা নিক্ষেপ করে হত্যা করেন। সমাজে নারীর সম্মান ও ইসলামের ওপর দৃঢ়তার উৎকৃষ্টতার বীজ এই বীর বিক্রমী নারীর হাত ধরেই বপন হয়েছে। ইসলামের প্রতি তার এই আত্মত্যাগ আমাদেরকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সত্য আদর্শের ওপর অবিচলতার শিক্ষা দেয়। এই মহীয়সী নারীর খোদাভীরুতা, আত্মত্যাগ, পাণ্ডিত্য ও সাহসিকতা সবার জন্য চিরস্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

ইসলামের জ্ঞানবিজ্ঞানের আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হলো উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.)। কোরআন-হাদিসের জ্ঞান ও ইসলামী শরিয়তের মাসলা-মাসায়েলর ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নারীদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। প্রাচীন আরবের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও আরবি কাব্য সম্পর্কে তার ছিল অগাধ জ্ঞান ও গবেষণা। যার প্রমাণ মিলে রাসুল মৃত্যু পর মুসলিম জাহানের খলিফাগণ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও শরিয়তের জটিল মাসয়ালা তার কাছ থেকে গ্রহণ করার মাধ্যমে। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে ইসলাম ও সামাজিক বিধিবিধান সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে অবগত হতেন। রাসুলের সাথে সুদীর্ঘ নয় বছর সংসার করার ফলে রাসুল থেকে সরাসরি বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করেন। ইবনে যুবায়ের (রা.) বলেন, আমি হালাল-হারামের জ্ঞান, কবিত্ব, চিকিৎসাবিদ্যায় উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) অপেক্ষায় অধিক পারদর্শী ও সুচিন্তাশীল আর কাউকে দেখেনি। তার স্বভাব-চরিত্র, শিক্ষাদিক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান সাধনায় তিনি যে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তা একদিকে যেমন নারীকুলের মহামর্যাদা ও গৌরবের কথা তেমনি জ্ঞান সাধনার প্রেরণাও বটে। এই মহীয়সী নারীর জীবনের দিকে দৃষ্টিক্ষেপণ করলে দেখা যায় অনেক বড় বড় সাহাবাদের তুলনায় তাঁর ছিল ইসলাম, সমাজ ও রাষ্টের ওপর গভীর বিচক্ষণশীল জ্ঞান। যে কোনো বিষয়ে পর্যালোচনার রীতিনীতিতে পর্যাপ্ত উদ্ভাবনীশক্তি ও প্রয়োজনীয় মতামত প্রকাশের সক্ষমতা ছিল তাঁর। জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য ভূমিকা মুসলিম নারীদের অনুপ্রাণিত করেছে।

 

লেখক : কার্যকরী সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads