• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
মসজিদুল আকসার ইতিহাস

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

মসজিদুল আকসার ইতিহাস

  • প্রকাশিত ২৫ মে ২০২১

মাইন উদ্দীন হাসান

মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদে নব্বীর পর ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান মসজিদুল আকসা। এটি ফিলিস্তিনের জেরুজালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত। মসজিদুল আকসা অর্থ ‘দূরবর্তী মসজিদ’। মসজিদুল আকসার অপর নাম বায়তুল মুকাদ্দাস। যেটি মুসলমানদের প্রথম কেবলা নামে পরিচিত। মসজিদটিতে ২টি বড় এবং ১০টি ছোট গম্বুজ রয়েছে। যার মধ্য দিয়ে মসজিদটিতে প্রকাশ পেয়েছে নির্মাণশৈলীর এক মনোমুগ্ধকর প্রতিচ্ছবি। ঐতিহাসিক এ মসজিদটির আয়তন সাড়ে তিন হাজার বর্গমিটার। এ মসজিদে পাঁচ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। মসজিদুল আকসা মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি তিন ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে পবিত্র স্থান। যার কারণে এই মসজিদকে ঘিরে চলছে নানা দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এই পবিত্র স্থানের অধিকার মুসলিম ও ইহুদি উভয়ই চায়। কিন্তু এর প্রকৃত অধিকার মুসলিমদের। ইহুদি হলো ফিলিস্তিনে উড়ে এসে জুড়ে বসা জাতি। তাদের মসজিদুল আকসায় হস্তক্ষেপের কোনো অধিকার নেই! এর জের ধরে ইসরাইলের ইহুদি গোষ্ঠীগুলো বছরের পর বছর ধরে মুসলিমদের ওপর চালাচ্ছে নগ্ন হামলা। এতে শহীদ হয়েছে শিশু থেকে শুরু করে অসংখ্য মুসলিম নর-নারী।

পবিত্র ভূমি জেরুজালেমে অবস্থিত মসজিদুল আকসার পেছনে লুকিয়ে আছে অনেক অজানা ইতিহাস। ইতিহাসবিদ পণ্ডিত ইবনে তাইমিয়ার মতে, সুলায়মান (আ.) এর তৈরি সম্পূর্ণ উপাসনার স্থানটির নামই হলো মসজিদুল আকসা। সুলাইমান (আ.) জ্বীনদেন মাধ্যমে এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। যা পরবর্তীতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন।

দ্বিতীয় খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে বায়তুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের অধিকারে আসে। খলিফা উমর বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্িমত ও সমপ্রসারিত হয়। মুসলমানদের দখলে আসার পর মুসলিম শাসকদের হাতে  কয়েকবার এ মসজিদ সংস্কার হয়। ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনঃনির্মাণ করেন। ১০৩৩ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার যখন মসজিদটি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন ফাতেমীয় খলিফা আলী আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন যা বর্তমান অবধি টিকে রয়েছে।

১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা আক্রমণ করে মসজিদুল আকসা তাদের দখলে নিয়ে নেয়। এইভাবে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ক্রুসেডাররা মসজিদুল আকসা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গির্জায় পরিণত করে। তারা মসজিদের গম্বুজের উপরে ক্রুশ স্থাপন করে এর নাম রাখে- ‘সুলাইমানি উপাসনালয়’।

২০ সেপ্টেম্বর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে রক্তক্ষয়ী সমরাভিযানের মাধ্যমে মিশরের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান সালাউদ্দীন আইয়ুবি মসজিদুল আকসাসহ পুরো ঐতিহাসিক জেরুজালেম নগরী মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। ২ অক্টোবর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি ও গভর্নর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীবেশে মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবি কর্তৃক মসজিদুল আকসা ক্রুসেডার মুক্ত হওয়ার পর জেরুজালেমে দীর্ঘ প্রায় এক শতাব্দীব্যাপী মুসলমানরা খ্রিস্টানদের অত্যাচার থেকে মুক্ত ছিল। আইয়ুবী, মামলুক, উসমানীয়, সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল ও জর্ডানের তত্ত্বাবধানে মসজিদুল আকসার নানাবিধ সংস্কার করা হয়।

দীর্ঘকাল ধরে মুসলমানরা খ্রিস্টানদের সঙ্গে লড়াই করে এ মসজিদের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। সবশেষে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে শুরু হয় ইহুদি আগ্রাসন। যার ফলে আজ মসজিদুল আকসা মুসলমানদের হাতছাড়া এবং ইহুদিদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ও অবরুদ্ধ। বর্তমানে ইহুদিবাদী ইসরাইল ঐতিহাসিক মসজিদটি দখল করে রেখেছে। তাদের দাবি, এর নিচেই রয়েছে তাদের দুটি প্রাচীন মন্দির। ইহুদিদের কাছে এই স্থানটি টেম্পল মাউন্ট হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠালাভের পর মসজিদুল আকসা মুসলমানদের হস্তচ্যুত হয়ে যায়। এরপর থেকে মুসলিমদের ওপর ইহুদিদের জুলুম-নির্যাতন ক্রমশ বাড়তে থাকে। ১৯৬৭ সালে আরবদের সাথে যুদ্ধের পর মসজিদটি দখল করে নেয় ইসরাইল। আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আকসা মসজিদ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল ইসরাইল। এরপর থেকে মসজিদটিতে ইবাদতের জন্য, ইহুদি দখলদার বাহিনীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই তাকিয়ে থাকতে হয় ফিলিস্তিনের সাধারণ মুসল্লিদের। সেই থেকে মসজিদুল আকসা তাদের দখলে রয়েছে। ১৯৬৯ সালে তারা পবিত্র মসজিদটিতে একবার অগ্নিসংযোগও করেছিল।

বর্তমান সময়ে জেরুজালেমে মসজিদুল আকসায় ইহুদি ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্ব মুসলিমের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ফিলিস্তিনের সাধারণ মুসলিমের ওপর এতো নিপীড়ন অন্য কোনো ধর্মীয়গোষ্ঠী চালায়নি। পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদিরা ইসরাইলি বসতি স্থাপনের জন্য এবং মসজিদুল আকসায় তাদের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বাড়িঘর থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ ও হত্যা করে চলছে। যা ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো দেখেও চুপ করে আছে। পরিশেষে সমগ্র মুসলিম জাতির একটাই প্রত্যাশা, যেভাবে রাসুল (সা.) মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে মুসলমানদের অধিকার আদায় করে নিয়েছিল,  একদিন জেরুজালেমের মসজিদুল আকাসাও সেই ভাবে ইহুদি আগ্রাসনমুক্ত হবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে মুসলমানদের অধিকার। ইনশাআল্লাহ।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

mayenmh004@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads