• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
যাযাবর ইহুদি জাতি

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

যাযাবর ইহুদি জাতি

  • প্রকাশিত ২৬ মে ২০২১

আবু সালেহ

যাযাবর ইহুদি জাতির নাম নিয়ে রয়েছে একাধিক বর্ণনা। সভ্যতার ইতিহাসে এরা হিব্রু সভ্যতা হিসেবে পরিচিত। জাতি হিসেবে ইহুদি বা ইসরাইলি। হিব্রু শব্দটি মূলত খাবিরু (khabiru) বা হাবিরু (habiru) থেকে এসেছে। যার অর্থ নিম্ন বংশীয় যাযাবর বা বিদেশি। অন্যমতে হিব্রু শব্দটি ইবার (eber) বা ইভার (ever) থেকে এসেছে। এগুলোর অর্থ মোটামুটি বিদেশি যাযাবর এর কাছাকাছি। (বিশ্বসভ্যতা, ড. এ কে এম শাহনেওয়াজ, পৃষ্ঠা-১৫৪)

ইতিহাসের নিরিখে একটু বিচার করলেই বুঝা যাবে কেন ইহুদি বা ইসরাইলিদেরকে যাযাবর জাতি বলা হয়। ইহুদি বা ইসরাইলিদের পূর্বপুরুষ হলেন পয়গম্বর ইব্রাহিম (আ.)। যাকে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা আব্রাহাম নামে চিহ্নিত করে। স্যার লিওনার্ড উলী তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আব্রাহাম’-এ যে বর্ণনা দেন, তাতে জানা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ২১০০ শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে ইবরাহিম (আ.) তৎকালীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার অন্তর্গত উর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। যেটা বর্তমানে ইরাকের অন্তর্গত। ইবরাহিম আলাইহিস সালামের জন্মের পূর্বে উর উরনাম্মু নামে একজন শাসক তার পারিবারিক শাসন শুরু করেন যা পরবর্তীতে নাম্মু নামে পরিচিতি লাভ করে। কোরআনে এই শাসকদেরকে নমরুদ নামে অভিহিত করেছে। এরা সূর্যদেবতা শামস বা শাম্মাস-এর পূজা করত। ফলে পয়গম্বর ইব্রাহিম (আ.)-এর সাথে তাদের বিরোধ তৈরি হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি কি সে ব্যক্তির অবস্থা দেখনি যে ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা রাষ্ট্রক্ষমতা দেওয়ার পর সে ইব্রাহিমের সাথে নিজের মালিকের ব্যাপারে বিতর্কে লিপ্ত হল?’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত-২৫৮) এ বিরোধের ফলে তারা ইব্রাহিম (আ.) কে বন্দি করেন এবং ১১ দিন পর তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেন!

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আগুন তুমি ইব্রাহিমের জন্য প্রশান্তিময় হয়ে যাও।’ (আল কোরআন)

আল্লাহ সেখান থেকে ইব্রাহিম (আ) কে রক্ষা করলে তিনি মেসোপটেমিয়া অঞ্চল থেকে হিজরত করে সিরিয়া ফিলিস্তিন অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। ফিলিস্তিন অঞ্চলে আসার পর মহান আল্লাহ ইব্রাহিমকে (আ) ইসহাক ও ইয়াকুব (আ) এর সুসংবাদ দান করেন। এখানেই বিবি সাহারার ঘরে জন্ম নেন ইসহাক (আ) এবং তার ঔরসে ইয়াকুব (আ)। দুজনকেই আল্লাহতায়ালা পয়গম্বর হিসেবে বেছে নেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর আমি তাকে দান করেছি ইসহাক ও ইয়াকুব; এদের সবাইকেই আমি সঠিক পথের দিশা দিয়েছিলাম। আগে আমি নূহকেও হেদায়েতের পথ দেখিয়েছি।’ (সুরা আল আনআম, আয়াত-৮৪)

পয়গম্বর ইয়াকুব (আ) এর আরেক নাম হলো ইসরাইল। ফলে হিব্রুরা নিজেদেরকে এরপর থেকে বংশগত ইসরাইলি বলে দাবি করত। যা আজ একটি রাষ্ট্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। ইয়াকুব (আ) এর ১২ জন সন্তান ছিল যাদের একজন ছিলেন ইউসুফ (আ.)। তিনিও একজন নবী ছিলেন এবং পরবর্তীতে মিশরে বন্দিদশা থেকে প্রথমে মন্ত্রী এবং পরে বাদশা হন। ইয়াকুব (আ) এর বড় ছেলের নাম ছিল ‘ইয়াহুদা’। ইয়াহুদা সিরিয়া ফিলিস্তিন অঞ্চলে বসবাস করতে থাকে। এই ইয়াহুদা এর বংশধর পরবর্তীতে ইহুদি জাতি হিসেবে নিজেদেরকে পরিচিত করে। (তাফসির ইবনে কাসীর সুরা বাকারা ৬২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা)

সমসাময়িক কালে এশিয়া মাইনর বা পূর্ব দক্ষিণ ইউরোপ থেকে আগমন ‍হিট্টাইট জাতির। ফলে ইহুদি ও হিট্টাইট জাতি মিলে একটি সংকর জাতিতে পরিণত হয়। একারণে ইসরাইলিদের অনেক ঐতিহাসিক বিশুদ্ধ সেমেটিক ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলতে নারাজ। (বিশ্বসভ্যতা, ড. এ কে এম শাহনেওয়াজ, পৃষ্ঠা-১৫৪)

সিরিয়া ফিলিস্তিন অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীদের বলা হতো ফিলিস্তিনি। যারা পূর্ব থেকেই এখানে বসবাস করে আসছে। অর্থাৎ আজকের যে ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল এর স্থানীয় অধিবাসীরা ছিল মূলত ফিলিস্তিনি। হিট্টাইট ও ইহুদী জাতি মিলে যে সংকর জাতি তৈরি হয়, তারা মূলত এখানেও স্থায়ী হতে পারেনি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীতে অনাবৃষ্টি ও ফসলহানির ফলে এই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে এই সংকর জাতি সিনাই অতিক্রম করে নীলনদ পেরিয়ে মিশরে প্রবেশ করে। তারা মিশরীয় শাসক ফারাওদের দাসে পরিণত হয়। আল্লাহতায়ালা তাদের দাসত্ব মুক্তির জন্য পয়গম্বর মুসা (আ.) কে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মিশরে প্রেরণ করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সে কথাও স্মরণ করো, যখন আমি মুসাকে কিতাব ও ন্যায়-অন্যায়ের পরোখকারী একটি মানদণ্ড দান করেছি, যাতে করে তোমরা হেদায়েতের পথে চলতে পারো।’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত-৫৩) ‘আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছি, তারপর একে একে আমি আরো অনেক নবী পাঠিয়েছি।’  (সুরা আল বাকারা, আয়াত-৮৭)

খ্রিস্টপূর্ব ১২৫০ এর দিকে মুসা (আ) বনী-ইসরাইলকে ফারাওদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য  নীলনদ পেরিয়ে চলে আসেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো যখন আমি তোমাদের ফেরাউনের লোকদের থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম, তারা নিকৃষ্ট ধরনের শাস্তি দ্বারা তোমাদের যন্ত্রণা দিত, তারা তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করত এবং তোমাদের মেয়েদের জীবিত রেখে দিত, তোমাদের মালিকের পক্ষ থেকে এতে তোমাদের জন্য বড় একটা পরীক্ষা ছিল। আরো স্মরণ করো যখন আমি তোমাদের জন্য সমুদ্রকে দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছিলাম, অতঃপর আমি তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমি ফেরাউন ও তার দলবলকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, আর তা তো তোমরা প্রত্যক্ষ করছিলে।’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত : ৪৯-৫০)

নীলনদ পেরিয়ে মুসা (আ.) বনী-ইসরাইলকে নিয়ে সিনাই উপত্যকায় প্রবেশ করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো, আমি যখন তোমাদের বলেছিলাম তোমরা এই জনপদে ঢুকে পড়ো এবং তোমরা তাঁর যেখান থেকে ইচ্ছা স্বাচ্ছন্দ্যে আহার করো, মাথানত করে ঢুকো।’ (সুরা আল বাকারা-৫৮) সিনাই উপত্যকায় তারা দীর্ঘদিন বসবাসের পরে আস্তে আস্তে ফিলিস্তিনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন ইসরাইলিদের রাজা ছিলেন সাউল। সাউল ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০২৫ এর দিকে। পরে তিনি আত্মহত্যা করেন। এরপর ইসরাইলিদের নেতা হন দাউদ (আ.)। আল্লাহ তার ওপর রিসালাত দান করেন এবং তার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের উপর বিজয় দান করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতঃপর তারা আল্লাহর সাহায্য নিয়ে তাদের পর্যদুস্ত করে দিল এবং দাউদ জালুতকে হত্যা করল, আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়ার রাজত্ব দান করলেন এবং তাকে কৌশলও শিক্ষা দিলেন এবং তিনি তাকে নিজ ইচ্ছা মতো আরো বিষয়ের জ্ঞান দান করেন।’ (সুরা আল বাকারা-২৫১)

আল্লাহতায়ালা দাউদ (আ)-এর মাধ্যমে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে ফিলিস্তিনিদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। দাউদ (আ.)-এর পরে তার ছেলে সুলাইমান (আ.) ইসরাইলিদের নেতৃত্ব দান করেন ৯৫০ খ্রিস্টপূর্ব সময়ে। তিনিও নবী হিসেবে আল্লাহতায়ালা কর্তৃক মনোনীত হন।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দাউদ ও সুলাইমানের ঘটনা তাদের শোনাও। যখন তারা একটি ক্ষেতের ফসলের রায় প্রদান করেছিল... অতঃপর আমি তা সোলাইমানকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, আমি তাদের উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম।’ (সুরা আল আম্বিয়া, আয়াত-৭৮, ৭৯)

সুলাইমান (আ.) রাজত্বের পরে ইসরাইলিরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় এবং দুটি রাজ্যে পরিণত হয় পুরো ফিলিস্তিনি অঞ্চল। এর একটি ‘ইসরাইল’ উত্তরাঞ্চল ঘিরে এবং অন্যটি ‘জুডা’ দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ অব্দের দিকে এসেরীয় রাজা ‘সেনাচেরি’ ইসরাইল দখল করে নেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৬ অব্দের  দিকে ক্যালেডিও রাজা নেবুচাঁদনেজার ‘জুডা’ দখল করে নেন। এখানে তিনি ইসরাইলিদের ওপরে একটি গণহত্যা পরিচালনা করেন এবং জেরুজালেম ধ্বংস করে দেন। এরপর খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে ফিলিস্তিন রোমানদের অধীনে চলে যায় এবং সেখানে খ্রিস্টধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হয়।

পরবর্তীতে ১০৯৬ সালের দিকে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের ধর্মীয় যুদ্ধ ক্রুসেডের পর ফিলিস্তিন মুসলমানদের অধিকারে চলে আসে এবং তা অব্যাহত থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় পর্যন্ত। মূলত পয়গম্বর ইব্রাহিম (আ.) এরপর থেকে আধুনিক ইসরাইল প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত ইসরাইলি বা ইহুদি সমপ্রদায় একটি যাযাবর জাতি হিসেবেই পৃথিবীতে বসবাস করে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি বলেন, আগামী ৪০ বছর পর্যন্ত সে জনপদ তাদের জন্য নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলো। এসময় তারা উদ্ভ্রান্ত হয়ে পৃথিবীতে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াবে; সুতরাং তুমি এই নাফরমান লোকদের ওপর কখনো দুঃখ করো না।’ (সুরা আল মায়েদা, আয়াত-২৬) উনিশ শতকের শেষের দিকে হাঙ্গেরীয় ইহুদি থিওডোর হার্জেল-এর জায়োনিস্ট আন্দোলন মূলত ইহুদিদের পুনরায় একত্র করার একটি প্রয়াস। ‘ইহুদি রাজ্য’ নামে তিনি একটি বই লিখেন, যাতে তিনি ইহুদিদের পিতৃভূমি (তার দাবিকৃত) ফিলিস্তিনে ফিরে যাওয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করেন। এ আন্দোলনের জন্য তিনি ইহুদিবাদী কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৯৭ সালে। আমৃত্যু তিনি এর সভাপতি ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রপক্ষ ইউরোপের ইহুদিদের ফিলিস্তিনে সরিয়ে আনার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৯১৭ সালে আর্থার বেলফোর একটি ঘোষণা দেন যা ইতিহাসে ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে পরিচিত। ১৯৩০-এর দশক থেকে ইউরোপীয় ইহুদিরা ফিলিস্তিনে আসা শুরু করে। আস্তে আস্তে তারা ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করতে থাকে এবং সেখানে বসতি নির্মাণ করে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে, যাযাবর ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। বৃহৎ শক্তিগুলোর সহায়তায় তারা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে তাদের স্থায়ী একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। এভাবেই যাযাবর ইহুদি ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।

লেখক : প্রভাষক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, এস আলম কলেজিয়েট স্কুল এন্ড কলেজ

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads