• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে ইসলাম

  • প্রকাশিত ০১ জুন ২০২১

মুফতি নাঈম কাসেমী

 

 

আল্লাহরাব্বুল আলামীন সুন্দর এবং সব বিষয় সুন্দর হওয়াকে পছন্দ করেন। আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং ইসলাম ধর্মের অধীনে থাকতে বলেছেন। কোরআন শরীফে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহর মনোনীত ধর্ম হলো ইসলাম’। ইসলাম শন্তির ধর্ম। শান্তি প্রতিষ্ঠার ধর্ম। জুলুম, নির্যাতন, অন্যায় অত্যাচার, অরাজকতা, দুর্নীতি ইত্যাদি ইসলাম কখনই সমর্থন করে না। এই অশান্ত পৃথিবীকে শান্ত করার জন্যই ইসলামের আবির্ভাব। একটা সমাজকে সুন্দর করতে ইসলাম ধর্মের কোনো বিকল্প নেই। আমরা সবাই একটা জিনিস জানি এবং বুঝি যে, মানুষ সামাজিক জীব। তাই মানুষ একাকী থাকতে পারে না। সমাজবদ্ধ হয়ে থাকতে হয় মানুষকে। আদম (আ.)-কে প্রথম মানব হিসেবে সৃষ্টি করার পর হাওয়া (আ.)কেও সৃষ্টি করা হয়। যাতে আদম (আ.)কে নিঃসঙ্গ হয়ে থাকতে না হয়।

সমাজ বা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকা মানুষের একটি সহজাত চাহিদা। তাই চাইলেও কেউ একাকী থাকতে পারে না। পারস্পরিক সহযোগিতা ও ভালোবাসা থাকলে মানুষের জীবন সত্যিকারভাবেই সুন্দর হয়। মানুষের মাঝে নানা গোষ্ঠী ও সমাজ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের অনেক জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মানিত, যে তোমাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান, আল্লাহতায়ালা সর্বজ্ঞাত ও সর্ববিষয়ে অবগত।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত-  ১৩) অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তার নিদর্শনের একটি হলো, তিনি তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যেন তাদের কাছে তোমরা প্রশান্তি অনুভব করো। তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া ঢেলে দিয়েছেন, এতে চিন্তাশীল জাতির জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা রুম, আয়াত-২১)

সমাজ জীবনের প্রেক্ষাপটেই ইসলামের বিধি-বিধান আল্লাহতায়ালা অবতীর্ণ করেছেন। তাই কোরআন-হাদিসের দিকনির্দেশনা ও ইসলামের শিষ্টাচারগুলো সমাজের মানুষের মাঝে প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন। ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিধান সমাজ জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই ইসলামের সঙ্গে মানবসমাজের এক নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। ইসলামপূর্ব সময়ে মক্কায় চরম বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় বিরাজ করছিল। ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সৌহার্দ্য-ভালোবাসা, পারস্পরিক সহযোগিতাসহ শিষ্টাচার হারিয়ে যায়। কিন্তু ইসলাম এসে সমাজকে নতুনভাবে সাজাতে থাকে। ইসলামের সুশীতল ছায়ায় এসে মানুষ পরিণত হয় সোনার মানুষে। তাই সমাজচ্যুত কেউ ইসলামের মৌলিক আদর্শ লালন করতে পারে না। সবাইকে নিয়ে বসবাস করা এবং সংঘবদ্ধ হয়ে সুষ্ঠু-সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করাই ইসলামের মূল চাহিদা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জু শক্তভাবে আঁকড়ে ধরো, বিচ্ছিন্ন হয়ো না, তোমাদের ওপর আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করো যখন তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন, অতঃপর তিনি তোমাদের অন্তর এক করেছেন এবং তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১০১)

সামাজিক জীবনে প্রতিবেশীর ভূমিকা অনেক বেশি। তাই ইসলামে প্রতিবেশীর অনেক কর্তব্য ও অধিকার আছে। সাধারণত যে কোনো প্রতিবেশী প্রয়োজনের মুহূর্তে আগে আসে। তাই আল্লাহতায়ালা তাদের প্রতি সুন্দর ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, কাউকে তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, মুসাফির ও দাস-দাসীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা দাম্ভিক ও অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৩৬) প্রতিবেশীর সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা এবং সব ধরনের কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অন্যতম দায়িত্ব। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসুলের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন তার প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।’ (মুসলিম) প্রতিবেশীকে বিভিন্ন সময় খাদ্য প্রদান করাও কর্তব্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মুমিন এমন হবে না যে সে তৃপ্তিসহ আহার গ্রহণ করবে আর তার প্রতিবেশী অনাহারে থাকবে।’ (বায়হাকি)

প্রতিবেশীর এত বেশি অধিকার যে জিবরাঈল (আ.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বারবার এ বিষয়ে সতর্ক করতে থাকেন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জিবরাঈল আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে এত বেশি নির্দেশনা দিয়েছেন, আমার মনে হচ্ছিল, তিনি তাদের আমার ওয়ারিস বানিয়ে দেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) প্রতিবেশী যেমনই হোক না কেন, সে যেই ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন, সে যেই পেশাদার ই হোক না কেন, তার সঙ্গে সদ্বব্যহার করার শিক্ষা দেয় ইসলাম। ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কল্যাণের পথের যাত্রী হলে মানবজীবনের অস্থিরতা দূর হবে। দুশ্চরিত্র, মন্দ স্বভাব, পাপাচারসহ সর্বপ্রকার অকল্যাণ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। তদুপরি সমাজের দুস্থ-অসহায় ও দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াতে হবে। পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে সৌহার্দ্যময় আচরণ করতে হবে। তবেই সার্থক, সুন্দর ও মানবতার বাসযোগ্য একটি সমাজ গড়ে উঠবে।

সবার সঙ্গে সুন্দর আচরণের শিক্ষা দেয় ইসলাম। একজন মুমিন অন্য মুমিনকে ভাই হিসেবে মনে করবে। এতে তাদের সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে। একে অপরের বিপদ-আপদে সহায্য করবে। নিজের জন্য যা ভালো মনে করে, অপরের জন্য তা ভালো মনে করবে। সব মুমিনকে পরস্পরের ভাই সম্বোধন করে আল্লাহতায়ালা বর্ণনা করেছেন, ‘নিশ্চয় মুমিনরা একে অপরের ভাই।’ (সুরা- হুজুরাত, আয়াত-১০) হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে ভাইয়ের জন্য তা পছন্দ না করে যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।’ (বুখারি ও মুসলিম) আরেক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুসলিম অন্য মুসলিমের ভাই। সে ভাইকে অত্যাচার করবে না। অপমান-অপদস্থ করবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বুকের দিকে ইশারা করে তিনবার বলেন, তাকওয়া এখানে। মুসলিম ভাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা অন্যায়। তাই অন্য মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানে আঘাত হানা হারাম।’ (মুসলিম)

সমাজের সব মুসলিম ভাই ভাই। সমাজের সবার মাঝে কোনো ধরনের পার্থক্য থাকবে না। সবাই নিজ যোগ্যতা বলে সম্মানের অধিকারী হবে। আর আল্লাহর কাছে শুধু তাকওয়া বা খোদাভীতির গুণেই সম্মানিত হবে। এক মুসলিমের সমস্যায় অন্য মুসলিম এগিয়ে আসবে। সবার প্রতি সবার ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যবোধ থাকবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মুমিনরা একে অপরের ভাই, তাই তোমরা তোমাদের ভাইদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করো এবং আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা হুজুরাত) আল্লাহতায়ালা সমাজের সবশ্রেণির প্রতি অনুগ্রহ ও সহায়তা প্রদানে উদ্বুদ্ধ করেছেন। সমাজের অসহায়, দুস্থ, দরিদ্র ও এতিমদের প্রতি সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ইসলামে এতিমদের প্রাপ্য প্রদানে অত্যধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা এতিমের সম্পদের কাছেও যাবে না, তবে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত ন্যায়সংগতভাবে তা ব্যয় করতে পারবে।’ (সুরা আনআম, আয়াত-৩৪)।

অন্যদিকে যারা এতিমের প্রতি দয়ার্দ্র হয় না। তাদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে অনেক ধমকি এসেছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আপনি কি এমন লোক দেখেছেন, যে দীন ইসলাম অস্বীকার করে? সে ওই লোক, যে এতিমকে তাড়িয়ে দেয়, অসহায়-দুস্থদের খাওয়াতে কাউকে উদ্বুদ্ধও করে না।’ (সূরা মাঊন, আয়াত : ১-৩) যারা প্রকৃত মুমিন তাদের অন্যতম গুণ হলো অসহায়দের প্রতি সহানুভূতি দেখানো। তাই আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘খাবারের প্রতি তাদের খুব প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অসহায়, এতিম ও কয়েদিদের আহার প্রদান করে।’ (সুরা দাহর, আয়াত-৮) যে কোনো নিপীড়িত মুমিনকে সাহায্য করা একজন মুসলিমের ঈমানি দায়িত্ব। তাই রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তুমি তোমার ভাইকে সাহায্য করো, চাই সে জালিম হোক বা মাজলুম হোক। এ কথা শুনে উপস্থিত সাহাবারা জালিমকে সাহায্য করার তাৎপর্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘জালিমকে জুলুম থেকে বিরত রাখাই তাকে সাহায্য করা।’

(বুখারি ও মুসলিম)

কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা ব্যবসা হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।’ তাই হালাল পন্থায় ব্যাবসা করতে হবে, হারামের ধারেকাছেও যাওয়া যাবেনা। যে সমাজে সুদ ঘুষ চালু থাকবে সে সমাজ থেকে আল্লাহর রহমত উঠে যায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন সুদের সাথে সম্পৃক্ত চার প্রকারের মানুষ জাহান্নামি হবে। (১) যে সুদ খায়। (২) যে সুদ দেয়। (৩) যে সাক্ষি থাকে। (৪) যে সুদের বিষয়ে লেখালেখির কাজ করে। এই চার প্রকার মানুষ সুদের কারণে জাহান্নামি হবে। অন্য এক হাদিসে হুজুরপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “ওই দেহ জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যে দেহ হারাম রিজিক দ্বারা লালিতপালিত হয়।’  (মেশকাত শরীফ)

এই জন্য আমাদের উচিত সুদ ঘুষ সহ, সব হারাম রিজিক উপার্জন করা থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহরাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে উপরের কয়েকটা বিষয়ের উপর আমল করে একটি সুন্দর সমাজ গঠনের তৌফিক দান করুন। আমীন।

 

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন, ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads