মুহাম্মাদ নুরুল ইসলাম
লোভ হিংসার মতো মারাত্মক ব্যাধি আমাদের সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। দিনমজুর থেকে নিয়ে সরকারি উর্ধতন কর্মকর্তারাও এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। যা তাদের ভিতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। ভেতরে থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। আপনি কিছু গর্ত দেখতে পাবেন যেগুলোর উপরে দেখলে মনে হবে মাটিভর্তি। মাঝে মাঝে কয়েকটি ছোট ছোট ফোঁটা। মূলত ভিতরে রিক্ত। ওই ছোট ছোট ফোঁটাগুলো দিয়ে প্রবেশ করে ভিতরে রিক্ত করে দিয়েছে। যা বাইরে থেকে বুঝা প্রায়ই অসম্ভব। লোভী হিংসুকরাও তেমন গর্তের তুল্যরূপ। লোভী হিংসুক ব্যক্তিদের মাঝেও এই ব্যাধি প্রবেশ করে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব ছারখার করে দেয়। বাইরের সাদাকালো চামড়া, হাসি-বেদনামাখা চেহারা দেখে বুঝে উঠা দুঃসাধ্য। এই ব্যাধি এমন যে, তা ছোঁয়া যায়না। দেখাও যায়না। অনুভবও করা দুষ্কর।
লোভী হিংসুকরা অন্যের উন্নতি দেখে, অন্যের দালানকোঠা দেখে, অন্যের বাড়িঘর দেখে সহ্য করতে পারেনা। হিংসার আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। আর এই হিংসা, এই লোভ একদিন মৃত্যু ডেকে আনে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি তাদেরকে জীবনের প্রতি সবার চেয়ে-এমনকি মুশরিকদের চেয়েও অধিক লোভী দেখবেন। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে, যেন হাজার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ুপ্রাপ্তি তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ দেখেন যা কিছু তারা করে।’ (সুরা বাকারাহ, আয়াত- ৯৬)
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে যেটি আমাদের প্রত্যেকেরই জ্ঞাত। ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। একটি ঘটনা। তৎকালীন আরবের বাদশার একজন গ্রাম্য ব্যক্তির সাদাসিধে আচরণ দেখে আলাদা একটি মোহাব্বত পয়দা হলো। আস্তে আস্তে বাদশার নিকটস্থ হতে শুরু করলো। কিন্তু একজন গ্রাম্য ব্যক্তির ওপর এতটা আস্থাভাজন একজন উজিরের পছন্দ হলো না। আস্তে আস্তে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে শুরু করলো। একসময় এই আগুন বিরাট আকারে রূপ ধারণ করে।
উজির এবার গ্রাম্য ব্যক্তিটির সাথে বন্ধুত্ব গড়তে লাগলো। নরম কথা দিয়ে, বন্ধুত্বসুলভ আচরণ দিয়ে গ্রাম্য ব্যক্তিটির মন জয় করে নিল। একদিন উজির লোকটিকে তার বাড়িতে দাওয়াত দিল। খানার মধ্যে পরিকল্পিতভাবে রসুনের মাত্রা বাড়িয়ে দিল, যাতে মুখ থেকে রসুনের গন্ধ বের হয়। গ্রাম্য ব্যক্তিটি নেমন্তন্ন পেট পুরে খেল। এখন মুখ থেকে রসুনের গন্ধ বের হতে শুরু করলো। তখন উজির বললো বাদশাহ তো রসুনের গন্ধ সহ্য করতে পারেনা। তুমি কিছুদিন বাদশার দরবারে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখ। কারণ, তোমার মুখ থেকে রসুনের গন্ধ বের হলে বাদশার কষ্ট হবে। গ্রাম্য ব্যক্তিটি ছিল সাদাসিধে। তার এই কারসাজি টের পেল না।
এদিকে উজির এসে বাদশাকে বলল, অমুক ব্যক্তি আপনার নামে লোকের কাছে কুৎসা রটাচ্ছে। লোকেদের বলছে, আপনার মুখ থেকে নাকি দুর্গন্ধ বের হয়। বাদশা শোনামাত্র তেলে ভেজে আগুন। হুকুম দিল, অমুক গ্রাম্য ব্যক্তিকে দরবারে হাজির করা হোক। বাদশার আদেশ পেয়ে নিরুপায় হয়ে বাদশার দরবারে হাজির হলো। লোকটি হাজির হওয়া মাত্রই হাত দিয়ে নাকমুখ চেপে ধরলো। মূলত গ্রাম্য ব্যক্তির মুখ থেকে রসুনের গন্ধ বের হলে রাজার কষ্ট হবে, তাই হাত দিয়ে নাকমুখ চেপে ধরেছে। বাদশা এই অবস্থা দেখে মনে মনে বললো, উজির তো ঠিকই বলেছে। যাকে আপন করে নিলাম সেই লাথি মারলো! এবার বাদশা একটি চিঠি লিখার হুকুম দিল। বললো, এই চিঠিতে লিখো, ‘এই চিঠি যেই নিয়ে যাবে তাঁকে কতল করতে বিলম্ব করবেনা’। এই লাইনটুকু লিখে গ্রাম্য ব্যক্তিকে বললো এই চিঠি অমুক গভর্নরের কাছে নিয়ে যাও।
গ্রাম্য ব্যক্তি এই চিঠি নিয়ে দরবার থেকে বের হতেই উজিরের সাথে দেখা। জিজ্ঞাসা করলো উজির, বাদশাহ কী বলেছে? প্রশ্নোত্তরে গ্রাম্য ব্যক্তি বললো, বাদশাহ এই চিঠি অমুক গভর্নরের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেছেন। পূর্বে একটি প্রথা ছিল, কোনো বাদশার কাসেদ কোনো গভর্নরের কাছে বার্তা নিয়ে গেলে তাকে যথেষ্ট সম্মান করা হয়। উপঢৌকন দেওয়া হয়। এবার উজিরের লোভ হলো। গ্রাম্য ব্যক্তিকে বলল ভাই, তুমি কেন এত কষ্ট করবে? বরং আমাকে দাও, আমি দিয়ে আসি। আমি তোমাকে দুই হাজার দিরহাম দিচ্ছি। গ্রাম্য ব্যক্তি বললো, ঠিক আছে। চিঠি উজিরকে দিয়ে দিল আর দুই হাজার দিরহামও নিয়ে নিল। উজির বললো, আমি না আসা পর্যন্ত বাদশার দরবারে আসা যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। চিঠি নিয়ে উজির গভর্নরের কাছে পৌঁছল। গভর্নর চিঠি পড়তেই জল্লাদকে হুকুম দিল কতল করতে। উজির কিছু বুঝে উঠার আগেই উজিরকে কতল করে ফেলল। উজিরকে লোভ-লালসায় মৃত্যু অবদি নিয়ে গেল।
আসুন! লোভ, হিংসাকে নিজে থেকে একদম ঝেড়ে ফেলি। যতটুকু আছে ততটুকুতেই সন্তুষ্ট হই। সুখী তো ওই ব্যক্তি, যার যতটুকু আছে ততটুকুতেই সন্তুষ্ট। নিজের গচ্ছিত সব সম্পদ মৃত্যুর পর সন্তানেরাই ভোগ করবে। যতটুকু আছে সন্তুষ্ট হই। তাহলে আর অন্তরে আফসোস থাকবে না। লোভী ও হিংসুক কখনো সুখী হতে পারে না। সবসময় চটপটের মধ্যে থাকে। লোভী আরো কীভাবে পাবে, এই নিয়ে সবসময় ছটফট করে। আর হিংসুক কীভাবে অন্যকে গর্তে ফেলবে, এই নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক