• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ

  • প্রকাশিত ০৮ জুন ২০২১

মো. তাসনিম হাসান আবির

 

 

সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ- ইরানের বিখ্যাত মনীষী শেখ সাদী (রহ.) যথার্থই বলেছিলেন। বর্তমান সময়ের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি। আপনার বন্ধু নির্বাচনের ওপর আপনার জীবনের অনেক বড় একটি অংশ নির্ভর করে। ভালো বন্ধু আপনার জীবনকে সুখে সাজিয়ে দিবে। খারাপ বন্ধু জীবনকে নরকে পরিণত করবে। অনেক সময় সেই খারাপ বন্ধুত্বের মূল্য নিজের জীবন দিয়ে পরিশোধ করতে হয়। বর্তমান সময়ের তরুণরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বন্ধুত্ব নির্বাচনে ভুল করে। কারণ তারা তথাকথিত আধুনিকতাকে বেশি মূল্য দেয়। তারা ভাবে বর্তমানে যারা তথাকথিত জনপ্রিয় এরাই বুঝি তাদের আইডল বা এদের সংস্পর্শে আসাটাই বুঝি জীবনের অনেক বড় পাওয়া। তারা মাদক গ্রহণকে তথাকথিত আধুনিকতার অংশ মনে করে। একজন তরুণ যে কিনা তার আবেগের স্টেজটা অতিক্রম করছে তখন সে সমাজের এই ধ্বংসের দিকটা গ্রহণ করে। তারা মাদকসেবী বড়ভাই বা বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করতে শুরু করে। প্রথমদিকে সেইসব বড়ভাই ও বন্ধুরা নিজের টাকায় তাকে মাদক দেয়। তখন সে অন্যরকম অনুভূতি পায়। যেটা সে আগে অনুভব করে নি। নতুন অনুভূতির নেশায় সে ডুবে যায়। আর ভাবে তার নিজের টাকা তো লাগতেছে না। বড়ভাই বা বন্ধুরা তাকে ফ্রিতে এসব দিচ্ছে। অথচ সে বুঝতেও পারে না যে, আস্তে আস্তে সে ধ্বংসের দিকে পা বাড়াচ্ছে। একসময় যখন সে পুরোদমে নেশায় আসক্ত হয়ে যায় তখন তার সেই মাদকসেবী বড়ভাই, বন্ধু তাকে মাদক দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে তরুণ না পারে নেশা ছাড়তে না পারে টাকার জোগাড় করতে। তখন সে পরিবারকে চাপ দেয় টাকার জন্য। বাবা-মাকে ভয় দেখায় নানান অজুহাতে। অনেকে খারাপ কাজে যুক্ত হয় নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য। এভাবে আস্তে আস্তে সে অপরাধ জগতের নিয়মিত সদস্য হয়ে যায়। এটাকেই তার আধুনিকতা বলে মনে হয়। সে ভাবে সবার সামনে ধূমপান করলে বা মদ,গাঁজার পার্টি করলেই বুঝি সবাই তাকে স্মার্ট ভাববে। তরুণ-তরুণীরা বেশিরভাগই আসলে খারাপ সঙ্গের সাথে মিশেই মাদকসেবী হয়ে যায়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েরাই এদিকে বেশি আসে। মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তথাকথিত স্মার্টনেসের পেছনে দৌড়ায়। বাসা থেকে পড়ালেখার নাম করে টাকা নিয়ে রাতদিন নেশার পার্টিতে মত্ত থাকে। বছরের পর বছর ফেল করতে থাকে একাডেমিক জীবনে। হতাশা তার জীবনকে গ্রাস করে ফেলে। একসময় সে মনে করে তার জীবনের আর কোনো অর্থ নেই। তখন সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এভাবেই একজন সম্ভাবনাময় তরুণ বা তরুণীর অকাল পরিসমাপ্তি হয়।

কিন্তু অপরদিকে সে যদি কোনো ভালো সঙ্গের সাথে মিশতো তাহলে তার জীবনটা অন্যরকম থাকতো। এমন অনেক উদাহরণও আছে যে, খারাপ ছেলে বা মেয়েটা ভালো সঙ্গের সাথে মিশে ভালো হয়ে গেছে। খারাপ জীবন থেকে ফিরে সে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সার্কেল করাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জীবনে কেউ একা থাকতে পারে না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজারটা গ্রুপ, অপশন আছে। এখন কোনটা নিজের জন্য ভালো এটাই বাছাই করা জরুরি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর এতটুকু সচেতনতা থাকাটা আবশ্যক। তাকে সামাজিক হতে হবে। মানবিক হতে হবে। দেশপ্রেমিক হতে হবে। পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে পরিবারেরও অনেক দায়িত্ব। তাদেরকে নিয়মিত তাদের সন্তানের খোঁজ নিতে হবে। নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। কোথায়, কার সাথে মিশছে এগুলো দেখতে হবে। অনেক বাবা-মা ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তান গেলেই তাদের দায়িত্ব শেষ। আর তেমন খোঁজ নেয় না, তেমন যোগাযোগও রাখে না। সন্তান যে আস্তে আস্তে অন্ধকার জগতের দিকে চলে যাচ্ছে এবিষয়েও কোনো খোঁজ নেয় না। কিন্তু পরিবার এমন একটি চক্র এখানে কোনো শেষ নেই। সবসময় এটা আবর্তিত হতে থাকে। একজনের প্রতি অন্যজনের দায়িত্ব, কর্তব্য কখনো শেষ হয় না। তাই সন্তানকে কখনো একা ছেড়ে  দেবেন না। শারীরিকভাবে একসাথে না থাকলেও মানসিকভাবে সবসময় তার সাথে থাকবেন।

বন্ধু নির্বাচন নিয়ে ইসলামে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। পবিত্র কোরআনে কারীমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। নামাজ প্রতিষ্ঠিত করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও রাসুলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। তাদের ওপর আল্লাহতায়ালা অনুগ্রহ করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী সুকৌশলী।’ (সুরা আত তওবা, আয়াত-৭১) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘একাকী নিঃসঙ্গতার চেয়ে ভালো বন্ধু উত্তম আর নিঃসঙ্গতা মন্দ বন্ধুর চেয়ে উত্তম।’ তার মানে হলো, ভালো এবং যথার্থ বন্ধু যদি নাও থাকে তাহলেও তা একজন মন্দ ও অযোগ্য বন্ধু থাকার চেয়ে ভালো।

বন্ধু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আগ-পর বিচার বিবেচনা করে নেওয়া উচিত। কারো প্রতি মন আকৃষ্ট হলেই তার সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে এমনটা ঠিক নয় বরং প্রথমে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে ভালো লাগা বা তার প্রতি আকর্ষণের কারণ কিংবা উৎসটা কী এবং সে আদৌ বন্ধু হবার যোগ্য কি না ইত্যাদি। হঠাৎ করে কারো সাথে পরিচিত হবার মধ্য দিয়ে অর্থাৎ কোনোরকম বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে অনেক সময় দুঃখজনক পরিণতি ঘটতে পারে। অনেক ইন্টারনেট বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুব সহজেই অনুমান করা যায়। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে অনেক বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে। এরমধ্যে অনেক ভালো বন্ধুত্ব হচ্ছে আবার অনেক খারাপ বন্ধুত্বও হচ্ছে। তবে খারাপ উদাহরণটা বেশি। এই মাধ্যমে পরিচয় হওয়া বেশিরভাগ সম্পর্কের পরিণতিই খুব খারাপ হয়। অনেক বেশি পরিবর্তনের জন্যই আপনার বন্ধু ভালো হবে বিষয়টা এমন না। আপনাকে দেখতে হবে সেই পরিবর্তনটা ভালোর জন্য নাকি খারাপের জন্য। ভালো হলে গ্রহণ করুন, খারাপ হলে দ্রুত বর্জন করুন।

বন্ধুত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি যে কথাটি চর্চা হয় সেটি হচ্ছে মাদকাসক্তির বিষয়টা। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন ভালো মানুষ ভুল বন্ধু নির্বাচন করে মাদকাসক্ত হয়ে যায়। সমাজে অহরহ এই ঘটনা ঘটছে। উচ্চ শিক্ষিত অনেক পরিবারের ছেলেমেয়েরা এরকম মাদকে যুক্ত হচ্ছে। তারা বন্ধুদের সাথে সারা দিন-রাত মাদকের পার্টি করছে। এবং মাদকাসক্ত হয়ে বন্ধুকে নিয়ে বাবা মাকে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। আবার মাদকাসক্ত হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা তো নিয়মিত ঘটছে। মাদকের এই চক্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হচ্ছে। এমনকি ক্যাম্পাসে তারা প্রকাশ্যে মাদক নিচ্ছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে এদের প্রতিরোধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

সামাজিকভাবে চলতে গেলে, সুন্দর করে বাঁচতে গেলে অবশ্যই বন্ধু থাকা আবশ্যক। কারণ একাকীত্ব মানুষের চিন্তাভাবনাকে সংকীর্ণ করে দেয়। মানুষ যত বেশি অন্যের সাথে মিশবে তত বেশি তার চিন্তা প্রসারিত হবে। তার ভাবনার জগত সমৃদ্ধ হবে। ভালো বন্ধু মানুষকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যায়, সৎ পথে বাঁচতে সাহায্য করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখায়, সমাজকে আলোকিত করতে শেখায়। আর খারাপ বন্ধু তাকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, বন্ধুত্ব কখনো মানুষকে হতাশার সাগরে নিয়ে যায় না, বন্ধুত্ব কখনো  নেশার কবলে বন্ধুকে ঠেলে দেয় না। যদি কেউ এমনটা করে তবে সে বন্ধু না। বন্ধুত্ব কখনো চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই করতে শেখায় না। বন্ধুত্বের ধর্ম মানবিকতার, সাহায্যের, ত্যাগের, সুখের, ভালোবাসার, শান্তির। একজন প্রকৃত বন্ধু শান্তি দেয়। সব ভালো কাজে উৎসাহ দেয়। অনেকের এমন অনেক বন্ধু আছেন যারা বাহ্যত খুবই আন্তরিক কিন্তু নিজেই বিভ্রান্ত। নিজে বিভ্রান্ত হওয়ার কারণে সে তার বন্ধুকেও বিভ্রান্ত করে ফেলে এবং পরিণতিতে উভয়ই অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। অপরদিকে ভালো বন্ধু হচ্ছে একজন মানুষের অমূল্য সম্পদ যা কোনো পার্থিব সম্পদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ভালো বন্ধু হচ্ছে এমন এক সঙ্গী যাকে সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে পাওয়া যায় এবং ভালো বন্ধু মন থেকে তার বন্ধুর জন্য কল্যাণ কামনা করে। ভালো বন্ধুর কারণে জীবনকে অনেক সহজ মনে হয় এবং সমস্যাগুলোকে অনেক তুচ্ছ মনে হয়। সবচেয়ে কঠিন সময়ের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠে ভালো বন্ধুরা। তাদের সহমর্মিতা ও সহযোগিতা দুঃখ ও শোক ভুলিয়ে দেয়। পৃথিবীকে আরো সুন্দর মনে হয়। ভালো ও প্রকৃত বন্ধু যে কোনো সমস্যা ও বিপদে এগিয়ে আসে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা থেকে শুরু করে অফিসের সমস্যা সমাধানেও তাকে কাছে পাওয়া যায়।

বন্ধু নির্বাচন সবসময়ের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক বেশি পরিমাণে ফালতু বন্ধু থাকার চেয়ে, কিছু ভালো বন্ধু অল্প পরিমাণে থাকাটাই শ্রেয়। আবেগের সাথে নিজের বুদ্ধি, বিবেচনা দিয়ে বন্ধুকে বিচার করুন। প্রকৃত বন্ধু বাবা, মা, পরিবারের থেকেও অনেক বেশি কাছের হয়। তাকে সব থেকে বেশি বিশ্বাস, ভরসা করা যায়। তার সাথে জীবনের সব মুহূর্ত ভাগ করা যায়। বন্ধুত্বে বিশ্বাস থাকাটা জরুরি, তাই সঠিক বন্ধু জীবনে আনাটাই দায়িত্ব। তাই তথাকথিত আধুনিক দুনিয়ার চাকচিক্য দেখে বন্ধুত্ব নির্বাচন না করে, জীবনের সুখ-দুঃখের সময়ের সঠিক বন্ধুটি নির্বাচন করুন। তাহলে জীবন হবে অনেক বেশি সহজ, সরল ও সুখের। আর খারাপ বন্ধু নির্বাচন করলে পরিণতিতে তার মূল্য জীবন দিয়ে পরিশোধ করতে হতে পারে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

শিক্ষার্থী, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads