• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

বিবাহ : একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা

  • প্রকাশিত ১১ জুন ২০২১

মো. নাজমুচ্ছাকিব

 

 

নিজের মন ও শরীর পবিত্র রাখার জন্য বিবাহ একটি অন্যতম মাধ্যম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বিবাহ আমার সুন্নাত, যে আমার সুন্নাতকে অবজ্ঞা করবে সে আমার দলভুক্ত নয়।’ বিবাহের আরবী প্রতিশব্দ নিকাহ। নিকাহ শব্দের অর্থ দুটি জিনিস একত্রিত করা। কখনো কখনো বন্ধন বা চুক্তি অর্থে ব্যবহূত হয়। বিবাহের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে ‘আনোয়ারুল কিফায়া ফি শরহুল বেকায়া’ গ্রন্থকার বলেন, “নিকাহ হলো এমন একটি চুক্তি যাতে ‘বিবাহ দেওয়া বা বিবাহ করা’ ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে একত্রে থাকা বা পরস্পর অংশীদার হওয়া বুঝায়।”

পুরুষ তার কামভাব নারীর মধ্যে আর নারীর কামভাব পুরুষের মধ্যে নিবারণের জন্য মহান আল্লাহতায়ালা দুজনের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অর্থাৎ, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মাঝে পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম, আয়াত-২১) আয়াতে উল্লেখ্য ‘পারস্পরিক প্রেম- ভালোবাসা ও দয়া’ কীভাবে করতে হবে? মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, অর্থাৎ ‘তারা (স্ত্রীগণ) তোমাদের পোশাক তোমারাও (স্বামীগণ) তাদের পোশাক।’ (সুরা বাকারা,  আয়াত-১৮৭) যার পোশাক যে যেভাবে ইচ্ছে ব্যবহার করতে পারো। আর এই পোশাক বা সঙ্গিনীর শরণাপন্ন হওয়া বৈধ উপায় হলো বিয়ে। কোরআনে মহান আল্লাহরাব্বুল আলামিন ভিন্নস্থানে ভিন্নভাবে বিয়ের আদেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে ‘তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত (পুরুষ হোক বা নারী) তাদের বিবাহ সম্পাদন করো এবং তোমাদের গোলাম ও বাঁদিদের মধ্যে যারা বিবাহের উপযুক্ত তাদেরও তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাব মুক্ত করে  দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ প্রাচুর্যময় জ্ঞানী।’ (সুরা নুর, আয়াত-৩২) বিবাহের দ্বারা মানুষের জৈবিক চাহিদা নিবারণ হয়। এই চাহিদা যদি শরিয়াত সম্মতপন্থায় নিবারণের সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে সমাজের অবৈধ ও অমানবিক পন্থা জেগে উঠবে। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা। গোলাম-বাঁদি যাইহোক উপযুক্ত হলেই বিবাহ।

রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে যদি কেউ প্রস্তাব দেয়, আর তাদের ধার্মিকতা ও চরিত্র তোমাদের পছন্দসহ হয়, তাহলে অতিদ্রুত বিবাহ সম্পাদন করে নাও, যদি এমন না করো (আরো অধিক পাবার আশা করো) তাহলে জেনে রাখো, এই পৃথিবীতে বিশাল ফেতনা সৃষ্টির কারণ হবে।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-১০৮৪) আমাদের সমাজের বিবাহের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দরিদ্রতা। আমাদের সমাজের মানুষ চায়, আগে পড়াশোনা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হোক, এরপর বিবাহ করবে। এই প্রতিষ্ঠিত হতে হতে কখনো কখনো বিবাহের বয়স পেরিয়ে যায়। এই বিষয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা নারীদেরকে বিবাহ করো, তারা তোমাদের সম্পদ উপার্জনের কাজ দিবে। (মাজমাউয যাওয়াদ) অন্য একটি হাদিসে রয়েছে-‘তিনটি বিষয় এমন; বান্দা যখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে শুরু করে দেয় আল্লাহ তাতে সহায়তা করেন। সেই তিনটির একটি হলো বিয়ে। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে বিয়ে করেন, তার ওপর আল্লাহর সাহায্যের ওয়াদা থাকে।’ (তাবরানী)

হজরত আনাস (র.) বর্ণনা করেন, ‘একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একদল সাহাবি নবীজির দরবারে এসে বলতে লাগলো; আমি কখনো বিয়ে করবো না (ইবাদতের জন্য বৈরাগ্যতা অবলম্বন করবো) আমি রাতে নামাজ পড়তে থাকবো কখনো ঘুমাবো না, আরেকজন বললো আমি সারাজীবন রোজা রাখবো কখনো রোজ ভঙ্গ করবো না। এই সবগুলো কথা শোনার পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতে লাগলো, আক্ষেপ তোমাদের ওপর! তোমাদের কী হলো? তোমার এই করবা না সেই করবা না, এই ছাড়বা না সেই ছাড়বা না শুরু করে দিলে। অথচ আমি নামাজও পড়ি আবার ঘুমাইও, আমি রোজাও রাখি আবার বিরতিও দিই। আমি বিবাহও করি! সুতরাং (জেনে রাখো বিয়ে আমার সুন্নাত) যে আমার সুন্নাত থেকে বিমুখ হয় সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত না।’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যার বিয়ের সামর্থ্য রয়েছে সে যেন বিয়ে করে নেয়, কেননা এটা চোখকে সংযত রাখে আর লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। আর তোমাদের মধ্যে যার বিয়ের সামর্থ্য নেই সে যেন রোজা রাখে, কেননা রোজাটাই তার জন্য নিরাপদ রাখার উপায়। (মুসলিম, হাদিস নং-৩৪৬৬) এই হাদিসে বিয়ের নির্দেশনার পাশাপাশি বিয়ের বড়ো দুটি উপকারের কথা বলা হয়েছে। প্রথম হলো চোখ সংযত থাকে। দ্বিতীয়টি হলো লজ্জাস্থান হেফাজত থাকে। আর এই দুটি অঙ্গই অবৈধ কাজের জন্য অগ্রগামী। সুতরাং এই দুটি যখন নিরাপদ থাকবে তখন আর কোনো অনৈতিক কাজ প্রকাশ পাবে। চরিত্র হবে সুন্দর ও উত্তম।

মহান আল্লাহতায়ালা নারী-পুরুষের মাঝে বিবাহের বিধান রেখেছেন বিশেষ হেকমত সামনে রেখে। মানব বংশবিস্তার করা ও ধ্বংসের হাত থেকে মানবজাতিকে হেফাজত করা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা কুমারী ও অধিক সন্তান জন্মদানে সক্ষম নারীদের বিয়ে করো। কেননা কেয়ামতের দিন আমি আমার উম্মতের সংখ্যার আধিক্য দিয়ে অন্যান্য উম্মতের ওপর গর্ব করব।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-২০৫০) বিবাহ চক্ষু শীতল করে। হাদিসে এসেছে; ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা (আর্থিক ও দৈহিকভাবে) বিবাহ করতে সক্ষম, সে যেন বিয়ে করে। কেননা এটি চক্ষু শীতল করে ও লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে। আর যে অক্ষম, তার জন্য রোজা রাখা জরুরি। এই রোজা তার জন্য জৈবিক চাহিদা প্রতিরোধক।’ (বুখারি, হাদিস নং-১৯০৫)

বিবাহ অন্তর পবিত্র করে, আল  কোরআনে এসেছে; ‘তারা তাদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে, তাদের পত্নী বা অধিকারভুক্ত দাসিদের ছাড়া। এতে তারা নিন্দনীয় হবে না।’ (সুরা মা’আরেজ, আয়াত-২৯, ৩০) অন্তরের শান্তি বাড়ে, কর্মব্যস্তময় দিবস কাটিয়ে ক্লান্তশ্রান্ত দেহে স্বস্তি আসে স্ত্রীর মাধ্যমে। জাগতিক জীবনের যাবতীয় দুঃখকষ্ট সব সহ্য করতে পারে প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একজন ব্যক্তি থেকে। তা থেকেই তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়।’ (সুরা আরাফ, আয়াত-১৮৯) হাদিসে বর্ণিত আছে, আম্মাজান আয়েশা (রা.) পেয়ালার যে জায়গায় মুখ রেখে দুধ পান করতেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঠিক একই জায়গায় মুখ রেখে দুধ পান করতেন, এমনকি একই হাড্ডির গোশত আয়েশা (রা.) খেয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দিলে নবীজি সেই একই জায়গা হতে খেতেন।’ (নাসাঈ, হাদিস নং-৭০)

নেককার নারী বিবাহ করলে জান্নাত লাভ সহজ হয়ে যায়। এব্যাপারে মুস্তাদরাকে হাকেমে বর্ণিত আছে, ‘আল্লাহতায়ালা যাকে নেককার স্ত্রী দান করেছেন, তিনি (আল্লাহ) তাকে ইসলামের পথে অর্ধেক অগ্রসর করে দিয়েছেন। এবার তার উচিত আল্লাহকে ভয় করা।’ নেক সন্তান জন্ম দিলে সদকায়ে জারিয়ার সওয়াব পাওয়া যাবে। মৃত্যুর পরও এর সুফল ভোগ করা যাবে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘মানুষ যখন মারা যায়, তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিন ব্যক্তির আমল চলমান থাকে। এক. সদকায়ে জারিয়ামূলক কাজকর্ম (যেমন মসজিদ, মাদরাসা করা, রাস্তাঘাট করা, মানবসেবায় কোনো কাজ করা)। দুই. তার রেখে যাওয়া জ্ঞান, যা থেকে মানুষ উপকৃত হয়। তিন. নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করতে থাকে।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-১৬৩১)

মানবজীবনে বিবাহ একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বিবাহকে ঈমানের অর্ধেক বলা হয়েছে। বিবাহ শুধু শারীরিক চাহিদা বা চরিত্র ভালো রাখে তাই নয়, বরং এর পাশাপাশি পুরুষের ব্যক্তিত্বেরও বিকাশ ঘটায়। সমাজে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে। যারা সময়মতো বিয়ে করে না তাদেরকে হাদিসে শয়তানের দলভুক্ত হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আক্কাফ (রা.) কে বললেন, হে আক্কাফ! তোমার স্ত্রী আছে? তিনি বললেন না। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার কি সম্পদ ও সচ্ছলতা আছে? তিনি বললেন আছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি এখন শয়তানের দলভুক্ত। তুমি যদি খ্রিস্টান হতে তবে তাদের রাহেব (ধর্মগুরু) হতে। নিঃসন্দেহে বিয়ে করা আমাদের ধর্মের রীতি। তোমরা কি শয়তানের সাথে সম্পর্ক রাখতে চাও? শয়তানের অস্ত্র হলো নারী।’

বেশিরভাগ যুবক ছাত্রাবস্থায় নারীসংক্রান্ত ফেৎনায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যারা বিয়ে করেছে তারা নারী ফেৎনা থেকে পবিত্র। সব প্রকার নোংড়ামি থেকে পবিত্র। তাই গুটিকয়েক আলেম ছাত্রাবস্থায় বিবাহের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু স্ত্রীর ভরণপোষণ দেওয়ার ক্ষমতা রাখা বিবাহের অন্যতম শর্ত। এদের নিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সক্ষম পুরুষ হওয়ার পরেও স্ত্রীকে ভরণপোষণ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় সে যেন বিবাহ না করে রোজা রাখে। কারণ রোজা দৈহিক উত্তেজনা কমিয়ে দেয়।’ (শরহে বেকায়া) ছাত্রাবস্থায় বিবাহের ক্ষেত্রে মুহাক্কিক আলেমদের মতামত হচ্ছে, মোটামুটি একটা ইনকাম সোর্স হওয়ার আগে বিবাহ করা অনুচিত। আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু রোজা থাকার কথা বলেছেন তাই আমাদের এই হাদিসের দিকে খেয়াল রাখা উচিত। বর্তমান সময়ে কিছু মানুষ ছাত্রাবস্থায় বিবাহের পক্ষে নানান যুক্তি নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে নানা রকমের পোস্ট দিতে দেখা যায়। সব কিছুর মাঝে আমাদের একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, আমরা যেন রাসুল (সা.)-এর কোনো হাদিসকে অবজ্ঞা না করে ফেলি। হাদিসে স্পষ্ট বর্ণিত আছে, ভরণ দেওয়ার ক্ষমতা না থাকে সে যেন রোজা রাখে। পরিশেষে একটা কথা বলবো, বিবাহের ক্ষেত্রে আমাদের আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে হাদিস ও বিবেককে কাজে লাগিয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads