• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলাম-মুসলমান বনাম সন্ত্রাসবাদ

  • প্রকাশিত ১২ জুন ২০২১

মুফতি উবায়দুল হক খান

 

 

আল্লাহতায়ালা তাঁর আইন অনুসরণের ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি দিয়েছেন। মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সমগ্র সৃষ্টির জন্য তাঁর আইন পালন বাধ্যতামূলক করেছেন। চিন্তাবিদগণ সাধারণ দৃষ্টিতে যা বুঝেন তা হলো, তিনি যদি অন্যান্য সব সৃষ্টির জন্য তাঁর আইন অনুসরণ বাধ্যতামূলক না করতেন, তাহলে মানুষসহ সমগ্র সৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হতো। যেমন মহাশূন্যে গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ ও অন্যান্য যা কিছুই রয়েছে, এসব কিছুর পরিভ্রমণের জন্য গতিপথ বা পরিভ্রমণের পথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এসব পথে ওগুলো চলতে বাধ্য। ওসব সৃষ্টিসমূহের পরিভ্রমণের পথে আল্লাহতায়ালা যদি স্বাধীনতা দিতেন, তাহলে পরিভ্রমণের পথে একটির সাথে আরেকটির সংঘর্ষ ছিল অবশ্যম্ভাবী এবং সেগুলো স্বয়ং যেমন ধ্বংস হতো তেমনি অন্যান্য সৃষ্টির জন্যও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতো।

 

অপরদিকে আল্লাহতায়ালা তাঁর আইন পালনের ক্ষেত্রে একমাত্র মানুষকেই স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং সতর্ক করে দিয়ে পবিত্র  কোরআনে এ কথাও উল্লেখ করেছেন ‘আলো-অন্ধকারের পথ বা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য করে দেওয়া হয়েছে।’ কেউ ইচ্ছে করলে আলোর পথ বা সত্যপথ অনুসরণ করে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির পথে এগিয়ে যেতে পারে, এ স্বাধীনতা যেমন মানুষের রয়েছে তেমনি সে অন্ধকার পথ অনুসরণ করে পৃথিবী ও আখিরাতে নিজেকে ধ্বংসও করে দিতে পারে, এ স্বাধীনতাও মানুষের রয়েছে। একই সাথে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে মানবজাতিকে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছেন ‘ইসলামই মানুষের জন্য একমাত্র মনোনীত জীবনব্যবস্থা।’ সমগ্র সৃষ্টিজগতের মালিক এ কথাও জানিয়ে দিয়েছেন, ইসলাম ব্যতীত অন্য কোনো আদর্শ কেউ যদি অনুসরণ করে, তাহলে সে নিশ্চিতভাবে পৃথিবী ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবি করবে, শান্তি, স্বস্তি ও সার্বিক নিরাপত্তার লক্ষ্যে তার জন্য আল্লাহর বিধান অনুসরণ করা অবশ্যই বাধ্যতামূলক।

 

আল্লাহর বিধান অনুসরণ না করে কেউ যদি নিজেকে মুসলিম হিসেবে দাবি করে, আল্লাহতায়ালার কাছে তার সে দাবির কানাকড়িরও মূল্য নেই। কারণ ‘মুসলিম ও ইসলাম’ এ শব্দ দুটো একটির সাথে আরেকটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত, পরস্পর সম্পূরক এবং অবিচ্ছিন্ন। এই শব্দ দুটোর মূলেই নিহিত রয়েছে মানুষের জন্য শান্তি, সমৃদ্ধি, উন্নতি, প্রগতি, স্বস্তি, নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদের বিভীষিকামুক্ত শঙ্কাহীন এক উন্নত জীবনযাপনের পরিবেশ।

 

মুসলিম শব্দের অর্থ ‘আত্মসমর্পণকারী’। আল্লাহতায়ালা মানবমণ্ডলীর শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা, উন্নতি, সমৃদ্ধি, প্রগতি ও শঙ্কামুক্ত নিরাপত্তাপূর্ণ যে বিধানাবলি দান করেছেন, এর সমষ্টির নামই হলো ইসলাম এবং এই বিধানাবলির নিকট যে মানুষ আত্মসমর্পণ করেছে বা নিঃশর্তে দ্বিধাহীনচিত্তে মেনে নিয়ে অনুসরণ করেছে, সে-ই হলো মুসলমান। সহজ কথায় সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদের বিপরীতে শান্তি, স্বস্তি, উন্নতি ও নিরাপত্তাদানের নিশ্চয়তামূলক বিধানের নিকট যে মানুষ তার সমগ্র সত্তাকে সমর্পণ করেছে, সেই হলো মুসলমান। এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তির হাত ও মুখের কথা থেকে অন্য মানুষ নিরাপদ নয়, সে ব্যক্তি মুসলমান নয়।’

 

যে আল্লাহতায়ালা মানুষের নিরাপত্তার প্রতীক ও শান্তির নিশ্চয়তামূলক জীবনবিধান ইসলামকেই মানুষের জন্য একমাত্র জীবনবিধান হিসেবে মনোনীত করেছেন, সেই আল্লাহতায়ালার নিরানব্বইটি নামের মধ্যে গুণবাচক নামসমূহের একটি নাম হলো ‘সালাম’ অর্থাৎ শান্তিদাতা। অপরদিকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে ‘সালাম’ নামের অধিকারী আল্লাহতায়ালা স্বয়ং পবিত্র কোরআনের সুরা আম্বিয়ায় ঘোষণা করেছেন, ‘হে নবী! আপনাকে আমি সমগ্র জগতের জন্য করুণার প্রতীক হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘করুণার প্রতীক তথা নবীয়ে রহমত’ উপাধি দান করেছেন। তাহলে বিষয়টি এভাবেই স্পষ্ট হয়ে গেলো, ‘শান্তিদাতা’ সালাম আল্লাহতায়ালা সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গীবাদের বিপরীতে ‘শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা, সুখ-সমৃদ্ধি, উন্নতি-প্রগতি ও শঙ্কামুক্ত জীবনবিধান শান্তির আদর্শ ইসলামকে’ করুণার মূর্তপ্রতীক নবীয়ে রহমতের কাছে প্রেরণ করেছেন এবং তিনি এ সর্বোত্তম আদর্শ পৃথিবীতে বাস্তবায়ন করেও দেখিয়েছেন।

 

আল্লাহতায়ালা নবী-রাসুলের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদেরকে নামাজ শেষ করার আদেশও দিয়েছেন শান্তি কামনা করার মাধ্যমে। অর্থাৎ, নামাজের শেষ বৈঠকে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ’ মুখে উচ্চারণ করেই নামাজ শেষ করতে হবে। নামাজ শেষ করেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে যে দোয়া করতেন সে দোয়ার অর্থ হলো ‘হে আল্লাহ! তুমি শান্তিময় আর তোমার নিকট থেকেই শান্তির আগমন, তুমি কল্যাণময়, হে মর্যাদাবান-কল্যাণময়! তোমার কাছেই আমি শান্তির শেষ আশ্রয়স্থল জান্নাত কামনা করছি।’ আল্লাহর রাসুলের শিখানো এ দোয়া অধিকাংশ আলেমগণ নামাজ শেষ করেই তিলাওয়াত করেন এবং মুসলমানদের মধ্যে যারা এ দোয়া মুখস্থ করেছেন তারাও করে থাকেন।

 

এরপর মুসলমানদের পরস্পরের দেখা-সাক্ষাৎ হলেও শান্তি কামনা করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, আসসালামু আলাইকুম, ‘তোমার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক’ প্রথমে বলে তারপর অন্যান্য কুশলাদি জানতে হবে। পৃথিবীতে মানব শিশু আগমন করার সাথে সাথে তাকে সালাম জানাতে হবে। শিশুর বাকশক্তি নেই, সে জবাব দিতে পারবে না। তবুও তাকে সালাম জানাতে হবে। অর্থাৎ, তার জন্য শান্তি কামনা করতে হবে। মানুষ ইন্তেকাল করলে জানাজা আদায় করার সকল দোয়াসমূহেও মৃতের জন্য শান্তি কামনা করতে হয় এবং জানাজা শেষও করতে হয় ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর’ বলে। অর্থাৎ, শান্তি কামনা করে। মুসলমানদের কবর দেখলেই বা জিয়ারত করার সময়ও প্রথমে কবরবাসীকে সালাম জানাতে হয় এবং কবর জিয়ারতের অন্যান্য সকল দোয়ার মধ্যেও শান্তি কামনা করা হয়।

 

মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্বয়ং কাবাস্থান-দোয়া কবুলের স্থানে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন-ইবরাহীম যখন বলেছিল, ‘হে মালিক! এ শহরকে তুমি শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানিয়ে দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১২৬) যে জাতির পিতা স্বয়ং সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন, সেই জাতি কি সন্ত্রাস আর জঙ্গীবাদে নিজেদেরকে জড়াতে পারে? ইসলাম মানুষকে আল্লাহতায়ালার কাছে সহজ-সরল শান্তির পথ কামনা করতে শিক্ষা দিয়েছে। নামাজ আদায়কারী ব্যক্তিগণ প্রত্যেক দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে বারবার সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করে থাকেন। এ সুরার মাধ্যমে তাঁরা আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করতে থাকেন-‘তুমি আমাদের সরল ও অবিচল পথটি দেখিয়ে দাও।’ (সুরা ফাতিহা, আয়াত-৫)

 

যে মুসলমান প্রত্যেক দিন ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত নামাজেই সুরা ফাতিহার মাধ্যমে ৩২ বার মহান আল্লাহর কাছে কাতরকণ্ঠে আবেদন করছে-‘আমাদের সহজ-সরল পথ দেখাও।’ সেই মুসলমানের পক্ষে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদী তৎপরতার পথে অগ্রসর হওয়া কি সম্ভব? প্রকৃত মুসলমানদের সাথে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদের ওই দূরত্ব রয়েছে, যে দূরত্ব পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে রয়েছে। ইসলামের নামে যারা সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদী তৎপরতা চালাচ্ছে, তারা না জেনে অথবা ইসলামের দুশমনদের হাতের পুতুল হিসেবেই চালাচ্ছে। মূলত, ইসলাম ও ইসলামপন্থিদের বদনাম করার লক্ষ্যেই শত্রুপক্ষ মুসলিম নামধারী এসব লোককে ব্যবহার করছে।

 

ইসলামের ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর প্রত্যেক পরিসরে ও মুসলিম জীবনের সূচনা এবং সমাপ্তি তথা দুনিয়া-আখিরাতের সবস্থানে শুধু শান্তি কামনা ও প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। সেই ইসলামে সন্ত্রাসবাদ আর জঙ্গীবাদের গন্ধ অনুসন্ধান করা, ‘আল্লাহর আইন চালুর নামে মানুষ হত্যা করা, দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করা একমাত্র মূর্খ, জাহিল, জ্ঞানপাপী, ইসলাম-মুসলমান ও দেশের শত্রুদেরই কাজ হতে পারে। আর যারা নিজেকে মুসলমান দাবি করে ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের পথ অনুসরণ করে দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে, তারা স্পষ্টই ভ্রান্ত পথের অনুসারী এবং এ পথ গিয়েছে জাহান্নামে। বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এসব লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন- তাদেরকে যখনই বলা হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না’ তখনই তারা বলেছে, ‘আমরা তো সংশোধনকারী মাত্র। (সুরা বাকারা : ১১)

 

সন্ত্রাস আর জঙ্গীবাদ নির্ভর পথ অনুসরণ করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মানুষ হত্যাকারীদের যখন বলা হচ্ছে ‘তোমরা কেনো এই বিপর্যয় সৃষ্টি করছো, তারা জবাব দিচ্ছে, ‘আমরা আল্লাহর আইন কায়েমের জন্য এই কাজ করেছি। অর্থাৎ, অশান্তি সৃষ্টিকারী অন্য সকল আইন বাতিল করে আল্লাহর শান্তিময় আইন কায়েম করার লক্ষ্যেই এসব কাজ করছি।’ এসব মূর্খ-জাহিলরাই যে প্রকৃত অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, এই চেতনাই এদের মধ্যে নেই। এসব চেতনাহীন দুষ্কৃতিকারীদের সম্পর্কেই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- সাবধান! প্রকৃতপক্ষে এরাই বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, কিন্তু এর কোনো চেতনাই তাদের নেই। (সুরা বাকারা, আয়াত-১২)

ইসলামের দুশমন কর্তৃক বিভ্রান্ত হয়ে বোমাবাজ মানুষ হত্যাকারী সন্ত্রাসীরা ইসলামের নামে দেশে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে এবং নিজেকে যে নবীর উম্মত তথা অনুসারী হিসেবে দাবি করছে, সেই নবীয়ে রহমত সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা বলেছেন- ‘রাসুলের জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।’ ‘নিশ্চয়ই তুমি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।’ ‘তুমিই সবথেকে সহজ-সরল পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ যে মহামানবকে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ‘সর্বোত্তম আদর্শের অধিকারী ও করুণার মূর্ত প্রতীক’ হিসেবে সনদ দিয়েছেন, সেই মহামানবের অনুসারী হিসেবে নিজেকে দাবি করে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অন্য মানুষকে ও নিজেকে হত্যা করে ‘জান্নাতে যাবার’ প্রলোভন যারা দেখাচ্ছে, তাদের পরিচয়, তারা ইসলাম-মুসলমান, দেশ-জাতি ও সমগ্র মানবতার দুশমন। সচেতন মহলের চোখগুলোকে সিসি টিভিতে পরিণত করে এদেরকে ধরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দিতে হবে এবং এদের ওপর কোরআন ঘোষিত বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের সাথে সম্পর্কিত সর্বোচ্চ দণ্ড প্রয়োগ করাই বর্তমানে সময়ের দাবি।

 

লেখক : মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া হামিউস সুন্নাহ, গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads