• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’ ইসলামে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ

  • প্রকাশিত ১২ জুন ২০২১

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ   

 

 

বর্তমানে বেঁচে থাকার তাগিদে কিংবা পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে কোমলমতি শিশুদেরও প্রচুর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হচ্ছে। ফলে তারা নানা রকম শারীরিক ও মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এমনকি মৃত্যুবরণও করছে। শিশুশ্রম হলো সামাজিক শোষণের দীর্ঘস্থায়ী এক হাতিয়ার। বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস আজ শনিবার (১২ জুন)। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২০০২ সাল থেকে জুন মাসের ১২ তারিখে দিবসটি পালন করা শুরু করে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে শিশুশ্রম বাড়বে। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবীর বহু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসবে। ফলে তারা শিশুদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। এতে জীবন ও জীবিকার জন্য বহু শিশুকে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বাড়বে। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় ১৫২ মিলিয়ন শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। যাদের মধ্যে প্রায় ৭২ মিলিয়ন শিশু বিপজ্জনক কাজে জড়িত। বাংলাদেশে প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন শিশু বিভিন্ন শ্রমে জড়িত।

 

শিশুশ্রম নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিকোণ : শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ইসলামে শিশুশ্রম পরিত্যাজ্য। শিশুশ্রমের ফলে তাদের মননশীলতা ও দৈহিক ক্ষতি হয়। আজ যারা শিশু, ভবিষ্যতে তারাই যুবক। তারাই সুশোভিত ও গৌরবময় ভবিষ্যতের পথনির্দেশক। আজকের শিশুর মাঝেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের সুন্দর পৃথিবী। মহান আল্লাহ বলেন, ‘ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা।’ (সুরা  আল কাহফ, আয়াত -৪৬) নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবহেলিত শিশুদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা ও বিনোদনের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিয়ে ধর্মে-কর্মে যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি শিশুদের প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। শিশুদের প্রতি কোমল ব্যবহার নিজে করেছেন এবং অন্যদের সে ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ আধুনিক যুগে শিশুশ্রমিকরা কতই না অবহেলিত!

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শিশুদের স্নেহ করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-৪৯৪৩) সমাজজীবনে বাস্তবতার নিরিখে শিশুশ্রম পুরোপুরি বন্ধ করা না গেলেও কম ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় তাদের নিয়োগ করা যেতে পারে। পাশাপাশি পাড়াশোনার সুযোগও রাখতে হবে। দারিদ্র্যের কারণে শ্রম বিক্রি করতে যাওয়া শিশুদের জানাতে ও বোঝাতে হবে যে তাদের দারিদ্র্য দূর করার মোক্ষম হাতিয়ার হলো শিক্ষা। ইসলামের বিধান হলো, পিতা অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের উপার্জনের জন্য বাধ্য করতে পারবেন না। তিনি উপার্জন করতে পারলে করবেন, নতুবা ঋণ করে তাদের খরচের ব্যবস্থা করবেন, যেন তারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক হলেও শিক্ষা চলাকালে পিতা তাদের খরচ চালিয়ে যাবেন। (ফাতাওয়া আলমগীরী-১/৫৬১, রদ্দুল মুহতার-৫/৩৪১)

 

প্রতিটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ইসলামে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। অথচ সমাজে এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে শিশুদের কাজ করতে দেখা যায় না। শিশুশ্রমের ফলে শিশুদের মননশীলতা ও দৈহিক ক্ষতি হয় এবং মানসিক চাপ বাড়তে থাকে। অন্যদিকে, শিশুরা আয়ের লক্ষ্যে তাদের বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী বিপদ, ঝুঁকি, শোষণ, বঞ্চনা ও আইনগত জটিলতার সম্মুখীন হয়ে নিজেকে নিয়োজিত করে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িয়ে পড়ে। চরম দারিদ্র্য ও দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সঙ্গে নৈতিক আদর্শের বৈশিষ্ট্য এর মুখ্য কারণ। হতদরিদ্র পরিবার সংসারের ব্যয় নির্বাহে অসমর্থ হয়ে বা অভিভাবকদের কর্মহীনতার কারণে মা-বাবার স্থলে শিশুরা অর্থ উপার্জনে অগ্রসর হয়। তাই শিশুশ্রম বন্ধ করতে না পারলে যতটা সম্ভব শিশুর কর্মস্থল ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ করা প্রয়োজন। ইসলামের শ্রমনীতিমালা অনুসারে কাউকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব প্রদান করা সমীচীন নয়। সামর্থ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান কোনো সময় বড় ধরনের জুলুমের পর্যায়ে চলে যায়। তাই পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ কারো ওপর এমন কোনো কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না, যা তার সাধ্যাতীত।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত-২৮৬)

 

অথচ দেশে কঠিন দারিদ্র্যের কারণে অসংখ্য শিশু ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় ও কায়িক শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে। শিশুরা অস্বাস্থ্যকর ও প্রাণসংকটাপন্ন পরিবেশে কাজ করায় তাদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে এবং তারা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম, যেমন উটের জকি, অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করা হয়। এ ধরনের প্রতিটি কাজ ইসলামে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সামগ্রিকভাবে শিশুদের নিপীড়নমূলক এসব কাজ থেকে মুক্তি দিতে ধর্মীয় সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারিভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামে কাউকে সামর্থ্যের বাইরে কোনো দায়িত্বের নির্দেশ প্রদান করা হয়নি। যে শিশুদের প্রতি দয়া-স্নেহ করে না, সে মুসলমানদের মধ্যে গণ্য নয়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তাদের সামর্থ্যের অধিক কাজ করাতে চাইলে তাদের সহযোগিতার হাত প্রসারিত করো এবং তাদের ওপর শক্তির অধিক কাজ চাপিয়ে দিয়ো না।’ (বুখারি)

 

শিশুশ্রম প্রতিরোধ বিষয়ে সর্বমহলে চিন্তাভাবনা চলছে। কারণ, আজ যারা শিশু, আগামী দিনে তারাই যুবক। শিশুরাই সুশোভিত ও গৌরবময় আগামীর পথনির্দেশক। উন্নত ও ধনী দেশে শিশুরা সব ধরনের অধিকার পেলেও দরিদ্র দেশে তারা মানবাধিকার বঞ্চিত থেকে যায়। শহরে বা গ্রামে প্রায়ই শিশুশ্রমিকদের অঙ্গহানি এমনকি মৃত্যুমুখেও পতিত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। দেশে বিপুলসংখ্যক শিশু শ্রমে নিযুক্ত থাকায় একদিকে যেমন তারা সুন্দর ও নিরাপদ শৈশব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। শিশুরা যখন তাদের সোনালি জগতের বাইরে অন্য জগতে প্রবেশ করে, বেঁচে থাকার রসদ জোগান দেয়, তখন তাদের শারীরিক, মানসিক, আবেগিক, সামাজিক ও নৈতিকতার অবনতি ঘটতে থাকে।

 

লেখক : এম এ কামিল হাদিস, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads