• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

কবিতার প্রতি রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসা

  • প্রকাশিত ১৫ জুন ২০২১

হাসান মাহমুদ

কবিতা আরবদের পুরো জীবনজুড়ে একটি বাস্তবিক চিত্র ছিল। বিশেষত সামাজিক চিত্র। ‘আরবদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, যুদ্ধ-বিগ্রহ, বীরত্ব, প্রেম-ভালোবাসা, মিলন-বিরহ, প্রভৃতি নিখুঁতভাবে ছবি অঙ্কিত হতো তাদের কবিতায়।’ বলা হয় ‘কবিতা আরবদের দিনপঞ্জি।’ অন্ধকার-যুগে কবিরা ছিলেন পরম আরাধ্য। ছিলেন সমাজের প্রাণ ও নেতৃস্থানীয় মান্যবর। ‘সাধারণত লোকেরা আসত তাদের সুখ-দুঃখ নিয়ে, বিপদ-আপদে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ফিরিস্তি নিয়ে কবিদের কাছেই শরণাপন্ন হতো।’ ‘আরবের লোকেরা কবিদের আদেশ-উপদেশ আর ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রাণভরে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত।’ কবিদেরও সম্মান ছিল গোত্রপতি ও বাগ্মীর চেয়ে বেশি। ‘ঝুলন্ত গীতাকা সপ্তক’ খুবই উচ্চমানের কবিতা। ‘কবি ইমরুল কায়েস তার প্রণয় ও সগর্ব নিপাট স্বীকারোক্তি কবিতার পঙক্তিতে দিয়েছেন এভাবে।

‘গর্ভবতী, দুগ্ধবতী তোমার মতো ঢের রূপসী ভুলিয়ে দিয়ে কোলের শিশু ভোগ করেছি ডেরায় পশি। যখন শিশু উঠত কেঁদে মুড়িয়ে দিত অর্ধ দেহ মত্ত বিবশ আধেক তখন আমার নিচে নিঃসন্দেহ।’

‘আরবের কবিরা উপমা উৎপ্রেক্ষা আর শব্দের অনুপ্রাসে সাধারণ লোকদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখত।’

বিশেষত যুদ্ধ-বিগ্রহ বংশপরম্পরার নাম বর্ণনা কবিতার ছত্রেছত্রে বলে যেত অনায়াসে। ‘নিজেদের বীরত্ব প্রকাশে।

মুয়াল্লাকার কবি আনতারা ইবনে শাদ্দাদের কবিতাটি উদ্ধৃত করা হলো-

‘কতই ছিল যুদ্ধ মাঠে অস্ত্রধারী বীর সিপাহি ত্রাসে যাদের সৈন্য সবাই আতঙ্কে ডাক ছড়াত ত্রাহি। সেসব বীরও পায়নি রেহাই লড়াই মাঠে আমার হাতে বিঁধত তাদের অস্থি নিঘাত আমার সবল বর্শাঘাতে! সেই আঘাতের দারুণ চোটে চওড়া ক্ষতের সৃষ্টি হত আর্তনাদে আসত ছুটে নিশির শিবা নেকড়ে যত। হোক সে বড়ো হূৎ ছিঁড়িত দারুণ আমার বর্শা তবু বর্শা যে মোর করত নাকো বড়োয় ছোটোয় বিচার কভু। শ্বাপদ পশুর খাদ্য তাহায় বানিয়ে দিলাম বর্শাঘাতে  শোভন আঙুল, কনুই-পানি চিবিয়ে খেল সমুখ দাঁতে। ছিন্ন করি অসির ঘায়ে বর্ণ শোভন নকশা-কাটা হামলা চালাই সে বীর পরে রইল যে মোর মর্ম আঁটা।’

‘রূপক কবিতায় আরবের কবিরা ছিলেন শ্রেষ্ঠ।’ তাদের রূপকের ব্যবহার ছিল মধুময় ছন্দ। ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবিদেরকে তাদের কবিতার জন্য প্রশংসা করতেন। কবিদের সম্মানও করতেন।’ রাসুলের সামনে জনৈক ব্যক্তি মুয়াল্লাকার কবি আনতারা শাদ্দাদের কবিতা আবৃত্তি করছিলেন, রাসুল তার শৌর্যবীর্যের কথা শুনে আনতারার প্রশংসা করেছেন। ‘আনতারাকে রাসুল দেখতেও চেয়েছেন।’ কি বিস্ময়কর ব্যাপার! মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবি আনতারাকে দেখার আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করেছেন।

‘রাসুল বলেন, বেদুইন কবির কবিতা আমার সামনে আবৃত্তি করা হলে আমি তাকে দেখতে আকাঙ্ক্ষা করেছি। এমনটি শুধু আনতারার বেলায় ঘটেছে।’

আরব কবিদের কিছু কবিতায় ভালো ভালো কথা ছিল। কিছু কিছু কবিতায় তারা রাসুলের হূদয়ে আঘাত হেনে কবিতাও লিখত। ‘রাসুল  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসসান বিন সাবিত (রা.)কে নির্দেশ দিতেন যারা ধর্ম ও নবীকে নিয়ে কটুবাক্যের বান ছুঁড়ত তাদের জবাবে সাহাবি কবিদের দ্বারা সমুচিত জবাব দিতেন।’ রাসুল যে শুধু সাহাবি কবিদের কবিতা বলতে নির্দেশ দিতেন, অনুপ্রাণিত করতেন এমনটি নয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবিদের কবিতা শুনে খুশি হতেন।’ কোনো কবিকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতেন, কোনো কবিকে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার দোয়াও করেছেন। ‘রাসুলের কবি হাসসান বিন সাবিত কুরাইশদের নিন্দবাদে একটি চরণ আবৃত্তি করেছিলেন- ‘আবু সুফিয়ান তুমি  মোহাম্মদের (সা.) কটূক্তি করে কবিতা রচেছ আমি জবাব দিলাম তোমার পরমের তরে আছে বিনিময় আছে পুরস্কার।’

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসসান বিন সাবিতের এই চরণ শুনে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন রাসুলের কবি হাসসান বিন সাবিতকে (রা.)। রাসুল বলেন, হাসসান! আল্লাহর কাছে আছে তোমার পুরস্কার জান্নাত।’ সময়ে সময়ে যুগের পরম্পরায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্তুতি, রসুলপ্রশস্তি, কাসিদা, গজল অনেক কিছু লেখা হয়েছে। আজ অবধি রাসুলের নাত লিখে চলেছে অগণিত কবি।

চৌদ্দ শতাব্দী পর আমরাও লিখছি প্রিয়তম রাসুলকে নিয়ে রাসুলের উপমা একফোঁটা পানি কিবা সহস্র-সমুদ্রের তুলনা হতে পারে আলোকিত ধূলিকণার সাথে সূর্যের তুলনা হতে পারে, হতে পারে শত কিছুর উপমা তুমি মরুভূমির প্রস্ফুটিত ফুল, তুমি শুধু তোমার উপমা। তোমায় নিয়ে একটি উপমা কবিতার চরণে লিখব বলে সারারাত নির্ঘুমে জেগে রই! পৃথিবীর যত উপমা আমার মস্তকে বাসা বাঁধে; সব উপমা নিমিষে ম্লান হয়ে যায়। তোমায় নিয়ে কবিতার চরণে একটি উপমা দিতে গিয়ে আমি থমকে যাই বারবার থমকে যাই! কোনো উপমা তোমার ঊর্ধ্বে। নয় তুমি সব উপমার ঊর্ধ্বে। তুমি সাইয়্যিদুনা  মোহাম্মদ। তুমি শুধু তোমার উপমা।’

অতঃপর রাসুলকে নিয়ে লিখে নিই সোনালি দিন ‘সোনালি দিন আসে তোমার উসিলায়  তোমার উসিলায়।

হে প্রিয়তম! আরব যখন পাপে নিমজ্জিত, তোমার বিভায় চারদিক ভরে উঠে আলোকরশ্মি। তোমায় দেখে আঁধার লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে। তোমার জ্যোতি দেখে চাঁদ হেসে ওঠে। শুভ্রবসন পরে আরবে নেমে আসে ফেরেশতারা।

সালামে সালামে ফেরেশতারা তোমার সাথে হাত মিলায়। আঁধার আড়ষ্ট হয়ে মুখ লুকায় আলো হেসে ওঠে। আলো আঁধারি তোমার প্রেমে হয় উজলধারা ‘কলুষিত জীবনে নেমে আসে আলোর ফোয়ারা।’ নবী মোহাম্মদ। তুমি পরশমণি তোমার ছোঁয়ায় শ্রেণিবৈষম্য নিমিষে মিটে যায়। নবী  মোহাম্মদ, তুমি সুবর্ণনীয়  শ্রেষ্ঠ মানব। ‘প্রিয়তম রাসুল তোমার স্তুতি করেন স্বয়ং রাব্বুল কাবা।’ সাল্লিআলা  মোহাম্মদ।’

রাসুলের কবিতার প্রতি ছিল অগাধ মমতা। তাই ‘রাসুল মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে কালে কালে লেখা হবে আরো অসংখ্য কবিতা, অসংখ্য কাসিদা। পরিশেষে মহাপ্রলয়ের পূর্বপর্যন্ত বর্ষিত হোক রাসুলের প্রতি আরো প্রশান্তির প্রবাহ।’

 

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, মাসিক ছন্দপাতা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads