• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

পিতামাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য

  • প্রকাশিত ২২ জুন ২০২১

আমিনুর রহমান হাসান

 

এই পৃথিবীতে আসার মাধ্যম হিসেবে পিতামাতার কাছে আমরা ঋণী। এই ঋণ শোধ করা আমাদের জন্য সম্ভব না। সন্তানের প্রতি মাতাপিতার অনুগ্রহ এতোটাই যে, সন্তান চাইলেও সারা জীবনে সেটা পরিশোধ করতে পারে না। তবে আল্লাহতায়ালা মাতাপিতার প্রতি সন্তানের কিছু কর্তব্য বলে দিয়েছেন। যেগুলোর মাধ্যমে মাতাপিতার হক কিছুটা হলেও আদায় হয়। আল্লাহতায়ালা পবিত্র  কোরআনে ঘোষণা করেন, “আর তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। যদি পিতামাতার কোনো একজন কিংবা উভয়ে তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তুমি তাদেরকে ‘উফ’ শব্দটি পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না বরং তাদের সাথে বিনম্রভাবে সম্মাসূচক কথা বলো। আর তাঁদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো। আর দোয়া করো, হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি রহমতের আচরণ করুন, যেভাবে তাঁরা শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন।” (সুরা বনী ঈসরাইল আয়াত: ২৩-২৪)

অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, কোনো কিছুর সাথে তার শরিক করোনা এবং পিতামাতার সাথে উত্তম ব্যবহার কর।’ (সুরা নিসা, আয়াত-৩৬) সুরা লোকমানে আল্লাহ বলেন, ‘আমার কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর এবং তোমার মাতাপিতারও কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।’ (সুরা লোকমান আয়াত নং-১৪) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ বিন আববাস রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘যে নেক্কার ছেলে নিজ মাতাপিতার প্রতি রহমত ও আন্তরিকতার দৃষ্টিতে একবার তাকাবে, আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক দৃষ্টির বিনিময়ে তার জন্য একটি মাবরুর হজ্বের (মকবুল হজ্বের) ছওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। সাহাবাগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! যদি উক্ত ব্যক্তি দৈনন্দিন একশত বার তাকায়, তাহলে? তিনি উত্তরে বলেন, হ্যাঁ! আল্লাহতায়ালা সুমহান ও বড় করুণাময়।’ (বায়হাকি : শুয়াবুল ঈমান ১০/২৬৫) অন্য বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘পিতামাতা জান্নাতের মাঝের দরজা। যদি চাও, দরজাটি নষ্ট করে ফেলতে পারো, নতুবা তা রক্ষা করতে পারো।’ (তিরমিযি, তুহফাতুল আহওয়াযী, ৬/২৫)

হজরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হতে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আরজ করলো, হে আল্লাহর রাসুল! সন্তানের ওপর পিতামাতার হক কি আছে? তিনি বললেন, তারা তোমার বেহেশত ও দোযখ’। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৪৯৪১) এ হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মাতাপিতার সাথে সদাচরণ করলে আমরা জান্নাতি হবো এবং অসদাচরণ করলে আমরা জাহান্নামি হবো। এ ক্ষেত্রে আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের চেয়েও পিতামাতার প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ যত্নশীল হতে হবে। মাতাপিতার প্রতি অবাধ্যতার ক্ষেত্রে কোরআন-হাদিসে ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “তার নাক ধূলায় মলিন হোক (৩ বার)। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসুলল! সেই হতভাগ্য ব্যক্তিটি কে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে হলো ওই ব্যক্তি, যে তার পিতামাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তাঁদের সেবা করে জান্নাত হাসিল করতে পারলো না’ (মুসলিম-৪/১৯৭৮, হা-২৫৫১) অর্থাৎ পিতামাতার সাথে ভালো খারাপ আচরণের মাঝেই সন্তানের জান্নাত-জাহান্নাম নিহিত। তাছাড়া পিতামাতার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টির উপর আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি নিহিত। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতামাতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতামাতার অসন্তুষ্টিতে নিহিত।’ (তিরমিযি, হাদিস নং-১৮৯৯) সন্তানের জন্য পিতামাতার দুআ আল্লাহ ফিরিয়ে দেন না। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি বলেছেন, “তিন প্রকারের দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়। ১. পিতামাতার দোয়া তাঁর সন্তানের জন্যে। ২. মুসাফিরের দোয়া। ৩. মাজলুমের দোয়া।” (আবু দাউদ-১৫৬৩, ইবনে মাজাহ ৩৮৬২, তিরমিযি ১৯০৫)

উত্তম রিজিক ও দীর্ঘায়ু নিহিত রয়েছে মাতাপিতার সাথে আচরণের মাঝে। হযরত ছাওবান রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘দোয়া ব্যতীত অন্য কিছুই ভাগ্যকে বদলাতে পারে না এবং পিতামাতার প্রতি সদাচার ব্যতীত অন্য কিছুই আয়ুকে প্রলম্বিত করতে পারে না। কোনো ব্যক্তি তার পাপের কারণে তার রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়।’ (ইবনে মাজাহ-৮৭) আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক নাফরমানির শাস্তি সাধারণত আখেরাতে দেন। তবে মাতাপিতার সাথে অবাধ্যতার শাস্তি দুনিয়া ও আখেরাতে দেন। হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আল্লাহতায়ালা ইচ্ছা করলে সব গুনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন, পিতামাতার নাফরমানি ব্যতীত। আর তিনি পিতামাতার অবাধ্যতার শাস্তি মৃত্যুর পূর্বে দুনিয়াতেই দিয়ে দেন।’ (মুসতাদরাক, হাদিস নং-৭৩৪৫)

যাদের পিতামাতা দুনিয়াতে নেই তাদের জন্য করণীয়। বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহুতায়ালা আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ডুবন্ত ত্রাণপ্রার্থী ব্যক্তির যে অবস্থা , অবিকল সেই অবস্থা হলো কবরে শায়িত মৃত ব্যক্তির। সে দোয়া অপেক্ষায় থাকে, যে দোয়া পিতামাতা, ভাই-বন্ধুদের পক্ষ থেকে তার কাছে পৌঁছবে। যখন এরূপ কোনো  দোয়া তার কাছে পৌঁছে তখন তা তার কাছে দুনিয়া ও দুনিয়ার সব সম্পদ অপেক্ষা প্রিয়তর মনে হয়।’ (বায়হাকি : ৬/২০৩) আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে পিতামাতার সাথে সদাচরণের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন।

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

hasanamin261@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads