• মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জৈষ্ঠ ১৪২৮

ধর্ম

‘বজ্রপাত’ এক বিশেষ সতর্কবাণী

  • প্রকাশিত ২৮ জুন ২০২১

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

 

বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যু ক্রমেই বাড়ছে। সামপ্রতিক বছরগুলোতে সেটা আশঙ্কাজনকভাবেই বেড়েছে। আর এখন বর্ষাকাল চলছে। এ সময় বজ্রপাত হয়। কখনো কম; আবার কখনো বেশি। গত কয়েক বছর বেশ কিছু জেলায় বজ্রপাতে অনেক মানুষ মারা যাওয়ার খবর দেখা গেছে। কিন্তু হঠাৎ করে বজ্রপাত বেশি কেন হয় সে বিষয়ে আবহাওয়াবিদরা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। তাদের মতে, সাধারণত উত্তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বজ্রপাত বেশি হয়। উত্তপ্ত বায়ু দ্রুতগতিতে ঠান্ডা হলে বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। এই বজ্রমেঘের ভেতরে বাতাসের দ্রুতগতির আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে বাতাসের জলীয়বাষ্প একই সময়ে বৃষ্টিকণা, শিশিরবিন্দু ও তুষার কণায় পরিণত হয়।

বজ্রপাতের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিকোণ : বজ্রপাতের প্রচণ্ড গর্জন এবং আলোর ঝলকানি মহান আল্লাহতায়ালার মহাশক্তির বহিঃপ্রকাশ। বজ্রপাতের গর্জন ও আলোর ঝলকানি মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ সতর্কবাণী। বজ্রপাতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয়বান্দাদের সাবধান করে থাকেন। তিনি চাইলে এ বজ্রপাতের মাধ্যমে তাঁর অবাধ্য সীমালংঘনকারী বান্দাদেরকে শাস্তি প্রদান করতে পারেন। যদিও আল্লাহতায়ালা সব সময় তাঁর বান্দাদের প্রতি শাস্তিদানের মতো কঠোর আচরণ করেন না। কেননা আল্লাহতায়ালা বান্দার জন্য রাহমান, রাহিম; গাফুর ও গাফ্ফার। মহান আল্লাহতায়ালা বজ্রপাত প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘মেঘের গর্জন তাঁর প্রশংসাসহকারে পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং ফেরেশতারা তাঁর ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে তাসবিহ পাঠ করে। তিনি বজ্রপাত করেন এবং (অনেক সময়) তাকে যার ওপর চান, ঠিক সে যখন আল্লাহ সম্পর্কে বিতণ্ডায় লিপ্ত তখনই নিক্ষেপ করেন। অথচ আল্লাহতায়ালার শক্তি কৌশল ও শক্তি বড়ই জবরদস্ত।’ (সুরা রাদ, আয়াত-১৩)

পথহারা মানুষের জন্য মেঘের গর্জন ও বিদ্যুৎচমক শিক্ষণীয় বিষয়। কারণ মেঘের গর্জন এ কথা প্রকাশ করে যে, আল্লাহতায়ালা যে বায়ু পরিচালিত করেন, বাষ্প ও মেঘমালাকে একত্র করেন। এ বিদ্যুৎকে বৃষ্টির মাধ্যম বা উপলক্ষ বানান এবং পৃথিবীর সৃষ্টিকুলের জন্য তিনি পানির ব্যবস্থা করেন। তিনি যাবতীয় ভুলত্রুটি-অভাবমুক্ত। তিনি জ্ঞান ও শক্তির দিক থেকে পূর্ণতার অধিকারী। নির্বোধ শ্রবণ শক্তির অধিকারীতো এ মেঘের মধ্যে শুধুই গর্জনই শুনতে পায় কিন্তু বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন সজাগ শ্রবণশক্তির অধিকারী ব্যক্তিরা মেঘের গর্জনের মধ্যে আল্লাহর অসীম ক্ষমতার নির্দশন দেখতে পান। আল্লাহর শক্তিমত্তা ও অপার কৌশল দেখে মেঘমালাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে থাকা ফেরেশতাসহ অন্যান্য সব ফেরেশতারাও তাঁর ভয়ে তাসবিহ পাঠ করে। আরবের মুশরিকরা আল্লাহর উপাসনা বাদ দিয়ে ফেরেশতাদেরকেও দেবতা হিসেবে গণ্য করতো। মানুষের আল্লাহদ্রোহীতা ও জুলুম-অত্যাচার, জিনা-ব্যভিচারসহ যাবতীয় মানবতাবিবর্জিত অন্যায় কাজই এ বজ্রপাতের মূল কারণ।

এসব বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমক থেকে বেঁচে থাকতে হলে অবশ্যই মানুষকে দুনিয়ার যাবতীয় অন্যায় পরিত্যাগ করতে হবে। নিজেদের গোনাহ থেকে খাঁটি তাওবা করতে হবে। যারা খাঁটি তাওবার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার দিকে ফিরে আসবে তারাই বজ্রপাত থেকে মুক্ত থাকবে। হাদিসে এসেছে, ‘হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দারা যদি আমার বিধান যথাযথ মেনে চলত, তবে আমি তাদেরকে রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম আর সকাল বেলায় সূর্য (আলো) দিতাম এবং কখনো তাদেরকে বজ্রপাতের আওয়াজ শুনাতাম না।’ (মুসনাদে আহমদ)

কোরআন এবং হাদিসের বর্ণনায় এ কথা সুস্পষ্ট যে, বজ্রপাত পরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে এক মহাদুর্যোগ। আল্লাহপ্রদত্ত এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বেঁচে থাকতে হলে  কোরআন-হাদিসের নির্দেশ পালনের বিকল্প নেই। পত্র-পত্রিকায় দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, কোথাও না কোথাও বজ্রপাতে প্রাণহানি ঘটেছে। আবার একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। যা মানুষের জন্য তাদের অবাধ্যতার সতর্কবাণী।  কোরআনের বিধান পালন এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো তাসবিহ ও দোয়াপাঠে বজ্রপাতের দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বজ্রপাতসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতদের বিভিন্ন দোয়া ও তাসবিহ শিখিয়েছেন।

হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন তখন বলতেন- ‘আল্লাহুমা লা তাকতুলনা বিগজাবিকা ওয়া লা তুহলিকনা বিআজাবিজকা ওয়া আফিয়া ক্ববলা জালিকা।’ (তিরমিযি) অন্য বর্ণনায় এসেছে-হজরত ইবনে আবি জাকারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি বজ্রের আওয়াজ শুনে এ দোয়া পড়বে ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি; সে বজ্রপাতের আঘাতপ্রাপ্ত হবে না।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা) অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে-হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেঘের গর্জন শুনতেন তখন কথাবার্তা ছেড়ে দিতেন এবং এ আয়াত পাঠ করতেন, ‘সুবহানাল্লাজি ইউসাব্বিহুর রাদু বিহামদিহি ওয়াল মালা-ইকাতু মিন খি ফাতিহি’। অর্থ : আমি সেই সত্তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, যার পবিত্র ঘোষণা করছে মেঘের গর্জন তাঁর প্রশংসার সাথে। আর ফেরেশতাকুল প্রশংসা করে ভয়ের সাথে।’ (মুয়াত্তা মালেক, মিশকাত)

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা : জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হওয়ার সময় এতে প্রচুর স্থির বৈদ্যুতিক চার্জ জমা হয়। পানিচক্রে জলকণা যখন ক্রমশ ঊর্ধ্বাকাশে উঠতে থাকে তখন তারা মেঘের নিচের দিকের বেশি ঘনীভূত বৃষ্টি বা তুষার কণার সাথে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। যার ফলে ওপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্প পরমাণু বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। যে পরমাণু ইলেকট্রন হারায় তা পজিটিভ চার্জে এবং যে পরমাণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে তা নেগেটিভ চার্জে চার্জিত হয়। অপেক্ষাকৃত হাল্কা পজিটিভ চার্জ থাকে মেঘের ওপর পৃষ্ঠে এবং ভারী নেগেটিভ চার্জ থাকে নিচের পৃষ্ঠে। যথেষ্ট পরিমাণ পজিটিভ (+) ও নেগেটিভ (-) চার্জ জমা হওয়ার পর পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণের দরুণ electrostatic discharge প্রক্রিয়া শুরু হয়। discharge তিনভাবে হতে পারে- (ক) মেঘের নিজস্ব পজিটিভ (+) ও নেগেটিভ (-) চার্জের মধ্যে। (খ) একটি মেঘের পজেটিভ (+) কিংবা নেগেটিভ (-) চার্জের সাথে অন্য মেঘের নেগেটিভ (-) কিংবা পজেটিভ (+) চার্জের সাথে। (গ) মেঘের পজেটিভ (+) চার্জের সাথে ভূমির Discharge হওয়ার সময় পজেটিভ (+) চার্জ থেকে নেগেটিভ (-) চার্জের দিকে বাতাসের মধ্য দিয়ে স্পার্ক আকারে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। এ ঘটনাই হলো বজ্রপাত।

বজ্রপাতের নামে নামকরণ করে আল্লাহতায়ালা একটি সুরা নাজিল করেছেন। নাজিলকৃত সুরার নাম ‘সুরা- রদ।’ (১৩ নম্বর পারা, ১৩ নং সুরা) এছাড়াও পবিত্র কোরআনে আল্লাহরাব্বুল আলামীন বজ্রপাতের কিছু স্পষ্ট কারণ উল্লেখ করেছেন। ‘দেশে জুলুম অত্যাচার অতি মাত্রায় বেড়ে গেলে বজ্রপাত হয়।’ (সুরা নিসা, আয়াত-১৫৩) ‘আল্লার বিধান অমান্য করার কারণেই বজ্রপাত হয়। জুলুম-অত্যচার ও গুণাহের কাজ যত বাড়বে বজ্রপাত তত বাড়বে।’ (সুরা যারিয়াত, আয়াত-৪৪) ‘বজ্রপাত আল্লাহ গজবের স্পষ্ট প্রমাণ।’ (সুরা তুর, আয়াত -৪৫) অতএব বজ্রপাত প্রতিহত করার বা রক্ষা পাওয়ার জন্য আমরা আল্লাহপাকের নির্দেশ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

প্রকৃতির অন্যতম দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো বজ্রপাত। এটি মানুষের পরিচিত সবচেয়ে ভয়ংকর, মেঘের গর্জন তথা বজ্রপাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভয়াবহ শাস্তি থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহতায়ালার বিধান মেনে চলা জরুরি। পাশাপাশি বজ্রপাতের ভয়াবহতা থেকে বেঁচে থাকতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো দোয়া ও তাসবিহগুলো পড়া উচিত। আল্লাহতায়ালা মুসলিম উম্মাহকে মেঘের গর্জন তথা বজ্রপাতের সময় আল্লাহর প্রশংসা করা, সব ধরনের অন্যায় ও অবাধ্য আচরণ থেকে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার এবং তার বিধান পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

 

লেখক: এম এ কামিল হাদিস, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা

কো-চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ রোগী কল্যাণ সোসাইটি

drmazed689@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads