• মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জৈষ্ঠ ১৪২৮

ধর্ম

ইসলামের দৃষ্টিতে ‘সিন্ডিকেট’

  • প্রকাশিত ০১ জুলাই ২০২১

আমীন আল মোহাম্মদ

 

বর্তমান সময়ে ‘সিন্ডিকেট’ কথাটা বা শব্দটা আমাদের মাঝে বহুল পরিচত এবং প্রসিদ্ধ। ছোট থেকে বড় প্রায় সবার মুখেই এখন সিন্ডিকেট শব্দটা উচ্চারিত হয়। কেউ উচ্চারণ করে এ থেকে লাভবান হয়ে আর কেউ এর জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এর থেকে পরিত্রাণের জন্য। তাছাড়া পত্র-পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলে চোখ বুলাতেই ভেসে উঠে সিন্ডিকেটচক্রের বাজার দখলের কথা।

সিন্ডিকেটচক্র যখন ইসলামী হুকুম অমান্য করে পণ্য বা মালপত্র গুদামজাত করে তখন সাধারণ জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে যায় বিভিন্ন পণ্য সংগ্রহ করার জন্য। এর কারণ হলো, সরকার প্রতিটা পণ্যের অল্প মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। তখন সিন্ডিকেট চক্ররা একজোট হয়ে বেশি লাভের আশায় পণ্যগুলো গুদামজাত করে রাখে। পরবর্তীতে যখন বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দেয় তখন পণের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে এতটা আকাশচুম্বী হয়ে যায় যে, ক্রয়মূল্য সাধারণ জনগণের সাধ্যের বাইরে চলে যায়। ফলে সাধারণ জনগণের ভোগান্তির শেষ থাকে না। এতে সবচে’ বেশি ভোগান্তির শিকার হয়; নিম্ন, নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক জনগণ। তারা না পারে চড়া দামে কিনে নিতে, না পারে কিনে রাখতে। অথচ এমন করাকে সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও হারাম বলেছে ইসলাম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে সে পাপিষ্ঠ।’ (সহিহ মুসলিম) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি বেশি মূল্যের আশায় মাল জমা রাখে, সে ব্যক্তি গুনাহগার।’ (মুসলিম ও আবু দাউদ)

 

কয়েক মাস আগে পেঁয়াজের দাম খুব বেড়েছিল। ৩০/৪০ টাকা কেজির পেঁয়াজ ১৫০ থেকে ২০০ টাকাতেও বিক্রি হয়েছে। এমনকি অনেক জায়গায় এই পেঁয়াজের দাম ৩০০ গিয়েও ঠেকেছিল। আমাদের দেশের ঋতুগুলোকে সাধারণত দুভাগে ভাগ করা যায়। ১. বর্ষা ২. শুকনো। এই শুকনো মৌসুমেই আমাদের দেশের কৃষকরা নানান ধরনের সবজি উৎপাদন করে বাজারজাত করেন। কৃষকদের কাছ থেকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা সে সমস্ত সবজি নিম্নদামে খরিদ করে গুদামজাত করে রাখে। পরবর্তীতে অর্থাৎ সব্জির অমৌসুমি বর্ষায় যখন বাজারে মানুষের চাহিদানুযায়ী সে সমস্ত পণ্যের অভাব দেখা দেয় ঠিক তখনই অসাধু ব্যবসায়ীরা চড়া মূল্যে পণ্য বাজারে ছাড়ে।

এ সময় যাতে পণ্যের দাম না বাড়তে পারে, সেজন্য সরকার অতিরিক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করে বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে চায়। এমনকি সরকারিভাবে পণ্যের একটা নির্ধারিত মূল্যও নির্ধারণ করে দেয়। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে সরকারিভাবে মালের মূল্য নির্ধারণ করারও প্রয়োজন নেই; বরং পণ্যকে তার স্বাভাবিক গতিতেই চলতে দেওয়া উচিত। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে একবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেল। লোকেরা বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মূলত আল্লাহতায়ালাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী, রিজিক সঙ্কীর্ণকর্তা, প্রশস্তকর্তা ও রিজিকদাতা। আমি আমার রবের সঙ্গে এভাবে সাক্ষাতের আশা রাখি যে, তোমাদের কারো যেন আমার বিরুদ্ধে রক্ত বা সম্পদ, কোনো বিষয়ে কোনোরূপ দাবি না থাকে।’ (তিরমিযি, হাদিস নং- ২৪৫) কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি থেকে সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে সরকার দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারেন।

পণ্য গুদামজাত করার কারণে জনগণ সঠিক মূল্যে দ্রব্য পায় না। অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্য গুদামে রেখে দিয়ে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। যার ফলে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। আর যখনই পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখনই ব্যবসায়ীরা সেই গুদামে মজুত করে রাখা অতিরিক্ত পণ্য বেশি দামে বাজারে ছাড়ে। আর এই ঘটনাটা হলো এক প্রকারের সিন্ডিকেটের উদাহরণ। তাছাড়া বাজেট ঘোষণার আগে ও পড়ে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্য জিনিসও এরকম সিন্ডিকেট করে রাখে এবং যখন সেটার দাম বৃদ্ধি পায়, তখনই সেটা বাজারে ছাড়ে। ইসলামে এধরনের ব্যবসায়ীদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুত করে রাখে সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং তার প্রতি আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।’ (মিশকাত, হাদিস নং-১৩১৬)

হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখবে, সে তার মাল পরবর্তীতে সদকা করে দিলেও তার গুনাহ ক্ষমার জন্য যথেষ্ট হবে না।’ অন্যত্র বর্ণিত আছে, ‘আমদানিকারক মুনাফা অর্জন করবে, সে যেন গুদামজাতকারী অভিশপ্ত হিসেবে চিহ্নিত হবে।’ (ইবনে মাজাহ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘ন্যায্যমূল্যে জিনিস সরবরাহকারী রিজিকপ্রাপ্ত আর মজুত করে সংকট সৃষ্টিকারী অভিশপ্ত।’ (বুখারি, হাদিস নং- ৩৭১২) গুদামজাতকারীদের জন্য দুনিয়াতেও রয়েছে কঠিন রোগ-শোক, বালা-মুসিবত। হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের খাদ্য গুদামজাত করে রাখবে, আল্লাহ তাকে দারিদ্র্য ও কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত করবেন।’ (ইবনে মাজাহ)

যেসব অবস্থায় মাল গুদামজাত করা নিষেধ। ১. স্বল্পমূল্য চলাকালীন খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে বেশি লাভের আশায় এমনভাবে গুদামজাত করা যে বাজারে তার প্রতিক্রিয়া পড়ে। ২. কোনো দ্রব্য এমন পরিমাণে গুদামজাত করা, যে কারণে ক্রেতা সাধারণত সে পণ্যের চরম সংকটের সম্মুখীন হয়। ৩. মানুষের খাদ্যদ্রব্য সংকট অবস্থায় যে কোনো পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করা। ৪. বাজারে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টির জন্য গুদামজাত করা। উল্লেখিত অবস্থায় মাল গুদামজাত করা নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ।

বেশ কয়েক বছর থেকে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, কৃষক তার সোনালী ফসল ধানের দাম ঠিকমতো পাচ্ছে না। অপরদিকে সেসব কৃষকরা-ই যখন চাল কিনতে হাটে-বাজারে যায় তখন চালের দাম শুনে তাদের মাথা চক্কর দিয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এখানেও একটা প্রশ্ন থেকে যায় যে, কেন তারা ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া সত্ত্বেও ধান বিক্রি করতে হচ্ছে, আবার চড়া দামে চাল কিনছে? এর উত্তর একজন কৃষকের বক্তব্য দ্বারাই দিচ্ছি ‘আমরা গরিব মানুষ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ক্ষেতে ধান চাষ করি, সে ধান ফলিয়ে তা বিক্রি করে ব্যাংকের লোন পরিশোধ করে যা লাভ হবে তা দিয়ে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে বাকি একবছর বা পরের ধান মৌসুম পর্যন্ত চালিয়ে যাবো। কিন্তু আমরা ধানের ন্যায্য মূল্য পাইনা। তারপরও বাধ্য হয়ে বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করি। নয়তো সুদের গ্লানি টানতে টানতেই বাকি জীবন পার করতে হবে।’

আসলে যারা কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে, তারা প্রতি বছর ধানের মূল্য নিয়ে এক প্রকার সিন্ডিকেট করে। সারা দেশে তারা নিজেরা একটা দাম ঠিক করে দেয় যে, সেই দাম থেকে বেশি দামে কেউ কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনবে না। যার ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে লস হওয়া সত্ত্বেও কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আর একারণেই কৃষকরা ধান বিক্রি করে লোকসানে পড়ছে বারংবার। 

সর্বোপরি জনসাধারণকে ভোগান্তিতে ফেলতে পণ্য গুদামজাত করা বা বিভিন্ন জিনিসে সিন্ডিকেট করা ইসলামে চরম ঘৃণিত কাজ। কেননা ব্যবসায়ীদের স্বার্থের জন্য গরিব দুঃখী ও অসহায় মানুষ কষ্টের মধ্যে পতিত হয়। আল্লাহর কাছে তাদের ফরিয়াদ বয়ে আনতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রের দুর্ভিক্ষসহ নানান কঠিন আজাব। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যেসব লোক বিনা দোষে মুমিন পুরুষ ও নারীকে কষ্ট দেয়। তারা অতি বড় একটা মিথ্যা অপবাদ ও সুস্পষ্ট গুনাহের বোঝা নিজেদের মাথায় তুলে নেয়।’ (সুরা  আহজাব, আয়াত-৫৮) তাই সরকার বা প্রশাসনসহ সর্বসাধারণকে এবিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। ইসলামকে বুঝতে হবে এবং তা মানার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাবন্ধিক

সদস্য, বাংলাদেশ কওমী তরুণ লেখক ফোরাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads