• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

রাগ নিয়ন্ত্রণের মেহনত ও মহাপুরস্কার

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ০২ জুলাই ২০২১

শায়খ ড. মুশতাক আহমদ

 

‘রাগ’ কিভাবে কমানো যায়?

কিভাবে রাগ নিয়ন্ত্রিত রাখা যায়? এই রাগ আমাদের জীবনযাত্রায়, আমাদের পরিবার পরিমণ্ডলে নানান রকমের  অনিষ্টতা ডেকে আনছে! স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ভালো মিল মোহাব্বত। উভয় নামাজি, দীনদার। অথচ রাগ নিয়ন্ত্রিত না থাকায় কত জায়গায়  কঠিন কঠিন সমস্যা ঘটে যাচ্ছে। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্যে এই কাজগুলো আমাদের করণীয়;

 

ক. প্রথমে নিয়ত করতে হবে, আমি নিয়ত করলাম রাগ নিয়ন্ত্রিত রাখব। রাগের অনিষ্টতা থেকে নিজকে হেফাজত করব। রাগ  আল্লাহপ্রদত্ত এক  নিয়ামত। এই নিয়ামত আমি গলৎভাবে ব্যবহূত হতে  দেব না।

 

খ. তারপর সশব্দে মুখে মুখে তিনবার বলেন, আমি তাওবা করলাম আমি আর রাগ করব না,  রাগ  নিয়ন্ত্রণে রাখব। খেয়াল রাখবেন, এখানে পাঁচটি ধাপ আছে-রাগ, উত্তেজনা, তর্ক, প্রতিবাদ, প্রতিশোধ। একটি ধাপের সাথে আরেকটি ধাপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত। মানে আপনি নিজ থেকে না থামলে রাগ আপনাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অতিদূর গিয়ে নিক্ষেপ করবে।

 

গ. নিজ দেমাগে রাগ উঠতে দেখলেই অবিলম্বে তিনবার পড়ে নেবেন, ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম’। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৩২৮২)

তারপর বাঁ দিকে হালকা থুথু নিক্ষেপ করবেন। কারণ মালউন শয়তান আপনার বাঁ দিকে অদৃশ্য বসে এই অপকর্ম পরিচালনা করছে। জিন ও শয়তান মানুষের থুথু সহ্য করতে পারে না।

 

ঘ. এই আমলের দ্বারা আশা করি রাগ থেমে যাবে। যদি এর দ্বারা রাগ নিয়ন্ত্রণে  না আসে, তাহলে দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো আপনি নিজ অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলুন। অর্থাৎ আপনি খাড়া অবস্থায় থাকলে মাটিতে বসে যান, বসা অবস্থায় থাকলে বিছানায় শুয়ে যান। আউজুবিল্লাহ পড়ুন আর মনে মনে খুব ইস্তিগফার করতে থাকুন। ইনশাআল্লাহ দেমাগে রাগ থাকবে না। কিছুমাত্র থাকলেও সেটি আপনার কোনো অনিষ্ট সাধন করতে সক্ষম হবে না।

 

খামোখা রাগারাগির অনিষ্ট থেকে বিমুক্ত সুন্দর জীবনযাপন করতে চাইলে দুটি কাজ করে নিজ তবিয়তকে বানাতে হবে। এক. তাসবিহ হাতে নিয়ে দৈনিক অন্তত ১০০ বার জপতে থাকবেন এবং নিজ তবিয়ত তৈয়ার হওয়া পর্যন্ত এই মুজাহাদা অব্যাহত রাখুন। অবশ্য এই মেহনতের কারণে আপনি পাশাপাশি মুজাহাদা নামক আমলের অনেক বড় সাওয়াবের অধিকারী হতে থাকবেন। জপন বাক্যটি হলো; ‘আমি রাগ করবো না, উত্তেজিত হবো না, তর্কে জড়াবো না, প্রতিবাদ করবো না, প্রতিশোধ নেব না’। নিয়মমতো আমল করলে আশা করা যায় রাগজনিত ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে আপনি সম্পূর্ণভাবে মুক্তি পেয়ে যাবেন। দুই. নিম্মোক্ত কথাগুলো দেমাগে রেখে খুব ভাবনা ভাবতে থাকুন। একান্তে মোরাকাবার হালতে নিজকে কল্পনায় বায়তুল্লাহ শরিফের সম্মুখে বসিয়ে ভাবতে থাকুন। মহান আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে ভাবতে থাকুন। আখিরাতের জবাবদিহিতার কথা মাথায় রেখে ভাবতে থাকুন।

 

১. মুমিন বান্দা রাগ করে না। মুমিন বান্দা রাগ করতে পারে না। কারণ রাগ করা হারাম, রাগ করা  কবীরা গুনাহ, রাগ করা শয়তানের আনুগত্য। কাজেই আমি  জেনেশুনে শয়তানের তাঁবেদারি করতে পারি না৷ এই গুনাহ আমার দ্বারা হতে পারে না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক সাহাবি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন, আমাকে কিছু উপদেশ করুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, রাগ করো না৷ সাহাবি আবার রাসুলের নিকট উপদেশ চায়। রাসুল আবার বললেন রাগ করো না।  রাগ করো না। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১৫৩৫) খেয়াল করুন, রাগের পরিণাম কখনোই ভালো হয় না। রাগের মাথায় কোনো ভালো কাজ করলেও পরিণাম তার ভালো পাওয়া যায় না। একবার আমি মাথায় রাগ নিয়ে একটি গানের আসর বন্ধ করেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম ফলাফল খুব ভালো হয়নি। আরো অনুভব করলাম যে, বরঞ্চ রাগ না করে সেখানে উপযুক্ত ভালোবাসার আচরণ করলে ভালোবাসার মাধ্যমে নসিহত করা হলে লাভ বেশি হতো।

 

২. রাগ বস্তুত শয়তান কর্তৃক ব্যবহারের অস্ত্র। নিখুঁত অস্ত্র, অব্যার্থ অস্ত্র। এই অস্ত্রটি জমা থাকে মানুষের দেমাগে। আর এটি ব্যবহার করে ইবলিস শয়তান। তাও আপনার অকল্যাণ কাজে। পয়গাম্বর হজরত ইয়াহয়া (আ.) শয়তানকে বলেছিলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কখনো রাগ করব না। প্রতি-উত্তরে শয়তান বলেছিল, আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনো বনী আদমকে আর কখনো নিজের আসল সত্য কথা জানাবো না।

 

৩. মুমিন বান্দা রাগ করে না; তবে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে রাগ দেখায়, ঠাণ্ডা মাথায় রাগকে প্রয়োজনমতো ইস্তিমাল করে। রাগ করা এক জিনিস আর রাগ দেখানো আরেক জিনিস। রাগ করা হারাম তবে রাগ দেখানো জায়িজ; বরং ক্ষেত্রভেদে রাগ দেখানো ওয়াজিব। দুটির মধ্যে পার্থক্য ঘটে মুখে আর দেমাগে। (গল্প) এক বুজর্গ সাপকে বলে ছিলেন রাগ করবি না। ফলে সাপের অবস্থা ধরাশায়ী হয়ে গেল। পরে ওই বুজর্গ সাপকে বললেন, রাগ করতে নিষেধ করেছি, দেখাতে তো নিষেধ করিনি। তুই ফোঁসফাঁস তো দেখাবি। মুখে রাগ মানে দেমাগ ঠাণ্ডা। রাগ না দেখানো হলে পরিবারে সমাজে আপনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত বহু ঝামেলা পোহাতে হবে। শরিয়াতের বরখেলাফ কাজের প্রতিরোধে অবশ্যই রাগ দেখাতে হবে।

 

৪. মনে রাখবেন, রাগ ধরে রাখার জিনিস নয়। মুমিন হয় ক্ষণরাগী। সে প্রয়োজনে রাগ দেখায় আবার স্বল্পসময়ে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সে রাগ দেখায়; তাও কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। রাগ দেখায় অন্যের সাবধানতার জন্য। সে রাগকে কখনো নিজ দেমাগে ধরে রাখে না। রাগ ধরে রাখার মধ্যে নিজের যেমন কষ্ট তেমন অন্যের জন্যও। মুমিন বান্দা প্রয়োজনের কারণে রাগ ধরে রাখলেও সেটাও হবে সর্বোচ্চ ৩ দিন লম্বা। এর বেশি নয়। এর বেশি হলে উম্মত থেকে নাম কেটে যাবে। তাই খুব সাবধান।

 

৫. কারো রাগ ভাঙানো অনেক বড় সুন্নাত। দুই মুমিন বান্দার মধ্যে মিলমিশ করে দেওয়া শরিয়াতের অনেক বড় হুকুম পালন করা। রাগকারীদের যিনি রাগ ভাঙার জন্য আগে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন তিনি আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়। তার এই অগ্রণী ভূমিকার জন্য আল্লাহ তার সকল গুনাহ মাফ করে দেন। অধিকন্তু আল্লাহ তাকে নিজ বন্ধু ঘোষণা দেন। অনুরূপে তৃতীয় ব্যক্তি যিনি উভয়ের মধ্যে মিল করে দেন তাকেও আল্লাহ নিজ বন্ধু ঘোষণা দেন। তাঁর জন্য বরাদ্দ আছে মহাপুরস্কার।

 

৬. প্রতিজ্ঞা করুন, রাগ নয় আমি ক্ষমা করব, ক্ষমা করতে শিখব, ক্ষমা করার অভ্যাস বানাব, আল্লাহর হাবীবের সুন্নাতের অনুসরণে ক্ষমার আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করব। এটাই হলো হিম্মত, এটা হলো বুজর্গী। পরিবারপরিজন আপনজনের সাথে সর্বদা ক্ষমার প্রেকটিস করব, করেই যাব। অতীব দুঃখের বিষয়; লোকেরা আপনজনের সাথে বেশি রাগ করে থাকে।

 

রাগ দমনকারীর জন্যে রয়েছে  মহাপুরস্কার।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কাকে তোমরা অধিক শক্তিশালী মনে কর? তাঁরা উত্তর দিলেন, যে ব্যক্তি কুস্তিতে অন্যকে হারিয়ে দিতে পারে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে প্রকৃত বীর নয় যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়;  বরং সে-ই প্রকৃত বীর যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।’ (বুখারি, হাদিস নং-৫৬৮৪) রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘অতএব তোমাদের যা দেওয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগমাত্র। আর আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী, তাদের জন্য যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের পালনকর্তার ওপর ভরসা করে। যারা বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে এবং ক্রোধান্বিত হয়েও ক্ষমা করে।’ (সুরা আশ-শুরা, আয়াত -৩৬, ৩৭)

 

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধ চরিতার্থ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সংবরণ করে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন সমগ্র সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং জান্নাতের যে কোনো হুর নিজের ইচ্ছামতো বেছে নেওয়ার অধিকার দান করবেন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৪১৮৬) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য বান্দার ক্রোধ সংবরণে যে মহান প্রতিদান রয়েছে, তা অন্য কিছুতে নেই।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-৪১৮৯)

 

লেখক : উপ-পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

প্রিন্সিপাল, জামিয়া শায়খ জাকারিয়া, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads