• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

‘সিজদা’ আল্লাহর নৈকট্যলাভের সহজ মাধ্যম

  • প্রকাশিত ০৫ জুলাই ২০২১

মুহাম্মাদ হাবীব আনওয়ার

 

হাটহাজারী মাদরাসার বায়তুল করিম মসজিদে মাগরিব নামাজে আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন অশীতিপর একজন বৃদ্ধ। দেখতে সজ্জন মানুষ মনে হয়েছে। এই বয়সেও বহু কষ্টে আল্লাহর সমীপে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে সাচ্ছন্দ্যচিত্তে  নিজেকে নিয়ে এসেছেন মসজিদে। বয়োবৃদ্ধ মানুষটি বহু কষ্টে কিয়াম-রুকু করলেও সিজদাতে গিয়ে কপাল ঠেকাতে পারলেন না পরম করুণাময় প্রভুর কুদরতি পায়ে। অগত্যা ইশারায় সারলেন সিজদাহর কার্য। নামাজ শেষে দীর্ঘ সময় তাসবিহ-তাহলিল জপলেন। দীর্ঘসময় তাঁর পানে চেয়ে  উপলব্ধিতে এলো; আল্লাহর হুকুম ফরজ নামাজের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে পারলেও আল্লাহর কুদরতি পায়ে লুটে না পরার আফসোস তার চেহারায় স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে। লজ্জায় ও রুষ্টতায় মুখাবয়ব লালবর্ণে ছেয়ে গেছে। বৃদ্ধের অপারগময় অসহায়ত্ব হূদয়ে প্রবলভাবে রেখাপাত করলো। তমাচ্ছন্নতায় ছেয়ে গেল মন। ভাবনার অন্তরালে হারিয়ে বৃদ্ধের জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করার প্রয়াস চলালাম। যৌবনের অপব্যবহার, অলসতায় মজে থাকা, শয়তানের প্রলোভনে যৌবনের তাড়নায় আল্লাহর আহ্বানকে অগ্রাহ্য করার যে দুঃসাহস হূদয়ে ছেয়ে গেছে এর ভয়াবহতা নিয়ে ভাবনার উদয় হলো।

শহরের কোলাহল ভেদ করে কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে ১৪০০ বছর পূর্বে আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক ঘোষিত যুবক বয়সে ইবাদতের গুরুত্ব কানে ভেসে এলো। হূদয় উদ্বেলিত হয়ে তা গ্রহণ করলো। যুবক বয়সকে ইবাদতের স্বর্ণযুগ কেন বলা হয়েছে; তা বৃদ্ধকে দেখে কিছুটা উপলব্ধি হলো। বর্তমান যুবসমাজের মুখে একটি কথা খুব জোরসে শোনা যায় তাহলো; ইবাদতের অনেক সময় আছে। এখন একটু ইনজয় করি। বৃদ্ধ বয়সে করবো ইবাদত। কিন্তু তারা কি উপলব্ধি করবে সিজদা না দিতে পারায় এই বৃদ্ধের আত্মকথন। তার আফসোস! প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সম্ভব হচ্ছে না আল্লাহ কুদরতি পায়ে মাথা ঠেকিয়ে তৃপ্তিভরে মন শান্ত করে, হূদয়ের আকুতিগুলো দু-ফোঁটা অশ্রুতে প্রকাশ করার। মন চাইলেও সম্ভব নয় সিজদার হক আদায় করে একটা সিজদা দেওয়া। একটা সিজদাহর কত দাম। সিজদা দিতে না পারার ব্যথা কতটা কষ্টদায়ক তা একমাত্র ওই বৃদ্ধ বলতে পারবে।

আজ আমরা কতশত সিজদাহ মিস করছি। একটিবার চিন্তা করে দেখুন ইবলিশ মাত্র একটি সিজদা না দেওয়ায় পরিণতি কত ভয়াবহ হয়েছে। ইবলিস বড় আবেদ ছিল। সাতটি আসমানে তাকে সাত নামে ডাকা হতো। ফেরেশতাদের শিক্ষক ছিল। কিন্তু শুধুমাত্র একটি সিজদাহ দিতে অস্বীকার করায় আজকে তার পরিণতি কত ভয়াবহ। একটা সিজদা দিতে অস্বীকার করায় আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়েছে। পৃথিবীতে যা কিছু আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন, সবাই আল্লাহকে সিজদা করে। পবিত্র কোরআনে সে কথায় বিধৃত হয়েছে, ‘আর আসমানসমূহ ও জমিনের সবকিছুই আল্লাহর জন্য অনুগত্য ও বাধ্য হয়ে সকাল সন্ধ্যায় সিজদা করে এবং তাদের ছায়াগুলোও।’ (সুরা রাদ, আয়াত নং-১৫) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে ‘আর আসমান ও জমিনের যত প্রাণী এবং ফেরেশতা আছে সবাই আল্লাহকেই সিজদা করে, তারা অহঙ্কার করে না। তারা তাদের উপরস্থ রবকে ভয় করে এবং তাদেরকে যা নিদের্শ দেওয়া হয়, তারা তা পালন করে।’ (সুরা নাহল, আয়াত নং-৫০)

আসমান-জমিনের সকল প্রাণী ও ফেরেশতা আল্লাহর সামনে অবনত মস্তকে সিজদায় লুটিয়ে পরে। অহঙ্কারের বশীভূত হয়ে আল্লাহর অবাধ্যতা করে না। কিন্তু আমরা কেন প্রতিনিয়ত আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হচ্ছি। প্রতিদিন ৫ বার আল্লাহকে সিজদা করার জন্য মুয়াজ্জিন আহ্বান জানানোর পরেও আমরা অহঙ্কার ও আত্মগরিমায় বুদ হয়ে আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হই! আল্লাহতায়ালা বলেন, আর যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘তোমরা রহমান (আল্লাহ)-কে সিজদা কর, তখন তারা বলে, রহমান কী? তুমি আমাদেরকে আদেশ করলেই কি আমরা সিজদা করবো? আর এটা তাদের পলায়ণপরতাই বৃদ্ধি করে।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত নং-৬০)

সিজদাহ হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্যলাভের সব থেকে সহজ মাধ্যম। আর সিজদাও আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। সিজদাকারীকে আল্লাহতায়ালা ভালোবাসেন। হাদিসে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘বান্দা আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী হয়, যখন সিজদারত থাকে। অতএব তোমরা তখন অধিক দোয়া করতে থাকো।’ (মুসলিম, হাদিস নং-৪৮২) সিজদাকারীর চেহারায় আলাদা একধরনের নূর থাকে। হূদয়ে থাকে প্রশান্তি। সিজদাকারীর প্রতি সকলের হূদয়ে ভালোবাসা তৈরি হয়। কিয়ামতের মাঠেও সিজদাকারী থাকবেন সবার থেকে আলাদা। সবাই দেখেই চিনতে পারবেন, উনি অধিক সিজদাকারী।

নবী কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার যে কোনো উম্মতকে কিয়ামতের দিন আমি চিনে নিতে পারব। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, এত মানুষের মধ্যে আপনি তাদের কীভাবে চিনবেন? তিনি বলেন, তোমরা যদি কোনো আস্তাবলে প্রবেশ করো যেখানে নিছক কালো ঘোড়ার মধ্যে এমন সব ঘোড়াও থাকে, যেগুলোর হাত, পা ও মুখ ধবধবে সাদা, তবে কি তোমরা উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না? সাহাবিরা বললেন, হ্যাঁ, পারব। তিনি বলেন, ওই দিন সিজদার কারণে আমার উম্মতের চেহারা সাদা ধবধবে হবে, আর অজুর কারণে হাত-পা উজ্জ্বল সাদা হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-২৮৩৬)

একবার চিন্তার রুদ্ধদ্বার উন্মুখ করে ভাবা দরকার আমরা প্রতিনিয়ত কতগুলো সিজদা বাদ দিচ্ছি। আমাদের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হবে। যৌবন বয়সেই তৃপ্তিভরে সিজদা দেওয়া। যেন বৃদ্ধ বয়সের অপারগতা এখনি কেটে ওঠে। আল্লাহর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের ময়দানে শুধুমাত্র সাত শ্রেণির মানুষ আরশের নিচে ছায়া পাবে। তন্মধ্যে একটি প্রকার হচ্ছে যারা যৌবনে আল্লাহর ইবাদতে সময় অতিবাহিত করেছে। হে প্রিয় যুবক ভাই। আল্লাহর এই ওয়াদা থেকে কোন জিনিস তোমায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছে? কীসের নেশায় মাতাল হয়ে আল্লাহর সিজদা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছ? কবে তুমি বুঝবে। কখন তুমি ফিরবে? এসো ফিরে এসো। আল্লাহর কুদরতি পায়ে লুটে পড়। নিজের দোষগুলো স্বীকার করো। আল্লাহর রহম কামনা করো। ইরশাদ হয়েছে ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করো এবং ইবাদত করো।’ (সুরা নাজম, আয়াত-৬২)

লেখক : তরুণ প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads