• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
রাসুল (সা.)-এর বিদায় হজ ও ভাষণ

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

রাসুল (সা.)-এর বিদায় হজ ও ভাষণ

  • প্রকাশিত ১৪ জুলাই ২০২১

সাইফুল্লাহ ইবনে ইব্রাহিম

দশম হিজরি। জিলকদ মাসের পঁচিশ তারিখ। রোজ সোমবার। ঈসায়ী ৬৩২ সন। লক্ষাধিক সাহাবিকে সাথে নিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রওনা হন মক্কাভিমুখে। মদিনা থেকে প্রায় ছয় মাইল দূরে ‘যুল হুলাইফা’ নামক স্থানে এসে হজের ইহরাম বাঁধেন। ৪ জিলহজ রোজ শনিবার তাঁরা পবিত্র মক্কায় পৌঁছেন। লাখো সাহাবির কণ্ঠে ‘লাব্বাঈক আল্লাহুম্মা লাব্বাঈক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে পবিত্র কাবা প্রাঙ্গণ। যাঁরা দূরে থেকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন, কিন্তু ইতোপূর্বে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তারাও জীবনে একটিবারের জন্য হলেও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখার জন্য এবার মক্কায় হজের উদ্দেশে সমবেত হলেন। প্রায় দুই লক্ষ মুসলমানের এই বিশাল সমাবেশ দেখে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুব আনন্দিত হলেন।

ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক হজের যাবতীয় কার্যাবলি সম্পাদন শেষে, হজের দ্বিতীয় দিন নয়-ই জিলহজ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফাতের ময়দানে সমবেত লক্ষাধিক সাহাবির সামনে জাবালে রহমতে দাঁড়িয়ে খুৎবা দেন। এটিই ছিল হজ উপলক্ষে প্রিয়নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের শেষ ভাষণ। এটিই শেষনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেষ হজ। আর এটাকেই ‘বিদায় হজ’ আর এই ভাষণটিকে ‘বিদায় হজের ভাষণ’ বলা হয়ে থাকে। মুসলিম উম্মাহ তাঁর এই ঐতিহাসিক ভাষণকে কিয়ামত পর্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখবে।

বুখারি শরিফের ১৬২৩, ১৬২৬ ও ৬৩৬১ নম্বর হাদিসে ভাষণের খণ্ড খণ্ড বিভিন্ন অংশের উদ্ধৃতি আছে। সহিহ মুসলিম শরিফ-এর ৯৮ নম্বর হাদিসে এই ভাষণের বর্ণনা আছে। তিরমিযি শরিফের ১৬২৮, ২০৪৬ ও ২০৮৫ নম্বর হাদিসসমূহেও এই ভাষণটির বর্ণনা পাওয়া যায়। এই ভাষণটির দীর্ঘতম উদ্ধৃতি দিয়েছেন ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর সংকলিত হাদিস গ্রন্থ ‘মুসনাদ’-এর ১৯৭৭৮ নম্বর হাদিসে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের প্রায় শেষ লগ্নের ঐতিহাসিক এই ভাষণটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও হিকমতপূর্ণ। যার নিম্নোক্ত অংশটুকু অবশ্যই প্রতিটি মুসলমানের হূদয়-ফলকে খোদাই করে রাখার মতো।

ভাষণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমেই আল্লাহর প্রশংসা করেন। এরপর সমবেত সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমরা আমার কথা মনোযোগসহকারে শোনো। যাতে করে আমি তোমাদের জন্য দীনের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির বিবরণ দিতে পারি। জানি না, আগামী বছর আবার তোমাদের সাথে মিলিত হতে পারবো কিনা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মুসলমানদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু তোমাদের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত এমনই সম্মানিত; যেমন এইদিন (আরাফা) এইমাস (জিলহজ) এই শহর (মক্কা) সম্মানিত। সুতরাং তোমাদের যার কাছে মুসলমানদের যা আমানত গচ্ছিত আছে, তা আদায় করে দিতে হবে।

মনে রেখো, একদিন তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে হাজির হতে হবে। পৃথিবীতে তোমরা যা করছ, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে এগুলোর হিসাব চাইবেন। তোমাদের ক্রীতদাস-দাসীরাও আল্লাহ-র বান্দা। তাদের সাথে অন্যায় আচরণ করো না। তোমরা নিজেরা যা খাবে তাদেরও তা খেতে দিবে। নিজেরা যে কাপড় পরিধান করবে তাদেরও তা পরতে দিবে। কোনো ক্রীতদাস যদি নিজ যোগ্যতায় আমির হয়, তবে তাকে মান্য করবে। তখন বংশ মর্যাদার কথা তুলবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘হে লোকসকল! তোমাদের স্ত্রীদের তোমাদের ওপর কিছু অধিকার রয়েছে। ঠিক যেমন তাদের ওপর তোমাদেরও অধিকার রয়েছে। মনে রেখো, তোমরা সকল মুসলমান ভাই ভাই। কারো পক্ষে তার ভাইয়ের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ব্যতীত ভোগ করা বৈধ নয়। আমার পর তোমরা আবার কাফির হয়ে যেও না। একে অন্যের গর্দান উড়াতে (হত্যা করতে) যেও না। তোমরা এক ভাই অন্য ভাইয়ের সম্পদ আত্মসাৎ করো না। কখনো অন্যায় অবিচারে লিপ্ত হয়ো না সামান্যতম পাপ থেকেও নিজেকে বিরত রাখবে আর যারা আজ এখানে আসেনি তাদের নিকট আমার এ কথাগুলো পৌঁছে দিও। হয়তো তারাই এই উপদেশ বেশি মনে রাখবে। মানুষ তার নিজের কর্মের জন্য নিজেই দ্বায়ী থাকবে। একজনের দোষে অন্যকে দোষী করা চলবে না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। নিজধর্ম নিজে পালন করবে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর জোর করে তা চাপিয়ে দেবে না।”

চারটি কথা তিনি বিশেষভাবে সবাইকে স্মরণে রাখতে বলেন- ১. আল্লাহ ছাড়া ভিন্ন কারো উপাসনা করবে না। ২. অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করবে না। ৩. অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ করবে না। ৪. কারো ওপর জুলুম করবে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার পর আমি তোমাদের জন্য দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যতদিন তা আঁকড়ে ধরে থাকবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। ১. আল্লাহ বাণী অর্থাৎ পবিত্র কোরআনুল কারিম। ২. তাঁর প্রেরিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাদর্শ।’ নবীজি বলেন, ‘তোমাদের প্রতিপালক যেমন একজন, তোমাদের আদিপিতাও একজন। তোমরা সবাই আদম আলাইহিস সালামের সন্তান। আর মনে রেখো তিঁনি মাটি থেকে সৃষ্ট। তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানিত সেই, যে সর্বাধিক খোদাভীরু। কোনো আরবি কিংবা অনারবি খোদাভীতি ব্যতীত শ্রেষ্ঠ হতে পারে না।’

ভাষণশেষে নবীজির চেহারা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। উপস্থিত সকল সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দীনকে পরিপূর্ণ পৌঁছাতে পেরেছি?’ উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু আনহুম আজমাইন-এঁর  লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে সমস্বরে ধ্বনিত হলো, ‘হ্যাঁ, আপনি পেরেছেন!’

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হূদয় আঙিনাজুড়ে আনন্দের ঢেউ প্রবাহিত হয়ে গেল! তিনি আকাশের দিকে শাহাদাত আঙুল উচ্চ করে তিনবার বললেন, ‘আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন, আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন, আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।’ সেদিন সেখানেই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সর্বশেষ এই আয়াতটি অবতীর্ণ করেন, ‘আজ আমি তোমাদের দীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়িদাহ, আয়াত-০৩)

লেখক : শিক্ষার্থী, মাদরাসা কাসিমিয়্যাহ ময়মনসিংহ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads