• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

মানবজীবনে সময়ের গুরুত্ব

  • প্রকাশিত ২৮ অক্টোবর ২০২১

সাকের আহম্মেদ

 

সময় আমাদের জীবনের সবচেয়ে মহান ও এক অমূল্য সম্পদ। সফল মানুষেরা তাদের সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন এবং গভীর অধ্যবসায়ের মাধ্যমেই সফলতা লাভ করেন। আর যারা সময়ের অপব্যবহার করে কাজে-অকাজে সময় নষ্ট করেন এবং গভীর অধ্যবসায়ে মনোনিবেশ করতে পারেন না, দিনশেষে তাদেরকে ব্যর্থতা ও নিরাশার বোঝা বইতে হয় এবং দুঃখ ও পরিতাপের দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়। ছোটো থেকে ছোটো অথবা বড়ো যে কোনো বিষয়েই হোক, সফল হতে চাইলে তাকে সময়ানুবর্তিতার প্রতি পূর্ণ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। উদ্দিষ্ট বিষয়ে পর্যাপ্ত অধ্যবসায় এবং পরিকল্পিনাপূর্বক অনুশীলন করে যেতে হবে। শুধু স্বপ্ন দেখলে আর শত শত আশা নিয়ে বসে থাকলে হবে না, তা বাস্তবায়নেও প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, আপনার আশা কেউ পূরণ করে দেবে না, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেবে না। সুতরাং আপনাকেই তাঁর জন্য চেষ্টা করতে হবে।

 

সময়ের ব্যাপারে আরবীতে একটি কথা প্রচলিত আছে। তার অর্থটা এমন, ‘সময় হচ্ছে তরবারির ন্যায়, তুমি তাকে কাটতে না পারলে সে ঠিকই তোমাকে কেটে ফেলবে।’ এ প্রবাদের ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন নেই। মর্মার্থ শাব্দিক অর্থ হতেই বোধগম্য। তবে, একটু স্পষ্ট করে বলতে হলে এভাবে বলতে হবে, ‘সময়কে কেউ কাজে লাগালে যেভাবে সে উপকৃত ও লাভবান হয়, ঠিক উল্টোভাবে কেউ সময়ের অপব্যবহার ও অসদ্ব্যবহার করলে সে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যর্থ হয়। ‘সময়ই’ একজনের বেলায় আশীর্বাদ ও মঙ্গল বয়ে আনে, আবার দ্বিতীয়জনের বেলায় অভিশাপ ও পরিতাপ ছাড়া আর কিছুই রাখে না।’ এ কারণে সবসময় আমাদেরকে সময়ের ইতিবাচক ব্যবহারে মনোনিবেশ করতে হবে। নেতিবাচক ব্যবহারের ফলে সময়ই এক সময় আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে আসবে।

 

মানবজীবন ও ইসলামী জীবন দু-ক্ষেত্রেই সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন ও সদ্ব্যবহার করা হলে সে সময়কে সফলতার চাবিকাঠি বলা যায়। বিপরীতে এর অমূল্যায়ন করা হলে অথবা অসদ্ব্যবহার করা হলে সে সময় ব্যর্থতার প্রধান ও মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই ‘সময়’কে অনেক সময় বরফের সাথে তুলনা করা হয়৷ যেভাবে প্রকৃত সময়ে বরফকে কাজে না লাগানো হলে খানিক পরে তা গলে পানি হয়ে যায়, সেভাবে যথাসময়ে কোনো কাজ সম্পাদন না করা হলে সে ‘সময়’ও বরফের মতো হঠাৎ হারিয়ে যায়। বরফ গলে পানি রয়ে গেলেও এদিকে সময় ফুরিয়ে গেলে কেবল দুঃখ ও পরিতাপ ছাড়া কিছু অবশিষ্ট থাকে না। আমরা আমাদের দুটো চোখ তুলে চারপাশে একটু তাকালেই এ সফলতা-ব্যর্থতা ও আশা-নিরাশার ঢের উদাহরণ দেখতে পাব।

 

সভ্য-ভদ্র-উন্নত ও সুচিন্তার অধিকারী মানুষদেরকে কখনও মূর্খ বা অল্পশিক্ষিতদের মধ্যে পাওয়া যায় না। কারণ, প্রকৃত শিক্ষিত ও জ্ঞানী মানুষেরাই ভদ্র-সভ্য-উন্নত এবং সুচিন্তার অধিকারী হন। আর শিক্ষিত ও জ্ঞানী মানুষ মাত্রই জ্ঞানের সেবা করেন, সাহিত্যের সেবা করেন, সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন ও সদ্ব্যবহার করেন। এ কারণেই তাদেরকে সমাজ-দেশ এবং সবাই-ই সম্মান প্রদর্শন করেন। ইতিহাসের পাতায় পাতায় এরকম লোকেরা পরবর্তী প্রজন্মের স্মরণিকা ও উদাহরণ হয়ে চির-স্মরণীয় ও চির-অমর হয়ে থাকেন। যারা নিজেদেরকে প্রকৃত মানুষরূপে গঠন করতে চান, বড়ো হবার স্বপ্ন দেখেন এবং আগামীর নেতৃত্বভার নিজেদের কাঁধে নিতে চান, তাদেরকে অবশ্যই সময়ের যথাযথ মূল্যায়ন ও সদ্ব্যবহার করতে হবে এবং পূর্ণ অধ্যবসায় ও অনুশীলনের সাথে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে হবে।

 

ইসলামী জীবনে সময়ের গুরুত্ব : মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সময় আমাদের ওপর প্রদত্ত এক অশেষ নেয়ামত; বরং আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে প্রদত্ত সব নেয়ামতের মাঝে সময় সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। একটি মহা আমানতও বটে। কারণ, মৃত্যুর পর আমাদেরকে এ আমানতের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। পইপই হিশেব দিতে হবে কীভাবে পুরো জীবন কাটিয়েছি।  কোরআন কারিম এবং হাদিস শরিফে সময়ের ব্যাপারে খুব গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও আমাদের পূর্বেকার মুসলিম মনীষীদের জীবনচরিত পড়লে সময়ের প্রতি তাঁদের যে অশেষ মূল্যায়ন ছিল, তা সহজেই অনুমান করা যায়।  কোরআনের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই আল্লাহতায়ালা কোরআনের অসংখ্য সুরায় সময়ের গুরুত্ব প্রকাশার্থে ‘সময়ে’র শপথ করেছেন। কখনো সকালের, কখনো দুপুরের, কখনো রাতের, আবার কখনো যুগের। সুরা ফাজরে বলেছেন : সকাল এবং দশ রাতের শপথ। সুরা লাইলে বলেছেন : রাতের শপথ যখন তা সবকিছুকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে এবং দিনের শপথ যখন তা উজ্জ্বল হয়। সুরা দুহায় বলেছেন : পূর্বাহ্নের শপথ এবং রাতের শপথ যখন তার অন্ধকার তীব্র হয়। সুরা আসরে বলেছেন : সময়ের শপথ, নিশ্চয়ই সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। এগুলো ছাড়াও  কোরআনের যেসব স্থানে মহান আল্লাহতায়ালা সময়ের শপথ করেছেন, তা পরকথার গুরুত্ব বোঝানের জন্য এবং দৃঢ়তা প্রকাশের জন্য। মহান আল্লাহতায়ালার অধিক পরিমাণে সময়ের শপথ করা থেকে বোঝা যায়, আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস হচ্ছে সময়। হজরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামতের দিন পাঁচটি উত্তর দেওয়ার আগে আদম সন্তানের পদদ্বয় এক কদমও এগোবে না। তাকে হায়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, কীভাবে তা কাটিয়েছে। যৌবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, তা কোথায় ক্ষয় করেছে। সম্পদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে, কোথা থেকে অর্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করেছে। আর জ্ঞাত ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে।’ (তিরমিযি, মিশকাতুল মাসাবিহ-৫১৯৭, বায়হাকি-১৬৪৮)

 

এ হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি, সময় মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ হতে আমাদের ওপর এক আমানত। মৃত্যুর পর আমাদেরকে এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার দরবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব দিতে হবে। তাই এর যাচ্ছেতাই ব্যবহার ও অপচয় কিছুতেই বৈধ হবে না। এক লোককে উপদেশ দিতে গিয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পাঁচটি জিনিসকে তুমি পাঁচটি সময়ের আগে কাজে লাগিও। বার্ধক্যে আসার আগে যৌবনকে। অসুস্থতা আসার আগে সুস্থতাকে। দারিদ্র্য আসার আগে সচ্ছলতাকে। ব্যস্ততা আসার আগে অবসর সময়কে। মৃত্যুর চলে আসার আগে জীবনকে।’ (বায়হাকি-৮০৯, শরহে সুন্নাহ-৪০২১, মিশকাতুল মাসাবিহ-৫১৭৪, আত তারগিব ওয়াত তারহিব- ৩৩৫৫) পূর্বোক্ত হাদিসের মতো এই হাদিসেরও মূল ভাষ্য এক। আর তা হলো, সময়ের যথাযথ গুরুত্ব ও মূল্য অবশ্যই সবাইকে করতে হবে৷ খানিক সময়ও অহেতুক নষ্ট করা যাবে না। নইলে কিয়ামতের দিন এই সময়ের জন্য আমাদেরকে আফসোস করতে হবে। যখন আফসোস করে আর কোনো লাভ হবে না।

আমাদের সালাফ এবং আকাবির আলিমগণ সময়ের যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করতেন এবং মূল্যায়ন করতেন। কখনো অপ্রয়োজনে সামান্য সময়ও নষ্ট করতেন না। সবসময় নামাজ, ইলম অর্জন অথবা দারসে লেগে থাকতেন।  এরপরও চলে যাওয়া সামন্য সময়ের জন্যও তাঁরা খুব বেশি আফসোস করতেন। আবু বকর ইবনুল খায়্যাতের জীবনীতে বলা হয়, ‘তিনি শুধু সবসময় পড়তেন এমন না। পথে হাঁটার সময়ও পড়তেন। যার ফলে অনেক সময় গর্তে পড়ে যেতেন অথবা কোনো প্রাণী তাঁকে আঘাত করত।’ আবু হিলাল আসকারী থেকে আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহিমাহুল্লাহ তার কীমাতুয যামান ইনদাল উলামা বইয়ে এ ঘটনা নকল করেছেন।

 

তাই অবসর সময় পেলে কিছুতেই তা নষ্ট করা যাবে না। অবারিত সুযোগ জ্ঞান করে কাজে লাগাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সাহিত্যচর্চা, লেখালেখি ও বক্তব্যের অনুশীলন সবচেয়ে উপযুক্ত ও মুনাসিব বিষয় মনে করি আমি। কারণ, এসব ছাড়া আমরা আমাদের দীনের দাওয়াত মানুষদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। আবার সবার মাধ্যমে সব কিছু হয় না। কেউ লেখালেখির ময়দানে অন্যদের রাহবার হবেন, বাতিলের বিরুদ্ধে শক্ত ও খোলা হাতে লিখে যাবেন। কেউ বক্তব্যের ক্ষেত্রে সবার পথপ্রদর্শক হবেন, যার শিহরণ তোলা ও ঈমানী  বক্তব্যে বাতিলের মসনদ কেঁপে উঠবে। আর এগুলো দাওয়াতের প্রধান কয়েকটি মাধ্যম। সবার ভেতরেই এ যোগ্যতাগুলো থাকা উচিত। দাওয়াতের ক্ষেত্র শক্তিশালী না হলে ইসলামের আলো ক্রমান্বয়ে নিষ্প্রভ হয়ে পড়বে। এসব ছাড়াও আমাদের চারপাশে সৃজনশীল অনেক কিছু শেখার আছে। সেসব শিখে নিজেদের মূল্যবান জীবনের মূল্যায়ন করতে পারি। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে জীবনের মূল্যায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, জামেয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads