• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামে দাঈর দায় ও দায়িত্ব

  • প্রকাশিত ২০ ডিসেম্বর ২০২১

মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা

 

ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী ইসলাম কোনো নতুন ধর্ম নয়, বরং সৃষ্টির শুরু থেকেই ইসলামের উৎপত্তি। আদম (আ.)  ছিলেন এই পৃথিবীর প্রথম মানব এবং ইসলামের প্রথম নবী। আর শেষ নবী হলেন হজরত  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিদায়ের মধ্য দিয়ে নবুয়তের অবসান ঘটে। নবীর অবসানে ওলামায়ে কেরামকে নবীর উত্তরসূরী করা হয়েছে। তাদের ওপর অর্পিত হয়েছে মহান দায়িত্ব। যুগে যুগে আলেমগণ তাদের দায়িত্ব পালনে ব্রত আছেন। তবে আলেমদের বড় একটা অংশ নিজেদের আলেম বলে দাবি করলেও ইলমের ঘাটতিসহ নানাবিধ ঘাটতি তাদের রয়েছে। যুগে যুগে তারাই ইসলামের খেদমতের নামে দীনের ক্ষতি করে আসছে। ইসলাম কি চায়, তা না বুঝেই নিজের মত করে ধর্মের ব্যাখ্যা করে যাচ্ছেন। বর্তমান সময়ে আলেমদের সবচেয়ে বড় ফিতনা হলো গণহারে নিজেদের দাঈ ইলাল্লাহ বলে দাবি করা।

কেউ কেউ বলে থাকেন প্রতিটি মুসলিমই দাঈ ইলাল্লাহ। ফলে বহুলাংশে ইসলাম বিকৃত করার দায়ে দায়ী হচ্ছেন। যে দায় তারা অস্বীকার করতে পারেন না। তারা জোর দিয়ে বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আমার একটি বাণী হলেও প্রচার করো’। আলোচ্য হাদিসটি সহিহ। হাদিসের আমল অত্যাবশ্যক। কিন্তু এই হাদিসের ভিত্তি মূল  কোরআনের সুরা সফের আয়াতটি তারা বলেন না। আল কোরআনের সুরা সফের ২ ও ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বলো, যা নিজেরা করো না? আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অপছন্দনীয় কাজ যে, তোমরা এমন কথা বলো যা করো না।’

সুতরাং প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের এমন কথা বলা উচিত, যা তারা নিজেরা পালন করে। কিন্তু অনেক আলেমই নিজে আমল না করে মানুষকে আমলের দাওয়াত দিচ্ছে। আসলে উক্ত দাওয়াত ইসলাম ও মানুষের জন্য অকল্যাণকর তো বটেই পাশাপাশি দাওয়াতদানকারীর জন্য ক্ষতিকর বটে। কেননা, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে নেক আমল না করে অন্যকে তা করতে উপদেশদাতার জন্য  শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, হজরত উসামা বিন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, কেয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে এনে দোজখে নিক্ষেপ করা হবে। এর ফলে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে আসবে। সে এটা নিয়ে বার বার চক্কর দিতে থাকবে, যেভাবে গাধা চক্রের মধ্যে বার বার ঘুরতে থাকে। দোজখিরা তার চারপাশে জড়ো হয়ে জিজ্ঞাসা করবে, হে (অমুক) লোক! তোমার এ অবস্থা কেন? তুমি কি লোকদেরকে সৎকাজের আদেশ দিতে না এবং অসৎকাজ থেকে বিরত থাকার কথা বলতে না? জবাবে সে বলবে, ‘হ্যাঁ’ আমি সৎকাজের আদেশ দিতাম কিন্তু আমি নিজে তা পালন করতাম না। আমি অন্যদেরকে খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলতাম কিন্তু আমি নিজে তা মানতাম না।’ (বুখারি ও মুসলিম)

বর্তমানে চলছে দাওয়াতি ব্যবসা। মাহফিল, ওয়াজ, জলসা, সম্মেলনসহ ইত্যাদি নামে সে ব্যবসা প্রসার ঘটছে। কণ্ঠ ভালোতো, ওয়াজের মাঠে দাওয়াতের ব্যবসা ভালো। রম্য, গুজব, গান, ডং ও খোস গল্পে জমে উঠে ওয়াজের মাঠ। ভণ্ড দালাল হুজুরদের কারণে মাহফিলের মতো পুণ্য কাজটাও আজ আমাদেরকে বিষিয়ে তুলছে। হাক্কানী ওলামায়ে কেরামও আজ অনেকাংশে কথিত মাহফিল জলসার বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য পেশ করছেন। ওয়াজের মাঠগুলো আবার রাজনৈতিক মঞ্চেও পরিণত হচ্ছে। মাঝে-মধ্যে মহিলাদেরকেও অতিথি হিসেবে ওয়াজের মঞ্চে দেখা যায়। আবার কিছু হুজুর ওয়াজের মাঠে ধর্মের নামে রাজনীতি করছে। তারা সিয়াসাতুল ইসলামিয়া নিয়ে দু-কলম পড়াশোনা না করলেও হাবভাবে ধর্মীয় রাজনীতি বিষয়ে জ্ঞানী ভাব তুলে ধরতে ভুল করেন না। না জেনে না বুঝেই কি সব বক্তব্য দেয়, যা আসলেই বোধগম্য নয়। অনেক সময় সেসব বক্তব্য হাস্যকরে পরিণত হয়। আফসোস, ইসলাম কি বলে আর আলেম কি করছে?

আল্লাহ পথের দাঈর প্রথম সম্বল হবে আল্লাহর কিতাব আল কোরআন ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহিহ ও গ্রহণযোগ্য হাদিসের ইলমের দ্বারা পাথেয় সংগ্রহ করা। ইলম ব্যতীত দাওয়াত অজ্ঞতাপূর্ণ দাওয়াত। আর অজ্ঞভাবে দাওয়াতের সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি। কেননা একজন দাঈ নিজে একজন পথপ্রদর্শক ও উপদেশদাতা। আর সে দাঈ যদি অজ্ঞ হয় তবে সে নিজে পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে। তার অজ্ঞতা দুটি অজ্ঞতাকে শামিল করে। আর যে অজ্ঞতা দুটি অজ্ঞতাকে শামিল করে তা সাধারণ অজ্ঞতার চেয়ে মারাত্মক ও ক্ষতিকর। কেননা, সাধারণ অজ্ঞতা ব্যক্তিকে কথা বলা থেকে বিরত রাখে, তবে শিক্ষার মাধ্যমে এ অজ্ঞতা দূরীভূত হয়। কিন্তু জাহলে মুরাক্কাব তথা না জেনে জানার ভান করাই হচ্ছে মারাত্মক ক্ষতিকর। কেননা এ ধরনের অজ্ঞরা কখনো চুপ থাকে না, বরং না জেনেও কথা বলতে থাকে। তখন তারা আলোকিত করার চেয়ে ধ্বংসই বেশি করে।

দাঈদের বিশেষ গুণ থাকা আবশ্যক।

প্রথমত : যে দিকে দাওয়াত দিবে সে ব্যাপারে  শরয়ি জ্ঞান থাকতে হবে। কেননা, সে হয়ত কোনো কাজ ফরজ ভেবে সেদিকে আহ্বান করবে কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তা ফরজ নয়। ফলে সে আল্লাহর বান্দাহর ওপর অনাবশ্যকীয় জিনিসকে অত্যাবশ্যকীয় করে দিবে। আবার কখনো সে হারাম ভেবে তা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান করবে, অথচ তা আল্লাহর দীনে হারাম নয়, ফলে সে আল্লাহর হালালকৃত জিনিসকে হারাম করল।

দ্বিতীয়ত : দাওয়াতের অবস্থা সম্পর্কে দূরদর্শী হওয়া। দাঈ যাদেরকে দাওয়াত দিবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানবে। তাদের ইলমী অবস্থা কি সে সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত হবে। তাদের তর্ক-বিতর্ক করার দক্ষতা কি তাও জানবে যাতে প্রস্তুতি নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা ও বিতর্ক করতে হবে। কেননা যখন এ ধরনের বিতর্কে লিপ্ত হবে তখন সত্যের বিজয়ের জন্য শক্তিশালী হতে হবে। সহিহ বুখারিতে বর্ণিত আছে-উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মামলা মুকাদ্দমা নিয়ে আমার কাছে আস এবং তোমাদের একজন অপরজন অপেক্ষা অধিক বাকপটূ হয়ে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে স্বীয় দাবি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আমি কথা শুনে তার অনুকূলে রায় প্রদান করি।’ এ হাদিস দ্বারা বুঝা যায় যে, বাদী মিথ্যাবাদী হলেও কখনো কখনো অন্যের চেয়ে অধিক বাকপটূ হয়ে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে স্বীয় দাবি প্রতিষ্ঠা চেষ্টা করে, ফলে বিচারক তার কথা শুনে তার অনুকূলে ফয়সালা দিয়ে থাকে। তাই যাদেরকে দাওয়াত দিবে তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানা আবশ্যক।

তৃতীয়ত : দাওয়াতের পদ্ধতি সম্পর্কে দূরদর্শী হওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেছেন,‘তুমি তোমার  রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করো এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক করো।’ (সুরা আন-নাহাল, আয়াত-১২৫) কিছু মানুষ খারাপ কাজ দেখেই তা বন্ধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু ভবিষ্যতে তার ও তার মতো অন্যান্য হকের প্রতি দাঈদের ওপর কি ফলাফল বর্তাবে তা নিয়ে চিন্তা করে না। অনেকাংশে মন্দ কাজ দেখা মাত্রই তা বন্ধ করতে উঠে পড়ে লাগে এবং শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে পারে না।  এজন্যই দাঈদের উচিত কোনো আন্দোলনে নামার আগে তার ফলাফল কি হবে তা খেয়াল করা ও সে বিষয়ে অনুমান করা। সে সময় হয়ত তার প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে যা ইচ্ছা তা করল, কিন্তু পরবর্তীতে দাঈ ও অন্যদের প্রভাবের কারণে চিরতরে কাজটি নির্বাপিত হয়ে যেতে পারে। এটা হয়ত শিগগিরই বাস্তবায়িত হবে। এজন্যই দাঈদেরকে  হিকমত ও ধীরস্থিরতার সাথে কাজ করতে হবে। যদিও এতে কিছুটা বিলম্ব হয়, তথাপি শেষ পরিণাম হবে আল্লাহর ইচ্ছায় সুদূরপ্রসারী।

কোরআন ও সুন্নাহের সহিহ ইলমের সাহায্যে দাঈর পাথেয় সংগ্রহ করা জরুরি। কেননা আপনার পথ জানা না থাকলে কীভাবে আল্লাহর পথে ডাকবেন? আপনি শরিয়ত সম্পর্কে কিছু জানেন না, তাহলে কিভাবে আপনি দাঈ ইলাল্লাহ হবেন? তাই মানুষের যদি ইলম না থাকে তবে সর্বপ্রথম তাকে শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত, তারপরে আল্লাহর পথে মানুষকে ডাকা উচিত। নচেৎ দীনের দাঈ মূর্খতার কারণে দায়ীতে রূপান্তরিত হবেন। মহান প্রভু দীনের দাঈদেরকে সঠিক জ্ঞান আহরণ ও তা নিজ জীবনে ধারণপূর্বক দাওয়াতদানের তাওফিক দান করুন। আমীন।

 

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

toharafat1998@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads