• শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

প্রতিবন্ধীকে অবজ্ঞা নয়

  • প্রকাশিত ২০ ডিসেম্বর ২০২১

মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম

 

আমিও পৃথিবীতে জন্মেছি মানুষ হয়ে, অন্যদের মতো। আমারো আছে পিতামাতার পরিচয়। আছে আত্মীয়-স্বজন। আমিও বড় হয়েছি ধীরে ধীরে অন্যদের মতোই। শিখেছি কথাবার্তা। জেনেছি পৃথিবীকে। আস্তে আস্তে চিনতে পেরেছি নিজেকে যে, আমি স্বাভাবিক মানুষের মতো না। অন্যদের থেকে কিছুটা আলাদা। তবে আমার মধ্যেও আছে প্রেম, ভালোবাসা, দেশপ্রেম। আমার চিন্তায় আমিও স্বপ্ন দেখি যে, আমিও হবো আলেম, লেখক, গবেষক, চিন্তক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সমাজসেবক, কিংবা আদর্শ শিক্ষক বা শিল্পী।

 

কিন্তু কেউ যখন আমাকে দেখে, কেন যেন তারা অবহেলা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকায়। মাকে বলি, মা! মানুষ আমাকে এমন চোখে দেখে কেন? আমি কি অপরাধ করেছি! মা বিষণ্নমনা হয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। মা আমাকে শুনায় সান্ত্বনার বাণী। আমার নেই কোন বন্ধু-বান্ধব। নেই খেলার সঙ্গী। আমার সমবয়সী ও সহপাঠীরাও আমাকে নিয়ে করে কিছুটা হাসি তামাশা। এখন আমি বুঝতে পেরেছি, কি তার কারণ! আমার একটি পা যে অন্যদের মতো না। আমি সমাজের অন্য দশজনের মতো না। কিছুটা আলাদা। কিছুটা ব্যতিক্রম। আমি একজন প্রতিবন্ধী।

 

প্রতিবন্ধী, অক্ষম মানুষেরা সর্বদা সমাজের উচ্চবিলাসী মানুষের দ্বারা অবহেলিত। প্রতিবন্ধীরা ভিন্ন কোনো জাতি না, তারা আমাদের মতোই মানুষ। তারা আমাদেরই আপনজন। তাদেরও আছে মান-সম্মান মর্যাদা ও মনুষ্যত্ব। তারাও বাঁচতে চায় সম্মান ও অধিকার নিয়ে। আছে তাদের বাঁচার অধিকার। তাদেরতো কোন অপরাধ নেই। সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো হাত নেই। মহান আল্লাহ পবিত্র  কোরআনে বলেন, তিনি যাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই সৃষ্টি করেন। (সুরা আলা,আয়াত-৮) তাহলে কেন আমরা তাদেরকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করি! তাছাড়া আমরাও তো যে কোনো সময় যে কোনো দুর্ঘটনায় পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী হয়ে যেতে পারি। সে কথা কি কখনো খতিয়ে দেখেছি! তাই প্রতিবন্ধীদের প্রতি আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত। রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এ ব্যপারে নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ (প্রতিবন্ধীদের) খোঁজখবর নাও, বন্দিদেরকে মুক্ত করে দাও। (বুখারি শরীফ)

 

বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার ও সুরক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্লামেন্টে আইন পাশ করে। কিন্তু আইন থাকলেও আজ অবধিও তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। দিকে দিকে  শোনা যায় অসহায় প্রতিবন্ধীদের আহাজারি। কিছুদিন আগেও পত্রিকার পাতায় এসেছিল- এক প্রতিবন্ধী ভাড়া দিতে না পারায় বাস থেকে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাই বাংলাদেশ সরকার ও ১৮কোটি মানুষের কাছে আমার নিবেদন, আসুন আমরা প্রতিবন্ধীদের ন্যায্য অধিকারটুকু যথাযথভাবে দেই। ভালোবাসা ও সহমর্মিতার দ্বারা তাদেরকে কাছে টেনে নেই। কারণ, এমনিতেই তারা অনেক দুঃখ, কষ্ট ও যাতনা নিয়ে বেঁচে থাকে। আর প্রতিবন্ধী মানেই প্রতিভাবন্ধী নয়। তাদের প্রতিভা ও মেধাকে কাজে লাগাতে পারলে, তারাও হয়ে উঠবে দেশের মহা-সম্পদ।

 

ইসলাম দিয়েছে প্রতিবন্ধীদেরকে অগ্রাধিকার। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃদু বাকপ্রতিবন্ধী সাহাবী বেলাল (রা.)কে মসজিদে নববীর সর্বপ্রথম মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করে ছিলেন। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সাহাবি উম্মে মাকতুম (রা.)কে দুই দুবার মদিনার অস্থায়ী শাসক নিয়োগ দিয়েছিলেন। একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক প্রতিবন্ধীকে অগ্রাধিকার না দেওয়ায় আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ করে নবীজিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

 

একদা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কার কোরাইশ নেতাদের সঙ্গে আলাপরত ছিলেন, ইতিমধ্যেই অন্ধ সাহাবি উম্মে মাকতুম (রা.) এসে বললেন; ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমাকে দীন শিক্ষা দিন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছুটা বিরক্ত অনুভব করলেন। এরশাদ হয়েছে, তিনি ভ্রুকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন, কারণ তার কাছে এক অন্ধ আগমন করলো। আপনি কি জানেন সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো, অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশ তার উপকার হতো। (সুরা আবাসা,আয়াত : ১-৪]

 

পরবর্তীতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনই তাকে দেখতেন, বলতেন স্বাগত তাকে যার জন্য আমার প্রভু আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন। আল্লাহ স্বয়ং নবীজির উপর যে কারণে অসন্তুষ্ট হয়েছেন, তা যদি আমরা করি, অর্থাৎ প্রতিবন্ধীদেরকে অবহেলা, অবজ্ঞা করি তাহলে আমাদের অবস্থা কি হতে পারে! তাই আসুন প্রতিবন্ধীদেরকে আর অবহেলা অবজ্ঞা নয়, তাদের প্রতি ভালোবাসা, সাহায্য-সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়াই। আন্তরিকতা ও ভালবাসার দ্বারা তাদের দুঃখ কষ্টগুলো মুছে দেই। এটাই হোক আমাদের অঙ্গিকার।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়াতুল উস্তায শহিদুল্লাহ ফজলুল বারী রহ., মুহাম্মদপুর, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads