• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯
এপ্রিল ফুল সমাচার

সংগৃহীত ছবি

বিদেশ

এপ্রিল ফুল সমাচার

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০১ এপ্রিল ২০২১

এপ্রিল মাসের প্রথম দিন বিশেষভাবে উদযাপনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। আধুনিক বিশ্বে ‘এপ্রিল ফুল’ পালন যেমন সব দেশে একইভাবে হয় না, তেমনি এই উৎসবের উৎস বা ইতিহাস নিয়েও গবেষক-লেখকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। তবে প্রাচীন পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপে এমন একটি হাস্য-কৌতুকের উৎসব পালনের রীতি বরাবরই ছিল।

এপ্রিল ফুল সম্পর্কে এই উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে ভুল ইতিহাস প্রচলিত। ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল স্পেনের মুসলমানদের মসজিদে অবরুদ্ধ করে ধোঁকা দিয়ে পুড়িয়ে মারেন রাজা ফার্দিনান্দ, তার সঙ্গে ছিলেন রানি ইসাবেলা। ধারণাটি বেশিমাত্রায় প্রচলিত। কিন্তু ইতিহাস বলে, ওই ঘটনার বহু আগে থেকেই ঐতিহাসিকভাবে ‘এপ্রিল ফুল’ পালিত হতো। 

এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা থেকে জানা যায়, এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি মূলত রোমান উৎসব হিলারিয়া থেকে, যা চলত ২৫ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত। তবে দিনটি পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্নভাবে উৎসবের দিন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। ইরানে পার্সি ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষের ১৩তম দিনে আনন্দ-মজা করা হয়। এদিন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১ এপ্রিল বা ২ এপ্রিল।

এপ্রিল ফুলের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনী, ১৫৬৪ সালে ফ্রান্সে নতুন ক্যালেন্ডার চালু করাকে কেন্দ্র করে এপ্রিল ফুল ডে’র সূচনা হয়। ওই ক্যালেন্ডারে ১ এপ্রিলের পরিবর্তে ১ জানুয়ারিকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে গণনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে কিছু লোক তার বিরোধিতা করেন। তারা এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন, ২৫ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত তারা আগের মতোই নববর্ষ উদ্যাপন করবেন। কিন্তু যারা পরিবর্তন গ্রহণ করেছিলেন, তারা তাদের সঙ্গে মজা করতে শুরু করলেন। অন্য একটি মতে, ফ্রান্সে পয়সন দ্য এভ্রিল (ঢ়ড়রংংড়হ ফ’ধাৎরষ) উদ্যাপিত হয় এবং এটা মাছের সঙ্গে সম্পর্কিত। এপ্রিলের শুরুর দিকে ডিম ফুটে মাছের পোনা বের হয়। এই মাছের পোনাগুলোকে সহজে বোকা বানিয়ে ধরা যায়। সে জন্য তারা ১ এপ্রিল উদ্যাপন করে পয়সন দ্য এভ্রিল অর্থাৎ এপ্রিলের মাছ। সেদিন বাচ্চারা অন্য বাচ্চাদের পিঠে কাগজের মাছ (চধঢ়বৎ ঋরংয) ঝুলিয়ে দেয় তাদের অজান্তে। যখন অন্যরা দেখে, তখন পয়সন দ্য এভ্রিল (চড়রংংড়হ ফ’আৎরষ) বা এপ্রিল ফিশ বলে চিৎকার করে। কবি চসারের ‘ক্যান্টারবারি টেইলস’ (১৩৯২) বইয়ের ‘নানস প্রিস্টস টেইল’-এ এদিনের কথা খুঁজে পাওয়া যায়।

হল্যান্ডের ইতিহাস অনুযায়ী, ১৫৭২ সালের ১ এপ্রিল হল্যান্ডের ডেন ব্রিএল শহরটাকে লর্ড আল্ভার স্প্যানিশ শাসন থেকে মুক্ত করে ডাচ বিদ্রোহীরা। এদিন তারা লর্ড আল্ভাকে পুরো বোকা বানিয়ে ছাড়েন। পয়লা এপ্রিলে আল্ভার বোকামিকে স্মরণ করে এপ্রিল ফুল উদ্যাপন করা হয়। এই এপ্রিল ফুল ঘটনার পর অনেক জায়গায় বিদ্রোহীরা সোচ্চার হয় আর স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় হল্যান্ড।

হিলারিয়া ও বোকাদের ভোজ : প্রাচীন রোমে ‘হিলারিয়া উৎসব’ এবং ‘ফিস্ট অব ফুলস’ বা ‘বোকাদের ভোজ’ উৎসবের রীতিকে আধুনিক এপ্রিল ফুলের অন্যতম পূর্বসূরি বলে মনে করা হয়। রোমান ‘হিলারিয়া’ শব্দটি আধুনিক ইংরেজিতে ‘হিলারিয়াস’ শব্দের কাছাকাছি, যা খুবই হাস্যরসময় বা কৌতুকপূর্ণ অবস্থা বোঝায়। মার্চ মাসের ২৫ তারিখে পালিত হিলারিয়া উৎসবটি রোমানরা গ্রহণ করেছিল একটি গ্রিক উৎসবের রীতি থেকে। গ্রিস ও রোমের প্রাচীন ধর্মীয় ও সামাজিক আচারের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল এ উৎসবটি।

‘বোকাদের ভোজ’ ইউরোপের মধ্যযুগের বহুল জনপ্রিয় একটি উৎসব। আদিতে ২৮ ডিসেম্বর পালিত এ উৎসবের রীতি এখনো স্প্যানিশ ভাষাভাষী অনেক দেশেই জনপ্রিয়। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, স্পেন, ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে এটি তুমুল জনপ্রিয় ছিল।

পারস্যের সিজদাহ বে-দার : পারস্য নববর্ষ নওরোজের ১৩তম দিনে হাস্য-কৌতুক উদ্যাপনের রীতিই জানা ইতিহাসে এমন সবচেয়ে প্রাচীন উৎসবের দৃষ্টান্ত। ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বা এখন থেকে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। ইরানি নববর্ষের ১৩তম দিন সাধারণত এপ্রিলের ১ বা ২ তারিখ পড়ে। এদিনটিকে পারসিকরা বলত ‘সিজদাহ বে-দার’, যার অর্থ অনেকটা ‘১৩তম দিনে বাড়ির বাইরে যাওয়া’। ইরাক, আজারবাইজান, আর্মেনিয়াসহ মধ্য এশিয়ার অনেক দেশেই এখনো এই উৎসব পালিত হয়।

বাইবেলের কাহিনী : বাইবেলের দুটো কাহিনীতে এপ্রিল ফুলের উৎস আছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ। এর একটিতে বলা হয়, নুহ (আ.) যেদিন নৌকা থেকে একটা ঘুঘুকে কোথাও ডাঙা আছে কি না তা দেখতে পাঠিয়েছিলেন, সেদিনটি ছিল পয়লা এপ্রিল। আর দ্বিতীয়টি হলো যিশুকে বিচারক পিলাত থেকে বিচারক হেরোডের আদালতে পাঠানোর দিনটিও ছিল পয়লা এপ্রিল। বিচারক পিলাত তার কাছে পাঠানোর পর বিচারক হেরোড যিশুকে পুনরায় পিলাতের কাছে যেতে বলেন বিচারের জন্য। এভাবে যিশুকে বোকা বানানোর এই বিষয়টাকে এপ্রিল ফুলের উৎস হিসেবে মনে করেন কেউ কেউ। আর এই ‘পিলাতের কাছ থেকে হেরোডের কাছে পাঠানো’ বোকা বানানো বোঝাতে রীতিমতো প্রবাদবাক্য হিসেবে ব্যবহূত হয়।

চসারের ক্যান্টারবারি টেলস : প্রখ্যাত সাহিত্যিক জিওফ্রে চসারের ‘ক্যান্টারবারি টেলস’ প্রকাশিত হয় ১৩৯২ সালে। এতে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় রিচার্ডের সঙ্গে অ্যান অব বোহেমিয়ার বাগদানের বার্ষিকীর দিনটি বোঝাতে চসার একটি প্রতীকী বাক্য লেখেন, যেখানে দিনটিকে ‘মার্চের ৩২ তারিখ’ বা এপ্রিলের প্রথম দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এই কাহিনীতে ওইদিন এক ধূর্ত শেয়ালের একটি মোরগকে বোকা বানানোর গল্প রয়েছে। এই বোকা বানানোর সঙ্গেই এপ্রিলের ১ তারিখ বা এপ্রিল ফুলের কাহিনী জড়িয়ে গেছে।

পরবর্তীসময়ে ফরাসি, ফ্লেমিশ এবং ব্রিটিশ কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় এপ্রিল ফুলের কথা উঠে আসে। মধ্যযুগের ইউরোপে বিভিন্ন দেশে এই উৎসব নানা স্থানে নানা রীতিতে পালিত হতো। ১৬৯৮ সালের ১ এপ্রিল বহু মানুষকে বোকা বানিয়ে টাওয়ার অব লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ব্রিটেনে এপ্রিল ফুলের একটা বড় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। নতুন শতাব্দীর শুরুতে ১৭০০ সালের পয়লা এপ্রিল ইংল্যান্ডে মহাসমারোহে এপ্রিল ফুল উদ্যাপন শুরু হয় এবং তখন থেকেই দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে বলে মনে করেন অনেকে।

জুলিয়ান ও গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জি : ‘এপ্রিল ফল’ নামটি এবং এ দিবসটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আরেকটি তত্ত্ব হচ্ছে ইউরোপে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের প্রবর্তিত বর্ষপঞ্জি জুলিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে পরিচিত। ১৬ শতকের প্রায় শেষভাগ পর্যন্ত ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই এই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হতো। পোপ তৃতীয় গ্রেগোরি জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি সংস্কার করেন এবং নতুন নিয়মটি তার নামেই প্রবর্তিত হয় গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে।

এপ্রিল ফুলের নানা আচার : যুক্তরাজ্যে এপ্রিলের প্রথম দিনে কৌতুক করে যাকে বোকা বানানো হয় তার উদ্দেশে চিৎকার করে ‘এপ্রিল ফুল’ বা ‘এপ্রিলের বোকা’ কথাটি বলাই রীতি। স্কটল্যান্ডে ঐতিহ্যগতভাবে দিনটিকে ‘হান্ট দ্য গাওক ডে’ হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। ‘গাওক’ বলতে বোঝায় বোকা কোকিল বা বোকা ব্যক্তি। স্কটিশ রীতিতে এদিন ‘কোনো বিষয়ে সাহায্য চেয়ে’ কাউকে একটা মুখবন্ধ খাম বা পিন আঁটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে অন্য একজনের কাছে পৌঁছে দিতে বলা হয়। ফ্রান্স,  সুইজারল্যান্ড ও কানাডার ফরাসিভাষী এলাকায় ‘এপ্রিল ফুল’-এর ফরাসি সংস্করণ হলো ‘এপ্রিলের মাছ’। বেলজিয়ামেও এই রীতি প্রচলিত।

ইতালিতেও এদিনে কৌতুক করে হাস্যাস্পদে পরিণত করা ব্যক্তিকে ‘এপ্রিলের মাছ’ বলা হয়ে থাকে। বেলজিয়াম এবং পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চলে এদিন শিশুরা অভিভাবক এবং শিক্ষকদের দরজার বাইরে আটকে রাখে এবং ওইদিন সন্ধ্যায় বা পরদিন উপহার নিয়ে আসার শর্তে দরজা খুলে দেয়। পোল্যান্ডে এদিনটিতে ব্যাপক হাস্যরসে মেতে থাকে মানুষজন। নানারকমের কৌতুকের ফাঁদ পেতে রাখা হয় মানুষজনের জন্য।

‘হোক্স’ এবং ‘প্রাঙ্কস’ : এপ্রিল ফুল উদ্যাপনের সঙ্গে বহুলভাবে উচ্চারিত ও জড়িত দুটি শব্দ ‘হোক্স’ এবং ‘প্রাঙ্কস’। কাউকে বোকা বানানোর জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো ঘটনা বা কিছু সাজিয়ে রাখাকে হোক্স বলা হয়। এটা বাস্তবে কৌতুক করা। বিষয়টি এমন হতে হবে যে, এটা দ্বারা সত্যি সত্যি কাউকে প্রতারণা করা হবে না, হাস্যরসের জন্যই সাজানো হবে ঘটনাটি। ‘প্রাঙ্কস’ বিষয়টিও তাই। যারা এই বাস্তব কৌতুক করেন তাদের ‘প্রাঙ্কস্টার’ বলা হয়। গত শতাব্দীতে পশ্চিমা দেশগুলোর শীর্ষস্থানীয় অনেক সংবাদ মাধ্যমও এপ্রিল ফুল উপলক্ষে ‘সাজানো সংবাদ’ ছাপায় ও সম্প্রচার করে।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads