• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

বাংলাদেশ

স্মৃতিচারণ

মুক্তিযুদ্ধ : রক্তের রাখিবন্ধন

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ২৫ মার্চ ২০১৮

দুরন্ত বেগে ছুটে আসা ট্রেনটির গতি শ্লথ হয়ে এল। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্ণৌর আউটার স্টেশনে এসে ‘ডেডস্টপ’ হয়ে গেল ট্রেনটি। আমরা যারা দীর্ঘসময় ধরে আঁকাবাঁকা ট্রেনটির ছন্দায়িত চলার গতির সঙ্গে ঝিমিয়ে পড়েছিলাম, ট্রেনটি থামার সঙ্গে সঙ্গেই অ্যালার্ট হয়ে গেলাম। মুহূর্তেই বেজে উঠল পরিচিত বাঁশির হুইসেল। বুঝতেই পারলাম, মেজর এইচ জি গুরাং আমাদের ‘ফল-ইন’ করতে বলছেন। উত্তরপ্রদেশের দেরাদুনস্থ বিশ্ববিখ্যাত টান্ডুয়া মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় দীর্ঘ তিনমাস ধরে প্রতিদিন আমরা এই হুইসেলের শব্দে ঘুম থেকে জেগে অ্যাসেম্বলিতে গিয়েছি। আবার একই বাঁশির শব্দ শুনে রাতে ব্যারাকে ঘুমাতে গিয়েছি।

১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মানুষ মহান মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত। আগস্টের প্রথম দিকে আমরা আগরতলা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি পরিবহন বিমানে করে দেরাদুনে এসেছিলাম। সেখান থেকে সামরিক ট্রাকে চড়ে টান্ডুয়া মিলিটারি একাডেমিতে। আমাদের রিক্রুট করা হয়েছিল বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের সদস্য হিসেবে। সংক্ষেপে বলা হতো বিএলএফ। তবে যুদ্ধরত বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিএলএফের পরিচয় ছিল মুজিববাহিনী নামে।

এই মুজিববাহিনীর ট্রেনিংপ্রাপ্ত ১৫তম ব্যাচের তিনশ’ গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে ট্রেনটি সম্ভবত শাহরানপুর শহরের একটি স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। এই বিশেষ ট্রেনটির গন্তব্য ছিল আগরতলা। এখান থেকেই সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারূপে আমাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইনডাক্ট করার কথা।

মেজর গুরাংয়ের বাঁশির হুইসেল শুনে আমরা ট্রেন থেকে নেমে ‘ফল-ইন’ হলাম প্রশস্ত প্রান্তরে। আমাদের বলা হলো যে, প্রচণ্ড বাতাসের জন্য চলন্ত ট্রেনে রান্নার অসুবিধা হচ্ছে। অতএব, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এখানে ট্রেনটি ঘণ্টা দুয়েক থামবে। রান্না শেষে আমরা মধ্যাহ্নভোজ সেরে আবার গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করব। আমাদের আরো বলা হলো, ইচ্ছা করলে আমরা ট্রেনেই সময় কাটাতে পারি এবং এটাই কাম্য। তবে কেউ ইচ্ছা করলে একটু এদিক-সেদিক ঘুরে-ফিরে দেখতে পারে। তবে আমাদের কঠোরভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, আমরা যেন দূরে কোথাও না যাই। নিষ্প্রয়োজনে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে ‘বাতচিৎ’ না করি। বিশেষ করে নিজেদের পরিচয় কিংবা গন্তব্য স্থান নিয়ে কথা না বলা ভালো।

যা হোক, নির্দিষ্ট সময়ই আমরা সবাই ট্রেনের কাছে পৌঁছে গেলাম। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির ফলে আমরা সবাই ক্ষুধার্ত ছিলাম। ট্রেনের কাছে আসতেই ‘কিচেন বগি’ থেকে খাবারের সুঘ্রাণ নাসিকা রন্ধ্রে প্রবেশ করায় ক্ষুধার তীব্রতা আরো অনুভূত হতে লাগল। আমরা যে মুহূর্তে খেতে যাওয়ার জন্য উসখুস করছিলাম, তখনই আমাদের হূদয় কাঁপিয়ে বাঁশির হুইসেল বেজে উঠল। এবার বাঁশি বাজালেন মেজর রূপ সিং। এই বাঁশির হুইসেলে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। নিশ্চয়ই কোনো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়েছে আমাদের কোনো সহযোদ্ধা এবং দেশে ফেরার পথে আমাদের হয়তো আবার বকাঝকা খেতে হবে। তবুও হুইসেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ‘ফল-ইন’ হতে হলো।

আজ স্বদেশে ফেরার পালা। একদিন টান্ডুয়াতে এসেছিলাম কাঁচামাল হিসেবে। আজ ফিরে যাচ্ছি দুর্দান্ত গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে। শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় আমরা সবাই উন্মুখ। এমনি সময় না জানি কোনো অবিমৃষ্যকারীর দুষ্কর্মের জন্য আমাদের আবার বকাঝকা খেতে হবে। তবে মেঘের ফাঁকেও রোদের ঝলক দেখলাম। ‘ফল-ইন’-এর সামনে এসে দাঁড়ালেন মেজর দেবদাস। টান্ডুয়া মিলিটারি একাডেমির সবেধন নীলমণি একমাত্র বাঙালি অফিসার। তাও মেডিকেল কোরের। বাঙালিত্বের কী বিরাট আকর্ষণ, কী দুরন্ত এর প্রাণশক্তি। এই বহু দূর দেশে অবস্থিত টান্ডুয়া এসে তা বুঝতে পেরেছিলাম অস্থিমজ্জায়। যখনই কোনো দুঃসংবাদ কিংবা বিপদ সমাগত, মেজর দেবদাস সাক্ষাৎ দেবতার মতো আমাদের মধ্যে হাজির। একে তো বাঙালি, তার ওপর নাম দেবদাস। কোথায় মেজরফেজর। আমরা সবাই তাকে ডাকতাম দেবদা বলে। এটাই তিনি আশা করতেন বটে। আজো যখন লক্ষ্ণৌর রেলস্টেশনে আমরা অজানা অমঙ্গল চিন্তায় অধীর অপেক্ষমাণ, তখন এই ভেবে সান্ত্বনা পেলাম যে বকা খেলেও যাওয়ার বেলায় বাঙালির মুখ থেকে বকা খাব। আর দেবদা কতটুকুই বকতে পারবেন?

মনের এই বিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখলাম, বিভিন্ন রকমের একদল মহিলা আমাদের দিকে এগোচ্ছে। এবার আর বিপদ অজানা রইল না। এমন একটি আশঙ্কা আমরা শুরুতেই করেছিলাম। ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজনকে দেখলাম নিকটস্থ কলোনির দিকে যেতে। সন্দেহ হয়েছিল, তারা কি জানি কি করে বসে। এবার মহিলাদের আসতে দেখে আমরা নিশ্চিত হলাম, আমাদেরই কোনো কোনো বন্ধু- যারা পার্শ্ববর্তী কলোনিতে গিয়েছিল, না জানি তারা কী গর্হিত কাজই করে ফেলেছে।

কিন্তু মহিলাদের মিছিলটি খুব কাছে এলে কেমন জানি অন্য একটি আবহ, অন্য একটি মেজাজ আমাদের কাছে অনুভূত হলো। সবাই সুন্দর করে পরিপাটি সাজে সজ্জিত। প্রত্যেকের হাতেই আল্পনা আঁকা ডালা-কুলা। একটু আবেগ ও কম্পন জড়িত কণ্ঠে মেজর দেবদাস সামরিক কায়দায়ই একটি ছোট্ট ভূমিকা দিতে গিয়ে বললেন, আগত এই মহিলারা নিকটস্থ সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের কর্মচারীদের আবাসিক কলোনির বাসিন্দা। তোমাদের কয়েকজন ছেলে এই কলোনিতে গিয়ে জল খেতে চাইলে প্রথম মহিলারা শুনতে পায়, এই ট্রেনে জয়বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং শেষে স্বদেশে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে। এতদিন তারা বিভিন্ন পত্রপত্রিকা কিংবা রেডিও-টিভিতে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের কথা পড়েছে কিংবা শুনেছে। আজ তাদের সৌভাগ্য হয়েছে, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে কিছু বাংলা মায়ের তরুণ ট্রেনে চড়ে যাচ্ছে-এখন তারা তোমাদের একনজর দেখার ও আশীর্বাদ করার জন্য এখানে উপস্থিত হয়েছেন।

এরই মধ্যে দেবদা একজন প্রৌঢ়গোছের মহিলাকে ইঙ্গিত করলেন। তিনি সামনে এসে অত্যন্ত প্রফুল্লচিত্তে বললেন, তোমরা আমাদের ভাই ও সন্তানতুল্য। তোমাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও যুদ্ধজয়ের খবরে গোটা বিশ্ব আজ মুগ্ধ। আমরা তোমাদের বিজয় কামনা করি। তোমাদের শুভ কামনা করি। আমরা আজ আরো আনন্দিত এই জন্য যে, আজ ভাই ফোঁটার দিন। রাখিবন্ধনের দিন। তাই আমরা শুভ কামনায় রাখি বেঁধে দিতে এসেছি তোমাদের কোমল-কঠিন হাতে, আজ ভাই ফোঁটা দিয়ে শুভ কামনার সিঁদুর পরিয়ে দিতে চাই তোমাদের প্রশস্ত ললাটে। এরপরই প্রতি লাইনে দু’জন করে মহিলা হাতে ডালা-কুলা নিয়ে আমাদের প্রত্যেককে রাখি বেঁধে দিতে লাগলেন এবং একই সঙ্গে ললাটে রক্তলাল সিঁদুরের ফোঁটা।

দীর্ঘদিন আমরা দেশান্তরী। প্রিয় মাতৃভূমিতে আমরা আমাদের মা, বোন, ভাবীদের রেখে এসেছি সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায়। আমরা অনেকেই জানি না আমাদের স্নেহময়ী জননী বেঁচে আছেন নাকি পুত্রশোকে মৃত্যুর শীতল কোলে ঢলে পড়েছেন। আমরা অনেকেই জানি না আমাদের জায়াদের নম্র হাতের কোমল পাতায় কোনো গ্লানি কলঙ্কিত করেছে কি না, বোনদের রজনীগন্ধার মতো পবিত্রতা এখনো নিষ্কলুষ আছে কি না। এমনি মুহূর্তে আজ লক্ষেৗর রেল স্টেশনে ছুটে আসা সরকারি আবাসিক কলোনির মাতা-ভগ্নিদের দেখে আমাদের চোখের সামনে ভেসে এসেছে স্বদেশের ভূমিতে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে আসা আমাদের প্রিয়জনদের কথা। প্রিয় মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের কথা। হিজল ফুল, কণ্টকারীর ঝোপ, তিল্লৎপাতার হলুদ ফুল, কাজলা দীঘি, শান বাঁধানো ঘাট সবকিছুর কথা।

সেই আকুল আবেগমাখা লক্ষ্ণৌ স্টেশন ছেড়ে এসেছি আমরা তিরিশ বছর আগে। এর মধ্যে ভারত-বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কত জল, কত জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা ও প্রকৃতির বিপর্যয়। তিরিশ বছর পেরিয়ে এলেও মনে হয় এই সেদিনের কথা। আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুখ ছিনিয়ে আনতে তিরিশ লাখ প্রাণের রক্ত ঢেলে দিয়েছি। একই সঙ্গে আমাদের মাতৃভূমি হানাদারমুক্ত করতে আত্মবিসর্জন দিয়েছে সাড়ে এগারো হাজার ভারতীয় সৈন্য। পরদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এই আত্মদান নিশ্চয়ই অনন্য গৌরবের এই রক্তের রাখিবন্ধনের মধ্যদিয়ে সূচনা হয়েছে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে মৈত্রীর সেতুবন্ধ।

আমরা যখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কথা বলব, তখন অবশ্যই সাড়ে এগারো হাজার ভারতীয় জওয়ানের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করব, বিবেচনায় আনব। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সাহসী হতে হবে, দৈন্য ঘোচাতে হবে। আমাদের কোনো একটি স্বাধীনতা দিবসে বা বিজয় দিবসে আমরা কখনই মিত্রবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল অরোরাকে আমন্ত্রণ জানাতে পারিনি, কিংবা ভারতীয় যোদ্ধাদের স্মরণে এখন পর্যন্ত কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে পারিনি। এই দীনতা বীরের জাতি হিসেবে আমাদের জন্য গ্লানিকর। ইতিহাসের তাগিদেও এটা আমাদের করা দরকার। আমরা শৌর্য-বীর্যশালী বীরের জাতি। আমাদের সম্মানবোধ রয়েছে। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করতে সোভিয়েত নৌবাহিনীর টিম এসেছিল। সে সময় রেটকিন নামে একজন সোভিয়েত নাবিক মৃত্যুবরণ করেন। কর্ণফুলীর তীরে আমরা রেটকিনের স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করেছি। প্রতিবছর শত শত মানুষ গিয়ে রেটকিনের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আসে। এটাই শোভন। এটাই আমাদের কর্তব্যবোধ। একই কারণে আমাদের স্বাধীনতার বেদিমূলে আত্মোৎসর্গকৃত বিশ সহস্র ভারতীয় বীরদের জন্য গড়ে তোলা উচিত ছিল এক বিশাল স্মৃতিসৌধ।

একই সঙ্গে আজ ভারতকেও একটি ধ্রুব সত্য অনুধাবন করতে হবে, ভারত আমাদের বিশাল প্রতিবেশী। এমতাবস্থায় আমাদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টিকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ তাদের থাকতে পারে না। আমাদের সব সমস্যা ছোট কিংবা বড় সবগুলোকেই আমাদের অনুকূলে সমাধান করার উদ্যোগ নিতে হবে ভারতকেই। বাংলাদেশকে যদি তার সমস্যা সমাধানের জন্য অন্য কারো দ্বারস্থ হতে হয়, সেটা ভারতের জন্যও হবে দুঃখ ও বেদনার। রাজনৈতিক পরাজয়ও।

অতএব এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সেতুবন্ধ করতে গিয়ে কেবল প্রচলিত রাষ্ট্রাচার, কূটনৈতিক কলাকৌশল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট পরিভাষার মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। এই দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবশ্যই কিছু আবেগের স্থান থাকতে হবে, যে আবেগের তাড়নায় ত্রিশ বছর আগে লক্ষ্ণৌর সরকারি কলোনির মা-বোনেরা ঘর থেকে ছুটে এসেছিল জয় বাংলার দামাল ছেলেদের হাতে রাখি পরিয়ে দিতে, ভাই ফোঁটার রক্তিম তিলক পরিয়ে দিতে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads