• শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪২৯
রোগ নির্ণয় পরীক্ষায় নৈরাজ্য

ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নৈরাজ্য চলছে

সংরক্ষিত ছবি

বাংলাদেশ

রোগ নির্ণয় পরীক্ষায় নৈরাজ্য

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ২৫ মে ২০১৮

রোগ নির্ণয়ের জন্য সারা দেশের ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত কোনো আইন নেই। স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশটি দীর্ঘ বছর ধরে অকার্যকর। রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার সমন্বিত মূল্য নির্ধারণের জন্য কোনো নীতিমালা নেই। রোগীদের কাছ থেকে তাই ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করছেন বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মালিকরা। এ খাতে দেশজুড়ে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য। রোগীদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে রোগ নির্ণয়ের ব্যবসা দিনে দিনে নৈরাজ্যে পরিণত হয়েছে। দায়িত্বশীল মন্ত্রী, আমলা, চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ সবাই এ নৈরাজ্যের কথা স্বীকারও করেন। বলেন বন্ধের কথা, কিন্তু করেন না কেউ।

একই পরীক্ষা করাতে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের টাকা লাগে। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কয়েক গুণ বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। এমনকি একই মানের ও একই এলাকায় অবস্থিত চিকিৎসাকেন্দ্রেও একটির সঙ্গে আরেকটির পরীক্ষার দামে মিল নেই। মালিক, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা নিজেরা মিলে খেয়ালখুশিমতো নির্ধারণ করেন টাকার অঙ্ক। এসব নৈরাজ্যের লাগাম টানতে আইন করার উদ্যোগ বিভিন্ন সময় নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হাসপাতালভেদে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আলাদা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়। ধানমন্ডির কোনো ক্লিনিকে পরীক্ষা করার পর একই বিষয়ে উত্তরা ও রাজধানীর অন্য কোনো এলাকায় পরীক্ষা করালে কম বা বেশি টাকা লাগে। অভিজাত হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নেওয়া হয় এক ধরনের দাম। এসব হাসপাতালেই পরীক্ষা করাতে সবচেয়ে বেশি টাকা লাগে। আবার অনেক ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি ও ব্যবহূত কেমিক্যালের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে।

তথ্য মতে, যেকোনো ধরনের অস্ত্রোপচার করাতে হাসপাতালভেদে দশ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত রোগীদের খরচ হচ্ছে। একইভাবে সিটি স্ক্যানে চার থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম এক থেকে তিন হাজার টাকা ও এমআরআই করাতে ছয় থেকে দশ হাজার টাকা। সব ধরনের পরীক্ষার বেলায় দাম নৈরাজ্যের এ চিত্র বিদ্যমান।

এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে গত ১৬ মে অনুষ্ঠিত প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মানোন্নয়ন সংক্রান্ত সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম নিজেই বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সময়ে দেশে চিকিৎসার মানের অনেক উন্নতি হয়েছে। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভুলের কারণে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। হাসপাতালভেদেও একই পরীক্ষার ভিন্ন ভিন্ন ফল পাওয়া যায়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানা যায়, রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষার দাম নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন সরকারের আমলে খসড়া সাজানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে তা প্রস্তাব আকারে পাঠানোও হয়েছে। এ পর্যন্ত কতবার প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, এ হিসাব অধিদফতরের কাছে নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কতিপয় সুবিধাভোগী কর্মকর্তার কারণে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা আইনটি হচ্ছে না বলে মনে করেন অধিদফতরের কয়েক কর্মকর্তা। আইন না থাকায় বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ইচ্ছামাফিক টাকা আদায়ের বিষয়টি তারা জানা সত্ত্বেও প্রতিকারে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না বলে দায় এড়িয়ে যান।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিচালনায় ‘মেডিকেল প্র্যাকটিস, প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতে ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে কোন পরীক্ষার জন্য কত টাকা নেওয়া যাবে রোগীদের কাছ থেকে, তা নির্ধারিত ছিল। তবে আজকের বাস্তবতায় ওই অধ্যাদেশ অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতাল পরিচালনা সম্ভব নয়। অধ্যাদেশটিতে ওই সময়ের বাস্তবতা অনুযায়ী টাকার পরিমাণ নির্ধারিত ছিল। সময়ের সঙ্গে মিল রেখে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন না হওয়ায় নৈরাজ্যকর অবস্থা চলছে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ এ প্রসঙ্গে জানান, ‘দেশের সব হাসপাতালে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার ক্ষেত্রে একই মান ও দাম বজায় রাখার লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের (হাসপাতাল) নেতৃত্বে গত ১৬ মে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ৪৫ দিনের (গঠন হওয়ার দিন থেকে গণনা শুরু) মধ্যে খসড়া প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সভায় নির্দেশ দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।’

কয়েকটি হাসপাতালের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারের শুরুতে বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আইনটি প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন পরীক্ষার মূল্য তালিকা ‘সহজে দৃশ্যমান স্থানে’ প্রদর্শন করার নির্দেশ দেয়। তালিকায় রক্ত, মলমূত্র পরীক্ষা, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এমআরআই, এনজিওগ্রাম, ইসিজি ও ইটিটি পরীক্ষার কথা ছিল। ‘সেবা’র মূল্য তালিকা প্রদর্শনের কথা বলা হলেও সেগুলোর দাম নির্দিষ্ট করা ছিল না। ফলে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের ইচ্ছামাফিক টাকা আদায় বন্ধ হয়নি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads