• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

বাংলাদেশ

এক নতুন ও মৌলিক বাংলা সংস্কৃতি

  • রবিউল হুসাইন
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৮

আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ২৫ মার্চের কালো-তমসাপূর্ণ রাতের মধ্যভাগে হঠাৎ করে সশস্ত্র পাকিস্তানি হানাদারেরা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটপ্রাপ্ত অথচ অধিকারচ্যুত নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলি, বোমা, আগ্নেয়াস্ত্রসহ মর্ষকামী বিকৃত মানসিকতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই স্বাভাবিকভাবে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশ বিশ্বমানচিত্রে একটি নতুন দেশ হিসেবে পৃথিবীর ধরাপৃষ্ঠে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙালি অধ্যুষিত এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রায় হাজার বছর বিদেশি পরাশক্তি দ্বারা শাসিত হতে হতে বিভিন্ন কাল অতিক্রম করে এবং তাই সবসময় পরাধীনতার শক্ত জালে আটকে ছিল, কোনো দিন নিজের মতো করে নিজেকে স্বাধীনভাবে গড়ে তুলতে পারেনি। এই প্রেক্ষিতে আমাদের ভূখণ্ডের এই স্বাধীনতা লাভে একটি বিশাল অর্জন এবং বিরাট অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি। এটাকে যেভাবেই হোক শক্ত করে ধরে রাখতে হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু স্বাধীনতার এতদিন পর কী আমরা দেখছি? ইতিহাসের অমোঘ চাকাকে উল্টো করে ঘুরিয়ে বিকৃত করার হীনমন্যতা বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে হাস্যকরভাবে প্রতিপক্ষ করে তোলা, বাঙালি জাতিকে বাংলাদেশি বলে চালানোর চেষ্টা, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে জড়িয়ে সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতিতে সুড়সুড়ি দিয়ে যেকোনোভাবেই হোক না কেন নির্বাচনে কোনো মানবিক আদর্শ ও দর্শনশূন্যভাবে জেতার অপচেষ্টা, নির্বাচন প্রক্রিয়াকে নানান চালাকি ও ছলচাতুরী করে তার কার্যকারিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে ফেলা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, পুলিশ, প্রশাসন সবকিছুতেই দলীয়করণ, আত্মীয়করণ ও কলুষিত করার গভীর ষড়যন্ত্রনির্ভর শাসনপ্রক্রিয়া ভীষণভাবে জর্জরিত করে তোলা হয়েছিল। বাংলাদেশ নামক সুজলা সুফলা দেশটি আজ তাই ধুঁকে ধুঁকে মরে যেতে বসেছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক হিসেবে এই শাসনযন্ত্র দাবি করে অথচ অন্য দলের কোনো অংশীদারিত্বে বিশ্বাস করে না। মাঝ থেকে আগের সরকারি আমলের সঙ্গে তুলনা করে সর্বক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে সবকিছুই দুর্বিষহ করে তুলেছিল। যারা যে জিনিসটা খারাপ করে তুলেছিল সেটা পরবর্তী সময়ে কোথায় ভালো করে তুলবে তা না, বরং সেই নিকৃষ্ট পন্থাকে বহুগুণে বাড়িয়ে প্রশাসনের প্রযন্তে আরো নির্যাতন আরো অবিচার আরো অবিমৃষ্য করতে সচেষ্ট হয়েছিল। এখানে দলপ্রেমের শক্তি, মানবপ্রেম, মানব অধিকার, শ্রেয়বোধ, মূল্যবোধ, প্রাকৃতিক মনুষ্যত্ববোধ সবকিছুকে ছাড়িয়ে ও পদদলিত করে সমাজ ও রাজনীতিতে এই কাল দুষ্টক্ষত হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এমনকি কোনো কিছু ভালো বা যেটা যৌক্তিক এবং সঠিক বলে বিবেচিত ও সমাজে বহুদিন ধরে দৃষ্টান্তমূলক এবং কল্যাণমূলক বলে প্রমাণিত তেমন কিছু বললেই তিনি কোনো দলের সমর্থক না হয়েও হয়ে পড়েন বিরোধী দলভুক্ত এমন অসম্ভব ও অসহ্যকর সার্বিক পরিবেশ এই দেশে কৃত্রিমভাবে বিরাজ করছিল ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস তার উপর জঙ্গিবাদীদের উত্থান দেশ ও দেশের মানুষকে করে তুলেছিল অসহায় আর দুর্বল। যেকোনো আন্দোলন মিছিল, যদিও তা গণতান্ত্রিক অধিকার, সেটাকে অমানুষিক পুলিশি নির্যাতনে সবসময় দমন করা হয়, অথচ সব সরকারই গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসছে।

পুলিশের যে মহান মানবসেবার ব্রত, সেটার আজ কোনো খোঁজ নেই। সেই জনগণের বন্ধুর পরিচয় যা আগে খানিক হলেও দেখা যেত, সেটার বদলে আজ তারা মনুষ্য-রোবট হিসেবে দেখা দিয়েছে। আগে যেমন সততা, নিয়মানুবর্তিতা, উপচীকির্ষা গুণগুলো উচ্চ পদে আসীন হওয়ার মাপকাঠি ছিল, এখন সেই কাঠি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এখন নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর যে যত নির্যাতন, অশ্রাব্য গালাগালি আর অমানুষিক অত্যাচার করবে- তার তত পদোন্নতি ঘটবে। এই কুদৃষ্টিভঙ্গি সংসদেও দেখা যায়। মাননীয় যে সাংসদ বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী, বঙ্গবন্ধু বা দলকে যত গালমন্দ করবেন তিনিই তত উন্নতি লাভ করবেন। এই যে নেতিবাচক অসুস্থ মানসিকতার লালন-পালন ও পৃষ্ঠপোষকতার উদাহরণ দেশের সর্বোচ্চ পবিত্র পীঠে দেখা যায়, যারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও আইনপ্রণেতা তাদের বিকৃত ও ভ্রান্ত ধারণাপ্রসূত তাৎক্ষণিক ইহজাগতিক লাভবান হওয়ার দুর্মর বাসনা- সেটি সর্বতোভাবে সমাজ ও রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক কল্যাণকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে, সমাজে নৈতিকতা, শ্রেয়বোধ সবকিছু এত নিম্নস্তরে নেমে গেছে যে, সেখান থেকে উঠে আসার কোনো শুভ লক্ষণ ও শক্তি আজ কারো মধ্যে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ধর্মীয় মূল্যবোধ যা মানুষের মঙ্গলকে নিশ্চিত করে সেই শক্তিও আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে পড়েছে। এতে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে- এক, এদেশের প্রত্যেক সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও চরিত্র ও আচরণে স্বৈরতান্ত্রিক এবং একাধিপত্যবাদী। দুই, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মিশ্রণ কখনো দেশ ও জনগণের জন্য কার্যকর ও কল্যাণমুখী ভূমিকা রাখতে পারে না। পৃথিবীর বহু দেশে এই চেষ্টা হয়েছে অতীতে, কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কেননা রাজনীতির মতো পরিবর্তনশীল ও শেষ কথাহীন বিষয় যেকোনো পবিত্র ধর্মের তুলনায় অপবিত্র, শঠতাপূর্ণ এবং অস্বচ্ছ। তাই প্রকারান্তরে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের মিলমিশ বা প্রভাব পবিত্র ধর্মকেই অসম্মান করার শামিল। এদেশের রাজনীতি গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু একটি সুদৃঢ় বিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই দুটি ভিন্ন ধারার প্রক্রিয়ার মিলন কখনো কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করতে পারে না। কিছু সুবিধালাভকারী দেশের সাধারণ, সবল ও ধর্মপ্রাণ গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের ধর্মীয় ভাবাবেগ উসকিয়ে দিয়ে নির্বাচনের তরী পাড়ি দিয়ে সফলকাম হন। তাতে তাদের সেই কৃত্রিম সফলতা অবশেষে কোনো সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হয় না। এটাই রাজনৈতিক বাস্তবতা। এই বাস্তবতা সবসময় অবশেষে টিকে যায়। প্রতিটি জায়গায় রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে ইতিহাস নতুন করে সৃষ্টির মহড়া হাস্যকরভাবে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস তো ইচ্ছেমতো তৈরি বা মনগড়াভাবে করা যায় না। সে আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়। আমগাছকে জোর করে কাঁঠালগাছ হয়তো সাময়িকভাবে বলা যায়, কিন্তু কিছুদিন পর কুয়াশা কেটে গেলে আমগাছ আমগাছ হিসেবেই স্বমূর্তি এবং অস্তিত্বে আবির্ভূত হয়। কেননা ইতিহাস কোনো রকমের অতিশয়োক্তি, বাগাড়ম্বর, অসত্যতা ও কৃত্রিমতাকে কখনো ধারণ করে না। করলেও তা ইতিহাস হয় না, পাঁতিহাস হয়ে উড়ে চলে যায় অন্য কোনো জলাশয়ে, অন্য কোনো খাদ্য ও আশ্রয়ের খোঁজে। এটাই প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম। বঙ্গবন্ধুকে শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে জনমত নির্বাচিত করেছে, এখানে নাকি কারচুপি আছে। বিদগ্ধজনরা বলে থাকেন রবিঠাকুরই শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু নন। কিন্তু তারা বোঝেন না, সঙ্গীত শিল্পী বা সাহিত্য সৃষ্টির তুলনায় একটি স্বাধীন দেশের সৃষ্টি সৃজনশীলতার প্রেক্ষিতে অনেক বড় মাপের নির্মিতি, বঙ্গবন্ধুর অবদান বাঙালির মধ্যে তাই অপরিসীম মূল্য বহন করে। তাই বলে রবিঠাকুরের অবদানকে খাটো করে দেখা হচ্ছে না, দুইজনের দুটি ভিন্ন প্রেক্ষিত, যে যার স্থানে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। রবিঠাকুর বাঙালির অন্তর্জগৎকে সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিলেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন, অপরপক্ষে বঙ্গবন্ধু যেটাকে তার পরিপূর্ণ অবকাঠামো দিয়ে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন- এই যা পার্থক্য। স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে কত কত কথা। স্বাধীনতার ঘোষণা সেই সময়ে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর নামে দিয়েছিলেন। একশ ভাগ সত্যি কথা। তাই বলে সেই ঘোষণার ঘটনাক্রমিকতাকে এত বড় করে দেখিয়ে যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এ দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এতদিন ধরে সংগ্রাম করে জীবনের ১৩টি বছার জেল-জুলুম সহ্য করে ধীরে ধীরে একটি উত্তুঙ্গ শীর্ষে নিয়ে শেষ পর্যন্ত শত ষড়যন্ত্র-নীলনকশা ছিন্ন করে সফলকাম হলেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ সৃষ্টি করে, সেই বিশাল মাপের মানুষকে পাশ কাটিয়ে একজন সেনা কর্মকর্তাকে কোন কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ করার যাবতীয় সাফল্য কোন বিবেচনায় দাবি এবং তা প্রতিষ্ঠিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে তা আমাদের বোধগম্যতার বাইরে। স্বাধীনতাযুদ্ধে কত কত মানুষ কত কতভাবে কত বিভিন্ন রকমে সাহায্য করেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। পৃথিবীর প্রত্যেক দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এমন দেখা যায়। কারো একক চেষ্টায় কোনো স্বাধীনতাযুদ্ধ হয় না, তা বঙ্গবন্ধুই হোন আর যে-ই হোন। জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ছাড়া যেমন বঙ্গবন্ধুর কোনো ক্ষমতা বা শক্তি ছিল না সে সময়ে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা দেশের স্বাধীনতার চেতনা, দেশপ্রেম ও মনোবল ছাড়া মেজর জিয়া বা কোনো মুক্তিযোদ্ধার মনোশক্তি ছিল না। এ কথা হয়তো অনেকেই মেনে নেবেন না, কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় একজন মানুষ তার নিজের গুণ ও সততায় জনগণের আস্থা অর্জন করেন, তিনিই হয়ে ওঠেন জনমানুষের সৃষ্টি করা তাদেরই প্রয়োজনের তাগিদে তাদেরই অভিন্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, বঙ্গবন্ধু সে রকমই জনগণসৃষ্ট একজন নেতা। তাই সে সময়ের এক বিদেশি ইংরেজি সাপ্তাহিকী তাকে একজন পোয়েট অব পলিটিক্স বা রাজনীতির এক কবি বলে অভিহিত না করে পারেনি। এ রকম একটি মানুষকে সবসময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা দরকার দেশের চলমান সুস্থ রাজনীতি চর্চার স্বার্থে। কিন্তু আমাদের অতি দুর্ভাগ্য, তাকে আমরা যথাযথ সম্মান ও সমর্থন দিতে ব্যর্থ হচ্ছি স্বাধীনতাপ্রাপ্তির এতদিন পরেও। তাকে ২৭ জন পরিবার-সদস্য স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূসহ নৃশংসভাবে হত্যা করেও আমাদের রক্তের পিপাসা মেটেনি, এখনো তাকে হত্যা করে চলেছি। এখন কী আশ্চর্য যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়, ৭ মার্চে তিনি নাকি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, তাহলে এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- এই ঘোষণাটি কী? এটা কি নিছক একটি বাত কি বাত, মুখ ফসকে বলা একটি ভুলভাবে মনের প্রকাশ। বিষয়টি সম্বন্ধে যখন প্রশ্ন তোলা হয়, প্রশ্নকারী বোঝেন না বা বুঝতে চান না যে, বঙ্গবন্ধু দেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতেন গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে। তিনি বিদ্রোহী ছিলেন না মাও সে তুং বা হো চি মিনের মতো। তিনি যদি সেদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেন, তাহলে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে সারা দেশ-বিদেশে পরিচিত হতেন। সেদিন তিনি খুবই রাজনৈতিক সংযমের পরিচয় দিয়েছিলেন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অসাধারণ মেধাবী এই পুরুষ যদি রাজনৈতিক হঠকারিত্বে ব্যাপৃত হতেন, তাহলে পাকিস্তানের কঠিন মৃত্যুজালে পতিত হতেন তো বটেই, সেই সঙ্গে বিদেশের সাহায্য, সমর্থন কিছুই পেতেন না। সেই জন্য তিনি চরম ঝুঁকি নিয়েছিলেন, কোথাও পালিয়ে না গিয়ে বীরের মতো মাথা উঁচু করে বন্দিত্ব বরণ করলেন। কোথায় তিনি যাবেন, কেন যাবেন, তিনি তো গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চা করতে করতে এই জায়গায় পৌঁছেছেন। ভারতে গেলে সবাই বলত ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এসব করা হচ্ছে। প্রকৃত আত্মসম্মান প্রাপ্ত ব্যক্তিত্ববান একজন রাজনীতিক হিসেবে তিনি কোনো দেশের প্রতি পূর্ণ নির্ভরশীল হননি। অথচ এজন্য কোন যুক্তিতে তাকে ভীরু কাপুরুষ আত্মসমর্পণকারী বলা হয়, ভ্রান্ত মানুষের কী অসীম ভ্রান্তধারণা! সেই জন্যই পকিস্তানিরা তাকে ধরার পর মেরে ফেলতে পারেনি, অথচ তাকে মারতে তো পারতই। কেন মারেনি, কারণ তিনি তো অন্যায় করেননি। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে তার দল, তার দল সরকার গঠন করবে, কিন্তু তারা তো করতে দিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জনগণ ক্ষেপে উঠল, তার নেতৃত্বে সুগঠিত হলো। এর বিপরীতে পাকিস্তানিরা নিরস্ত্র জনগণের ওপর ২৫ মার্চে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই জন্য প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মুক্তিযুদ্ধ ২৬ মার্চ থেকে শুরু হলো। তখন যুদ্ধবিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, এদেশে মুক্তিযুদ্ধের মতো আঘাত কর এবং দৌড়ে আত্মগোপন কর- এই গেরিলাযুদ্ধ সম্ভব নয়। কারণ এদেশের ভূগঠন তেমন নয়, পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল নেই তাই। কিন্তু সব চরম ভুল প্রমাণিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি হলো। প্রতিপক্ষ বোঝেনি এদেশের প্রতিটি নারী-পুরুষের বুকে ছিল পাহাড় আর বন। মুক্তিযোদ্ধারা সেখানেই লুকিয়ে আশ্রয় নিয়ে যুদ্ধ করেছে ভারত, সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন ও সাহায্যে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণযুদ্ধ, তাই অবশেষে জনগণের জয় হয়েছে। ৯ মাস পর ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় এসেছে। বঙ্গবন্ধুকে তবুও বলা হয় তিনি আত্মসমর্পণ করে ভুল করেছেন। পালিয়ে গেলে এত মানুষ মারা যেত না। তিনি ৩০ লাখ ভুল করে বলেছেন, ৩ লাখ বলতে গিয়ে ৩ মিলিয়ন বলে ফেলেছেন ইত্যাদি। তার আত্মসমর্পণে তিনি যে বিশাল ঝুঁকি নিয়েছিলেন তার জীবনবাজি রেখে তার নিজের জীবনের বিনিময়ে দেশের কাউকে যেন নির্যাতন না করা হয় এই অসমসাহসী আত্মত্যাগের বিষয়টি বিজ্ঞ সমালোচনাকারীরা কীভাবে ভুলে যায়, ভেবে অবাক হতে হয়। তারা এত নিষ্ঠুর আর অমানবিক, আশ্চর্য! আর যে দেশ থেকে এক কোটিরও বেশি মানুষ প্রাণভয়ে অন্যদেশে শরণার্থী আর উদ্বাস্তু হয়েছে, যেখানে নিরস্ত্র মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে প্রত্যক্ষ সম্মুখযুদ্ধে আর সেখানে পরোক্ষে রোগ-শোকে, অসুখে-বিসুখে অনাহারে কত কত মৃত্যু হয়েছে সব মিলে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৩০ লাখ প্রায় কমবেশি শতকরা ৪.২৫ ভাগ এটা খুবই স্বাভাবিক। শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক রীতির রাজনীতি যখন সেনাশাসিত সামরিক জঙ্গি আইন কর্তৃক লাঞ্ছিত ও ধর্ষিত হয় তখন তা ৩ লাখ ছাড়িয়ে ৩০ লাখ হওয়া স্বাভাবিক গণনা। এই উপাত্ত পেয়েছিলেন রাশিয়ার প্রাবদা। আর বঙ্গবন্ধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিটিশ আমলের গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। তার ইংরেজি ভাষার জ্ঞান অনেক উঁচুস্তরের ছিল, এ কথা ভুলে যাওয়া মানুষকে ছোট করে দেখা, তা হত্যা করার শামিল। ধর্মগ্রন্থে এ রকম বলা আছে এবং তাই হলো, তাকে পরিবারসুদ্ধ মেরে ফেলা হলো। কিছুদিন পর জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে। আমাদের কলুষিত রাজনীতির কী প্রচণ্ড রক্তপিপাসা। দিনে দিনে আর কত রক্ত দিতে হবে।

এটা বলা যায়, আমরা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ শেষ করে স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি সেটা চলছেই। মুক্তিযুদ্ধ একটি সচল ও চলমান প্রক্রিয়া। মুক্তিযুদ্ধ অশিক্ষা, অবিচার, অত্যাচার, অনাচার, ইতিহাস-বিকৃতি, দেশের ঐতিহ্য-সভ্যতার অসম্মানের বিরুদ্ধে সবসময় চলতে থাকবে। সেই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ী হতে হবে। এই প্রেক্ষিতে মাটি, শেকড়, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়েই বাংলাদেশের মৌলিক সংস্কৃতি গড়তে হবে। সেই সুদিন আসুক তাকে আসতেই হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads