২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আবার আসছে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দিন-তারিখ এখনো চূড়ান্ত না হলেও ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অথবা নতুন বছরের শুরুতেই অনুষ্ঠিত হবে বহু আকাঙ্ক্ষিত এই নির্বাচন। যে ভোটাররা প্রার্থীদের কাছে অনেকটা অনাহূত, অনাদরের অবস্থায় চলে গিয়েছিল, তারা এখন আবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলা যায়। একেবারেই যারা সাধারণ মানুষ তারা পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, আলো-আঁধারিতেও ঘন ঘন সালাম পাবে অসাধারণ কিছু মানুষের। তারা সেসব অনাহূত মানুষকে জড়িয়ে ধরবে, তাদের বউ-বাচ্চাদের এমনকি বাড়ির কাজের লোকদেরও কুশলাদি জানতে চাইবে অত্যন্ত বিনয়ে। তাদের সঙ্গে সেলফি তুলবে। আহা, সেই সাধারণ মানুষ অবাক বিস্ময়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ভাববে, এমনি করে সারা বছর যদি এই প্রার্থীরা তাদের নিয়ে ভাবত, পাশে এসে দাঁড়াত- কতই না ভালো হতো।
তবু মানুষ উল্লসিত হয় নির্বাচন আসছে শুনলে। আবার তারা আশায় বুক বাঁধে, এবার যদি পোড়া কপালে একটু সুখের মুখ দেখা যায়। ফসলের দামটা যদি এবার তারা পায়। গতবার হয়নি তো কী হয়েছে, সেই কষ্ট তারা ভুলে গেছে। অতএব, খাও-দাও ফুর্তি করো। অবশ্য ভোটের পয়সায়। ‘আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!’ আর এই ভোট এলে গ্রামের ক্ষুদ্র দোকানদাররা নড়েচড়ে বসে। এই আশায় থাকে ভোটের মৌসুমে তার ব্যবসাটা একটু বাড়বে। বিলবোর্ড, ব্যানার তৈরির মানুষগুলো স্বপ্ন দেখে তাদের আয়ও একটু বাড়বে। আর এই ভোটের সুবাদে দেশের হতদরিদ্র মানুষগুলোর হাতে যে দুটো কাঁচা পয়সা আসে দেশের গাঁটকাটাদের কাছ থেকে, সেই ‘উইল্ডফল ইনকাম’টার জন্য আমি তার জন্য মোটেই চিন্তিত নই। বরং এতে যদি হতদরিদ্র লোকটির অরক্ষণীয়া কন্যাটির একটি সুগতি হয়, ক্ষয়কাশে ধুঁকতে ধুঁকতে মরণোন্মুখ স্ত্রীটির মুখে ওঠে এক ফোঁটা ওষুধ, কেনা যায় একটা বলদ, তাহলে মহাভারত মনে হয় অশুদ্ধ হবে না। আর ভোটের সময় অনেক মানুষ মনে করে প্রার্থী যদি স্বেচ্ছায় কিছু হাতে গুঁজে দেয়, সে নেবে না কেন! সে তো চাইতে যায়নি। অবশ্য সব মানুষের ক্ষেত্রে এসব উপমা নয়। প্রার্থীরাই তো এসব চালু করেছে। মানুষ তো প্রথমে হাত পাতে না।
যা হোক, তবু এদেশে নির্বাচন মানেই একটা উৎসব। সব উপদ্রব-অত্যাচারের মধ্য দিয়ে রাজসিক আয়োজনে নির্বাচনের আগমনী বাঙালির জীবনে বয়ে আনে আনন্দের হিল্লোল। অভাব-অনটন ও নানাবিধ আতঙ্কের ভেতর জবুথবু সাধারণ মানুষ মেতে ওঠে ভোট উৎসবে। এমনিতেই উৎসবপ্রিয় বলে সুখ্যাতি আর হুজুগে বলে খ্যাতি আছে বাঙালির। এ দেশ গানের দেশ, প্রাণের দেশ। সেখানে বেঁচে থাকার হাজার সংগ্রামের পাশাপাশি যদি সংবৎসর কেবল খুন-জখম, আর সড়ক দুর্ঘটনার খবরই সারা বছর ছাপা হতে থাকে, যদি পাড়ার মাস্তানের কবল থেকে কুমারী কন্যাসন্তানটিকে রক্ষার চিন্তায় চিন্তায় ঘুম হারাম হয়, তাহলে জীবন থেকে আনন্দ-উল্লাস তো হারিয়ে যাওয়ার কথা। এরই ভেতর মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বাঙালির নিরানন্দের সংসারে নির্বাচনী কোলাহল অবশ্যই এক ধরনের পুলক সঞ্চার করে। আর সবচেয়ে বেশি আনন্দ পায় মানুষ ভোট দিয়ে। এই দিন মানুষ একদিনের রাজা।
বিশাল বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ে, ফুড়ফুড়ে পাঞ্জাবি পরে, পারফিউম গায়ে দিয়ে যে ষণ্ডামার্কা লোকটি ভোট দিতে আসেন, তার যেমন সেদিন মূল্য, তার যেমন একটি ভোট, তেমনি নব্বই বছরের একজন মানুষেরও একটিই ভোট, সমান মূল্য। ভোটের বাক্সের সামনে দুজনের দাম এক। ওই একটি দিনের জন্য অনেক হাবাগোবা, চতুর, সৎসহ নানা পেশার মানুষ অপেক্ষায় থাকে। অবশ্য সে বা তিনি যদি ভোটটি দিতে পারেন। আর কেউ যদি পান চিবাইতে চিবাইতে বলে ওঠে- চাচা, আপনার ভোট তো দেওয়া হয়েছে... ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাদের দেশের নির্বাচন মানেই হৈচৈ, শো-ডাউন, সভা-সমাবেশে পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষারোপ, নিজেদের মধ্যে তো আছেই। পরস্পরের সঙ্গে শক্তির মহড়া, টাকা-পয়সার ছড়াছড়ি। সব মিলিয়ে এক ধরনের উদ্দামতা, উন্মাদনায় মেতে ওঠে দেশ। এমন একটি মেলোড্রামা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের সব অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেই কমবেশি মঞ্চস্থ হয়ে থাকে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, রক্তপাতও হয়ে থাকে এ ধরনের দেশে। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে সূক্ষ্ম-স্থূল কারচুপির ঘটনা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও ঘটতে শোনা যাচ্ছে। তারপরও মানুষ নির্বাচনমুখী। বড় দুই দলের নিবেদিত এবং দলের জন্য একনিষ্ঠ কিছু কর্মীর নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যায় নির্বাচন এলেই। এরা নিঃস্বার্থভাবেই দলের জন্য কাজ করে। এরাই বড় দুটি দলকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আবার জেল খাটে, জীবন দেয়। এরা কেউ প্রথম সারির নেতা নয়।
সব দেশের মানুষ চায় নির্বাচন অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ হোক। আবার অনেক সভ্য, সুন্দর দেশে এসব চাইতে হয় না, আন্দোলন করতে হয় না। ওসব দেশে এমনিতেই ভালো নির্বাচন হয়। যত সমস্যা সম্ভবত এই উপমহাদেশে। সাধারণ মানুষ কিন্তু কে ক্ষমতায় আসবে, তাতে না যতটা আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি আগ্রহী তারাসহ সবাই যেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। যেমন কাজ করে উন্নত রাষ্ট্রগুলো। ‘কিছু অনিয়ম তো হবেই, ওটা বন্ধ করা যাবে না’- এ ধরনের নেতিবাচক মনোভব ঝেড়ে ফেলতে হবে। তাদের বলতে হবে এবং বাস্তবে প্রমাণ করে দেখাতে হবে, এ দেশেও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব।
এত এত হতাশার মাঝেও এই বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই, যে জাতি নয় মাসের নজিরবিহীন রক্তক্ষয়ী অসম যুদ্ধে জয়লাভ করেছে, যাদের কোটি কোটি অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত নর-নারী তাদের সনিষ্ঠ শ্রম দিয়ে, অবিমিশ্র সততা দিয়ে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবিত করতে পেরেছে, তারা একটি সুন্দর নির্বাচন করতে পারবে না- এটা আমি বিশ্বাস করি না। আসন্ন নির্বাচন পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবমুখর হোক, আমরা নেচে-গেয়ে বলে উঠি, ‘আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!’
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক