• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯
দ্বিতীয় দিনেও সড়কে নৈরাজ্য

দুই দিন বয়সী নবজাতক শিশুকে হাসপাতালে নিতে না পারায় বাবার কোলেই মারা গেছে

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ

দ্বিতীয় দিনেও সড়কে নৈরাজ্য

বাবার কোলেই দুই দিনের শিশুর মৃত্যু

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩০ অক্টোবর ২০১৮

সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন গতকাল সোমবারও সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এ দিন শ্রমিকরা গত রোববারের চেয়েও বেশি ‘ঔদ্ধত্য’ দেখিয়েছে।

আট দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিন ছিল গতকাল। এ দিনও সারা দেশে দূরপাল্লার বাস ও পণ্যবাহী যানচলাচল বন্ধ ছিল। নগর পরিবহন বন্ধ রাখায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে অফিসগামী যাত্রী ও জরুরি কাজে রাস্তায় বেরুনো লোকজনকে পায়ে হেঁটে অথবা অতিরিক্ত ভাড়ায় মোটরসাইকেলসহ রিকশা-ভ্যানে যাতায়ত করতে হয়েছে।

এদিকে আটচল্লিশ ঘণ্টার ধর্মঘট শেষ হওয়ার আগে গতকাল সন্ধ্যায় পরিবহন শ্রমিক নেতা ওসমান আলী বাংলাদেশের খবরকে বলেছেন, তাদের দাবি মেনে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন না হলে আগামী মাসে ফের একই ধরনের কর্মসূচি দেবেন তারা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান বলেন, কাল (আজ মঙ্গলবার সকাল ৬টায়) আমাদের কর্মসূচি আপাতত শেষ। এরপর আবার আমরা সরকারকে নোটিশ দেব। ২১ দিনের মধ্যে যদি সরকার দাবি না মানে তাহলে ৯৬ ঘণ্টার কর্মসূচি দেব। পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ৩ নভেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে নোটিশ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

দুই দিনের ধর্মঘটে রাজধানীতে বাস বন্ধ থাকলেও ব্যক্তিগত গাড়ি, অটোরিকশা ও রিকশা চলাচল করে রাস্তায়। আগের দিনের মতো গতকালও ঢাকায় বিআরটিসির বাস সীমিত আকারে চলাচল করে। অটোরিকশা এবং রিকশাচালকদের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে দেখা যায়। অ্যাপভিত্তিক রাইডশেয়ারিং সার্ভিসের মোটরসাইকেল চালকদের অনেকের বিরুদ্ধে অ্যাপে না গিয়ে চুক্তিতে অতিরিক্ত ভাড়ায় যাত্রী নেওয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।

রোববারের মতো গতকালও রাজধানীর কয়েকটি এলাকায় পরিবহন শ্রমিকরা অবস্থান নেয়। তারা রাস্তায় বের হওয়া ব্যক্তিগত ও অন্যান্য যানবাহনের চালকদের নামিয়ে কান ধরে উঠবস করায়। ঢাকার বাইরে থেকে যাত্রী দুর্ভোগ এবং শ্রমিকদের ‘মারমুখী’ আচরণের খবর দিয়েছেন বাংলাদেশের খবরের প্রতিনিধিরা। ধর্মঘটের প্রথম দিন গত রোববার তারা বিভিন্ন স্থানে সাধারণ যাত্রী, মোটরসাইকেল চালক ও প্রাইভেটকার চালকদের মুখে পোড়া মবিল মাখিয়ে দেয়।

বাবার কোলে সন্তানের মৃত্যু : সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পরিবহন ধর্মঘটের মধ্যে এক দিন বয়সী নবজাতককে হাসপাতালে নিতে না পারায় বাবার কোলেই সে মারা গেছে। গতকাল দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের গনিগঞ্জ গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। শিশুটির বাবার নাম মইনুল ইসলাম।

স্থানীয়রা জানান, মইনুলের স্ত্রী সেলিনা বেগম গত রোববার রাতে নিজ বাড়িতে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। ঠান্ডাজনিত কারণে গতকাল সকালে নবজাতক অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবা মইনুল শিশুটিকে গনিগঞ্জ বাজারে পল্লী চিকিৎসকের কাছে নেন। পল্লী চিকিৎসক তাকে হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এ খবরে তিনি স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ীদের নিয়ে শ্রমিক নেতাদের কাছে যান। কিন্তু শ্রমিকরা জানান, বাচ্চা মারা গেলেও গাড়ি যেতে দেবে না। উল্টো তারা রাস্তা অবরোধ করে রাখে। এক পর্যায়ে দুপুর ১২টার দিকে বাবার কোলেই নবজাতকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানার ওসি ইখতিয়ার উদ্দিন জানান, থানায় অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স ও বরযাত্রীবাহী গাড়ি আটক : হবিগঞ্জের বাহুবলে সিলেটগামী একটি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স শ্রমিকরা আটকে দেয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের খবরের প্রতিনিধি। তারা বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাস এবং অসুস্থ শিশু বহনকারী একটি ভ্যান আটকে দেয়। বিকাল ৩টার দিকে হবিগঞ্জের বাহুবল থানার মিরপুরে ঢাকা থেকে সিলেটগামী লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে রাখে শ্রমিকরা। লাশ আছে দেখার পরও দেড় ঘণ্টা আটকে রাখা হয় অ্যাম্বুলেন্সটি। পরে সাংবাদিক ও স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদের অনুরোধে অ্যাম্বুলেন্সটি যেতে দেওয়া হয়।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের মতিগঞ্জে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে বরযাত্রীবাহী গাড়ির বহর আটকে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। দেড় ঘণ্টা পর তাদের গাড়ি ছাড়া হয়। এর আগে দুপুরে মৌলভীবাজারের মোকাম বাজারে অসুস্থ শিশু বহনকারী একটি ভ্যান আটকে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। শিশুর বাবার আকুতি-মিনতির মধ্যেই ভ্যানের চাকা পাংচার করে চলে যায় তারা।

এর আগে গত রোববার শ্রমিকরা হাসপাতালগামী অ্যাম্বুলেন্সকে মৌলভীবাজারে আটকে দিলে অসুস্থ এক শিশু মারা যায়।

কিছু স্থানে শ্রমিকরা মারমুখী : আমাদের রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে রূপগঞ্জের পৃথক স্থানে লেগুনা ও অটোরিকশা যাত্রীদের ওপর গতকাল শ্রমিকদের হামলা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সময় আট যাত্রী আহত হয়েছেন। আহতরা জানান, সকালে বরপা এলাকায় পরিবহন শ্রমিক বাবুল ও আজাহারসহ তাদের লোকজন একটি লেগুনা আটকে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আনোয়ার নামে এক যাত্রী প্রতিবাদ করলে পরিবহন শ্রমিকরা তাকেসহ বিল্লাল, আমান উল্লাহ ও সিদ্দিক নামে চার যাত্রীকে কিলঘুসি মেরে জখম করে। অপরদিকে বিশ্ব রোড এলাকায় পরিবহন শ্রমিক রাসেলসহ তাদের লোকজন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে যাত্রীদের নামাচ্ছিল। প্রতিবাদ করায় রেহেনা আক্তার, সালাম মিয়া, আকবর আলী ও শাকিলকে চরথাপ্পড় মারা হয়।

এদিকে ঢাকার অদূরে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় পরিবহন শ্রমিকরা লেগুনা ও অটোরিকশায় ভাঙচুর চালানোর পাশাপাশি যাত্রীদের হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি।

চবির শিক্ষকদের লাঞ্ছনা, ইবিতে পরীক্ষা স্থগিত : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছুদের জন্য বাস চলাচলে বাধা না দেওয়ার কথা দিলেও ওই রুটে গতকাল কোনো বাস চলতে দেয়নি শ্রমিকরা। ফলে পায়ে হেঁটে, সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশায় চড়ে শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের। এদিকে লাঞ্ছিত হয়েছেন চবির কয়েকজন শিক্ষক। মারধরের শিকার হয়েছেন শিক্ষকদের বহনকারী চবির এক বাসচালক। গতকাল সকাল ৮টার দিকে বহদ্দারহাট টার্মিনালে এই লাঞ্ছনা ও মারধরের ঘটনা ঘটে। মারধরের শিকার বাসচালকের নাম মোহাম্মদ দুলাল। বাসে থাকা আরবি বিভাগের শিক্ষক ড. কাজী হারুন-উর-রশীদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ইবি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দেশব্যাপী পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটে পরিবহননির্ভর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত দুই দিন ধরে অচল ছিল। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। এমনকি প্রশাসনিক কার্যক্রমেও অনেকটা স্থবিরতা দেখা দেয়। এ দুই দিনে স্থগিত হয় বিভিন্ন বিভাগের মোট ২৪টি চূড়ান্ত ও দেড় শতাধিক টিউটোরিয়াল পরীক্ষা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের প্রতিবাদ : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘটকে অবৈধ ও শ্রম আইনবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে এই ধর্মঘটের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মো. ইনসুর আলী এ দাবি জানান।

ঈশ্বরদীতে যুবকের মৃত্যু : পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার অবরোধে বাস বন্ধ থাকায় উপচেপড়া ভিড়ের কারণে ট্রেনের ছাদে চড়ে বাড়ি ফেরার পথে পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজের গার্ডারে ধাক্কা খেয়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ড্যানিয়েল সরকার (২৭) নামে এক যুবক। গত রোববার রাত সোয়া ৩টার দিকে চিত্রা এক্সপ্রেসে এ ঘটনা ঘটে। নিহত যুবক সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার গোনালী ইউনিয়নের খোকন সরকারের ছেলে। ঈশ্বরদী রেলওয়ে পুলিশের ওসি সুবীর দত্ত গতকাল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

যে কারণে ধর্মঘট : গত ২৯ জুলাই রাজধানীতে বাসচাপায় দুই স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকার দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা সড়ক পরিবহন আইন পাস করে। কিন্তু ওই আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সেগুলো বাতিল করার দাবি তুলেছে পরিবহন শ্রমিকরা।

তাদের দাবিগুলো হলো- সড়ক দুর্ঘটনার সব মামলা জামিনযোগ্য করা, দুর্ঘটনায় চালকের পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বাতিল, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করা, ৩০২ ধারার মামলার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা, পুলিশি হয়রানি বন্ধ, ওয়েট স্কেলে জরিমানা কমানো ও শাস্তি বাতিল এবং গাড়ি নিবন্ধনের সময় শ্রমিক ফেডারেশন প্রতিনিধির প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক করা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads