• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

বাংলাদেশ

সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে তোলপাড়

নারীপাচারে ইমিগ্রেশন পুলিশ!

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের কয়েকজন অসাধু পুলিশের সহায়তায় ব্রিটেনে এক তরুণীকে পাচারের অভিযোগ উঠেছে। তবে জালিয়াতি করে সিলেট বিমানবন্দর পার হলেও লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর পার হতে পারেনি। সেখান থেকে তাকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। দেশে এসে ওই তরুণী মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক তরুণকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহায়তা কামনা করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিয়ে করার কথা বলে সিলেটের ওই তরুণীকে (২২) যুক্তরাজ্যে পাচারের চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক জাইন দীন (৪৫)। ভুক্তভোগী তরুণীকে পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে রুবিনা নামে একটি ব্রিটিশ পাসপোর্ট।

ইমিগ্রেশন পুলিশের কয়েকজন অসাধু সদস্যের সহযোগিতায় ভুয়া পাসপোর্টে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পার করতে পারলেও লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে গিয়ে ধরা পড়েন ওই তরুণী। পাসপোর্ট আটক রেখে বিমানবন্দর থেকেই তাকে দেশে ফেরত পাঠায় লন্ডন পুলিশ। এ ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরত আসেন ঘটনার শিকার তরুণী। এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি সিলেট বিমানবন্দর থানায় জাইন দীন, মোকারম ও আশরাফ নামে তিন ব্যক্তির  বিরুদ্ধে মানবপাচারের আইনে মামলা করেন তিনি। সেই মামলার তদন্তে নেমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) অরো চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে।

সিআইডির সূত্র বলছে, ২০১৮ সালের শেষের দিকে লন্ডনি যুবক মোকাররম আলীর সঙ্গে প্রেম হয় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা থানা এলাকায় বসবাসকারী এই তরুণীর। মেয়েটির সঙ্গে মোকাররমকে পরিচয় করিয়ে দেন তার আত্মীয় আশরাফ ওরফে বেনু। মোকাররমের দেশের বাড়িও সিলেটে। তার বাবা লাল দীঘির পাড় হকার্স মার্কেটে কাপড়ের ব্যবসা করেন। তরুণী সিলেটের একটি সরকারি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী। প্রেমের এক পর্যায়ে মোকাররম তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। বিষয়টি কিছুদিনের মধ্যে মেয়ের পারিবারিক পর্যায়ে গড়ায়। মেয়েটির মা-বাবা সিদ্ধান্ত নেন, পরের বছর (২০১৯) ১৪  ফেব্রুয়ারি মোকাররমের কাছে লন্ডনে যাবেন তাদের মেয়ে। সেখানেই বিয়ের পর তারা সংসার করবেন। কিন্তু মোকাররম ছুটি না পাওয়ার অজুহাত দিয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক জাইন দীনের সঙ্গে তরুণীকে লন্ডন যেতে বলেন। পাসপোর্ট ও ভিসাসহ সব ব্যবস্থা করবেন জাইন দীন বলে মেয়েটিকে জানায় মোকাররম।

সিআইডি জানায়, ইংল্যান্ডে জন্ম নেওয়া জাইন দীনের বাড়িও সিলেটে। তবে তিনি বা তার কেউই দেশে থাকেন না। এর আগে তিনি তিন-চার বার দেশে এসেছিলেন।

সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, একই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ থেকে নারীপাচারের অভিজ্ঞতা তার আগেও ছিল। এই তরুণীকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ২০১৯ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি জাইন দীন বাংলাদেশে আসেন। তার পাসপোর্ট নম্বর ৫২১৫৬১৭০৫। পরে একই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভুক্তভোগী তরুণীকে নিয়ে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হন জাইন। যাত্রার আগে তরুণীর হাতে ধরিয়ে দেন অন্য এক নারীর ব্রিটিশ পাসপোর্ট।

২০১৯ সালে ২৩ ফেররুয়ারি দায়ের করা মামলার এজাহারে বাদী ওই তরুণী অভিযোগ করেন, তার কাছে থেকে মোকাররম পাসপোর্ট ও ভিসার জন্য শুধু ছবি নিয়েছিলেন। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি রুবিনা খাতুন নামে তার নিজের ছবি সম্বলিত একটি ব্রিটিশ পাসপোর্ট তাকে ধরিয়ে দেন জাইন দীন। সেই পাসপোর্টেই ১৪  ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টায় বিজি ৪০৬ বিমান যোগে সিলেট থেকে লন্ডন যান তারা। সিআইডি বলছে, বিমানবন্দরের সিসিটিভি ক্যামেরাতেও জাইন দীনের সঙ্গে এই নারীকে বিমানবন্দর পার হতে দেখা গেছে।

সিআইডি আরো জানায়, ২০১৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জাইন দীনের সঙ্গে রুবিনা নামে কোনো নারী দেশে আসেনি। তবে ব্রিটিশ ওই পাসপোর্টটি ইমিগ্রেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় এন্ট্রি করিয়ে নেন জাইন। পরবর্তীতে দেশে এন্ট্রি করা এই পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন ভুক্তভোগী তরুণী।

ইমিগ্রেশন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা

সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, ব্রিটিশ নারীর পাসপোর্ট দেশে এন্ট্রি করানো এবং তার ৬ দিন পর ওই ভুয়া পাসপোর্টের আড়ালে ভুক্তভোগী তরুণীকে বিদেশে পাঠানোর পেছনে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত থাকতে পারেন। কারণ, ইমিগ্রেশনের সহায়তা ছাড়া এ কাজ সম্ভব নয়। এ কাজে মোটা অঙ্কের টাকাও লেনদেন হয়েছে বলে ধারণা সিআইডির। বিনিময়ে অসদুপায় অবলম্বন করে মালিক ছাড়াই ই-পাসপোর্টটি এন্ট্রি দেখানো হয়েছে। পরে ভিকটিম তরুণীকে নিয়ে যাওয়ার দিন পাসপোর্টধারী ব্যক্তির নাম-পরিচয়  যাচাই না করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নারীপাচারের এ কাজে বিমানবন্দরে একই কর্মকর্তারা ডিউটিতে ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছে সিআইডি।

এদিকে এ ঘটনা ফাঁস হওয়ায় ইমিগ্রেশনে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে বিষয়টি আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে সিলেট বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন পুলিশের ওসি (এএসপি) সাইফুল ইসলাম জানান, এই বিষয়ে তার কিছুই জানা নেই। ওই সময়ে তিনি নিজে ডিউটে ছিলেন না।’

জাইন দীনকে ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি ভুক্তভোগী তরুণীর বরাত দিয়ে বলছে, এই তরুণী যখন লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছায়, সেখানকার ইমিগ্রেশন পার হতে গিয়ে ধরা পড়েন। ঠিক তখনই তার সঙ্গে থাকা জাইন দীন সটকে পড়েন। ব্রিটিশ পাসপোর্টটি রেখে দিয়ে তরুণীকে দেশে ফেরত পাঠায় লন্ডন পুলিশ। ২ লাখ ৬২ হাজার টাকা বিমান ভাড়া দিয়ে স্বজনরা তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন। সিআইডি তদন্তে নেমে প্রথমেই  ইন্টারপোলের মাধ্যমে লন্ডন পুলিশের কাছে জাইন দীন ও মোকাররম সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। দীর্ঘদিন পর লন্ডন পুলিশ জাইন দীনের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে সিআইডিকে মেইল করে।  জাইন দীন এ ঘটনার সঙ্গে কীভাবে জড়িত সিআইডির কাছে তা জানতে চেয়েছে লন্ডন পুলিশ।

এই মামলার তদারকি কর্মকর্তা সিআইডির  অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম আখতারুজ্জামান  বলেন, ‘আমরা লন্ডন পুলিশের কাছে থেকে চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি একটা মেইল পেয়েছি। ফিরতি মেইলে জাইন দীনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলতে চেয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে এ ঘটনার আরো বিস্তারিত জানা যাবে। মামলা তদন্তের স্বার্থে এখনই এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত বলতে পারছি না।’

অভিনব পদ্ধতিতে নারীপাচারের বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এ রকম ঘটনা যে শুধু এই একটা তা নয়, আরো কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়গুলো যাদের নজরদারি করার কথা, সেই জায়গায় সিস্টেমের বদলে মানুষটাই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যায়, তাহলে বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।  এসব ঘটনায় ইমিগ্রেশন পুলিশ যদি যুক্ত থাকে, তাদের জন্য শাস্তিটা আরো বেশি হওয়া উচিত। কেননা, যারা  দায়িত্বে আছেন, তারা যদি এগুলো ঘটান, তাহলে কীভাবে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সিলেটে থেকে যেহেতু লন্ডনে সরাসরি ফ্লাইট যায়, সে কারণে সিলেটে এমন ঘটনাও বেশি। সেক্ষেত্রে সিলেট ইমিগ্রেশন পুলিশকে ঢেলে সাজানো উচিত বলে আমি মনে করি।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads