• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক

ছবি : সংগৃহীত

যোগাযোগ

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক

জোড়াতালির সংস্কার

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ২৭ জুলাই ২০১৯

দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলমান বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ। এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ১১টি মহাসড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানায় সড়ক ও জনপথ (সওজ)। অধিদপ্তরটির আওতাধীন ১৩১টি রাস্তার বেশি ক্ষতি হয়েছে। আবার পানিতে মহাসড়ক ডুবে থাকায় কোনো কোনো অঞ্চলে যান চলাচল বন্ধ আছে। অনেক জায়গায় পানি নেমে গেলেও চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক। দুর্গত এলাকার জেলা ও গ্রামীণ সড়কও  বেহাল দশায়।

এর মাঝে আসন্ন কোরবানির ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি পোহাতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। অবশ্য যতটা সম্ভব ভোগান্তি কমাতে সংস্কারকাজ চলছে মহাসড়কগুলোতে। এ নিয়েও বিস্তর অভিযোগ আছে। ঈদের আগে তা শেষ হবে কি না, এ নিয়েও আছে সংশয়। আর জোড়াতালির এ সংস্কার বৃষ্টির মাঝে অল্প সময়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এর মাঝেই গত বুধবার সচিবালয়ে ঈদুল আজহার প্রস্তুতি, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক সংস্কার এবং সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, গত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহার আগেই সংস্কার করা হবে।

বন্যায় ক্ষতি ৪৫০ কিমি সড়ক-মহাসড়ক : এবারের বন্যায় প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের আওতাধীন ১৩১টি রাস্তার বেশি ক্ষতি হয়েছে। অনেক সড়কের ওপর দিয়ে এখনো পানি প্রবাহিত হচ্ছে। স্রোতের তোড়ে কয়েকটি সড়কের কিছু অংশ ভেঙে ভেসে গেছে। কোথাও আংশিক, কোথাও সড়ক-মহাসড়কে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বেশ কিছু সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশ কিছু সড়কে ভারী যান ও কিছু সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

বন্যায় সবচেয়ে বেশি রাস্তার ক্ষতি হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা। এ জেলার আওতায় অন্তত ৫০টি সড়ক ভেঙে গেছে। ক্ষতির দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে সিরাজগঞ্জ। এ জেলার ১৮৬ কিলোমিটার রাস্তা ভেঙে গেছে। এ জেলার ওপর দিয়ে বেশির ভাগ যানবাহন উত্তরবঙ্গে যাতায়াত করে। এর পরের স্থান রংপুর। এ জেলায় ৮৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক জরুরিভাবে মেরামত করতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০০ কোটি টাকা চেয়েছেন সংস্থাটির মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা।

সওজ কর্মকর্তারা জানান, উত্তরাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে সে তুলনায় ভালো রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো।

ঢাকা-টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে বড় গর্ত, জোড়াতালির সংস্কার : দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-টাঙ্গাইল বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক। এ সড়কে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৪টি জেলার যানবাহন চলাচল করে। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশব্যাপী বয়ে যাওয়া অতিবৃষ্টির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ মহাসড়কের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।

উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা অংশের প্রায় ২০০ মিটার এলাকায় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই এসব গর্তে পানি জমছে। ফলে মহাসড়কটিতে যানবাহন আর যাত্রীদের ভোগান্তির শেষ নেই। এতে আসন্ন কোরবানির ঈদে সড়ক দুর্ঘটনার শঙ্কায়ও বাড়ছে।

এ সমস্যা নিরসনে মহাসড়কের মেরামতকাজ শুরু করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ কর্তৃপক্ষ। তবে ইটের জোড়াতালিতে চলছে মেরামত। কাজটি শুধুই ঈদ মৌসুমে কর্তৃপক্ষের টাকা লুটপাটের একটি তৎপরতা বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ভোগান্তির শিকার পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিন দেখা যায়, মহাসড়কের এলেঙ্গা অংশের প্রায় ২০০ মিটার এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য বড় বড় গর্ত। গর্তে পানি জমে যাচ্ছে। ফলে মহাসড়কের এ অংশে গতি হারাচ্ছে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন। সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।

দেখা গেছে, ইট দিয়ে গর্ত মেরামতের কাজ করছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের শ্রমিকরা। যদিও গাড়ির চাকা অথবা বৃষ্টির পানিতে নিমিষেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এসব মেরামত।

এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে দায়িত্বরত টাঙ্গাইল ট্রাফিক পুলিশের টিএসআই রফিকুল ইসলাম জানান, ঢাকা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে প্রতিদিন গড়ে ১৪-১৫ হাজার ছোটবড় যানবাহন চলাচল করে। তবে এই খানাখন্দের জন্য এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে যানবাহনগুলো আসার পর একেবারে গতি কমিয়ে পারাপার হচ্ছে। এ কারণে সারিবদ্ধ পরিবহনে প্রায়ই সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।

এলেঙ্গা পৌরসভার মেয়র নূর এ আলম সিদ্দিকী জানান, মহাসড়কের প্রবেশদ্বার এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের এ সমস্যার কথা টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের একাধিক মিটিংয়ে বলেছি। মিটিং পরবর্তী সময়ে শুধু নিম্নমানের দায়সারা কাজ করার দায়িত্ব পালন করেছে সড়ক বিভাগ। তবে সঠিক কোনো সমাধান আসেনি।

টাঙ্গাইল সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিমুল এহসান জানান, কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে সৃষ্ট হওয়া গর্ত সাময়িকভাবে ইট দিয়ে মেরামত করা হচ্ছে। যাতে যান চলাচল স্বাভাবিক থাকে। তবে এ সমস্যা নিরসনে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকার ৩০০ মিটার রাস্তা পাকাকরণের কাজ খুব দ্রুতই শুরু হচ্ছে।

সড়কের ক্ষতি, প্রভাব পড়বে ঈদযাত্রায় : বন্যায় সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার প্রভাব পড়ার আশঙ্কা এবারের ঈদযাত্রায়। উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার বাড়িফেরা মানুষ পড়বেন সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে। এ অবস্থায় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে ডুবে যাওয়া সড়কগুলোতে এখনই ভারী যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পানি সরে যাওয়ার পর দুই সপ্তাহের মধ্যেই সব সড়ক সংস্কার করা সম্ভব হবে।

তবে এবার ভোগান্তিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে বাড়ির উদ্দেশে রাজধানী ছেড়ে যাওয়া কোটি মানুষের যাত্রায়। মহাসড়কের বেহাল দশায় আতঙ্কিত গণপরিবহন চালকরাও।

এদিকে বাসচালকরা বলছেন, বন্যায় সমস্যা বেশি। রাস্তাঘাট ভাঙা, চলতে কষ্ট হয়। সরকার ঠিক না করে দিলে ভাঙাচোরা দিয়ে যেতে হবে।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, বন্যার পরে এসব রাস্তা কিন্তু বিরাট একটা ঝুঁকির মধ্যে থেকে যায়। এটা রাস্তা নাকি চষা ক্ষেত সেটা বোঝা যায় না। একটা হচ্ছে পানি সরিয়ে ফেলা আর ওভার লোডিংয়ের ব্যবস্থা করা।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুস সবুর বলেন, সাত দিনের মধ্যে আমরা সব রাস্তা ঠিক করতে পারব। তবে শুধু টাঙ্গাইলের রাস্তাটায় সময় বেশি লাগবে। ওটায় একটা বড় বাঁধ আছে। এজন্য ১৫ দিন লাগবে।

সওজ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (প্ল্যানিং অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স উইং) আশরাফুল আলম বলেন, বন্যা মোকাবেলায় সব সময়ই সওজ অধিদপ্তর প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। প্রস্তুতি দুই ধরনের। একটা বন্যা-পূর্ববর্তী সময়ের জন্য। এ সময় যেসব স্থানে বন্যার কারণে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়, সেসব স্থানে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলায় কাজ করেন অধিদপ্তরের প্রকৌশলীরা। এর বাইরে বন্যা-পরবর্তী সময়ে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বন্যা মোকাবেলায় আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে। অর্থ বরাদ্দেও কোনো কমতি নেই। তবে কিছু এলাকা এখনো বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে। পানি না কমানো পর্যন্ত সেখানে কাজ করা কঠিন। তারপরও বন্যাদুর্গত এলাকাগুলো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও জরুরি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোস্তফা কামাল জানান, সম্প্রতি অতিবর্ষণ ও বন্যার ফলে দেশের যেসব সড়কে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে আমরা দ্রুততার সঙ্গে মেরামতসহ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এ ছাড়া সারা দেশে সড়কের সার্বিক দিক দেখভালের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে উচ্চপর্যায়ের মনিটরিং টিম কাজ শুরু করেছে। তারা শুক্র ও শনিবার দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিদর্শনের মাধ্যমে সার্বিক চিত্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে। আমরা যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে যা যা করা দরকার সব ধরনের ব্যবস্থাই করব।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশের জেলা-উপজেলায় বন্যায় যেসব রাস্তাঘাট, সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা ঈদের অন্তত এক সপ্তাহ আগেই সংস্কার শেষ করা হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads