• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ঝুঁকি নিয়ে ফিরছে বাড়ি

ছবি: বাংলাদেশের খবর

যোগাযোগ

ঝুঁকি নিয়ে ফিরছে বাড়ি

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০২১

রাস্তায় তীব্র যানজট। বাস স্টপেজে যাত্রীদের দীর্ঘ অপেক্ষা। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে গণপরিবহনে জোরজবরদস্তি করেই উঠছে কর্মজীবীরা। কেউ একা তো কেউ পুরো পরিবার নিয়ে লড়ছে বাসে ওঠার যুদ্ধে। এ যেন সাধারণ কোনো যাত্রা নয়। শহর ছেড়ে প্রাণপণে পালানোর চেষ্টা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে রাজধানীর ভেতরের বাস স্টপেজগুলোর দৃশ্যপট ছিল এমনই।

বিশ্বের কোথাও ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে আর কেউ দেখেনি এমন পরিস্থিতি। করোনা মহামারীতে বিশ্বজুড়ে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তাই দেশে-বিদেশে চলছে কঠোর লকডাউন। নইলে এখন তো বাস-লঞ্চ ও ট্রেনের টিকিট বিক্রির ধুম পড়ে যেত। বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন কিংবা লঞ্চঘাটে তিল ধারণের ঠাঁই থাকত না। মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শুধু টিকিট কাটে না, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়িও যায়।

করোনার ঊর্ধ্বগতি পরিস্থিতিতে এবার সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে গণপরিবহন। এসব গণপরিবহন শুধু জেলা শহরের মধ্যেই চলবে। তাই টিকিট কেটে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ নেই এবারো। কিন্তু তাতে দমে থাকেনি নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষগুলো। ঈদের আনন্দটুকুকে একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ বাড়ি যাওয়া। পবিত্র একটা দিন প্রিয়জনের হাতে একটা উপহার তুলে দেওয়ার আনন্দ। দিনগুলোকে পরিবারের সাথে একাকার করে দেওয়া। এই ভালোবাসা হয়তো পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের মানুষ বোঝেই না। তাই তো বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র ঈদযাত্রায় বিরল এক জাতি। 

২১ দিন পর গতকাল থেকে ঢাকাসহ দেশের জেলা শহরের মধ্যে গণপরিবহন চালু হয়েছে। তাই তিন সপ্তাহের বন্দিদশা কাটিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছে মানুষ। সব যাত্রীই সাধ্যমতো বহন করছেন একাধিক বড় বড় ব্যাগ। দ্বিতীয় দফায় কঠোর লকডাউন ঘোষণার পর ট্রাক, মাইক্রো, পিকাপসহ মুরগির খাঁচাযুক্ত গাড়িতে করেও ঢাকা ছেড়ে ছিল লাখো মানুষ। এরপরেও কর্মহীন কয়েক লাখ মানুষ প্রায় তিন সপ্তাহ ঢাকায় আটকে থাকে। তাই বিশেষ কায়দায় ঢাকা না ছাড়তে পারা মানুষগুলো এবার ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরছে। এক শহর থেকে অন্য শহরের প্রবেশ পথে গিয়ে গণপরিবহন পাল্টে-পাল্টে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে এসব মানুষ। 

সকাল থেকে রাজধানীর সীমান্তবর্তী বাস টার্মিনাল গাবতলী এলাকায় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার এই যুদ্ধটা যেন খুব সহজ নয়। পিকআপ, অটোরিকশা, সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেট ও মাক্রোবাসসহ যে যেমন করে পারছে সীমান্ত এলাকা পার হয়ে অন্য এলাকায় যাচ্ছে। এমন অবস্থা দেখা গেছে, ঢাকা-মাওয়া সড়কের সংযোগ পোস্তগোলা ব্রিজের শুরুতে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত এসে ওপার থেকে অন্য পরিবহনে যাচ্ছে মাওয়া ঘাটে। এমন অবস্থা দেশের সব জেলার সীমান্তবর্তী বাস টার্মিনালে।

সরেজমিন দেখা যায়, গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বাড়ি ফেরা মানুষের উপচেপড়া ভিড় তৈরি হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে চলমান লকডাউনের কারণে দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় মাইক্রো, প্রাইভেটকার, সিএনজিসহ নানা মাধ্যমে পাটুরিয়া ও আরিচাঘাট হয়ে মানুষ গ্রামের বাড়ি ফিরছেন। এ সুযোগে চড়া ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। অবৈধভাবে দূরপাল্লার রুটে যাত্রী বহনকারী এসব পরিবহন আটকে ট্রাফিক পুলিশকে মামলা দায়ের ও জরিমানা আদায় করতেও দেখা গেছে।

এখানে বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষায় থাকা তুষার আহমেদ বলেন, ঢাকায় আমি নিউমার্কেটে ফুটপাতে ব্যবসা করি। লকডাউনের কারণে বেচা-বিক্রি নাই। ঢাকা থেকে কি করব। তাই গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আজই ঢাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সকাল ১১টায় বের হয়ে এলিফেন্ট রোড থেকে গাবতলী এসেছি দুপুর দেড়টায়। তখন থেকে ঢাকা ছাড়ার বিকল্প গাড়ি খুঁজছি ।

কিভাবে যাবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাস না যাক। অনেক কিছুতে করেই যাচ্ছে মানুষ। আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ, আমি ঢাকা থেকে বের হতে পারলেই ভেঙে ভেঙে যেতে পারব।  যত কষ্ট হোক, ঈদ বাড়িতেই করতে চাই।

বাড়ি ফিরতে চাওয়া চল্লিশোর্ধ্ব আসমা বেগমকে এক পিকআপের হেলপারের সাথে কথা বলা শেষ করে হেটে ব্রিজ পার হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই পারে গিয়া গাড়িত উঠুম। এই পারে টেরাকে (ট্রাকে) উঠলে টেরাফিক (ট্রাফিক) পুলিশ ধরব।

গাবতলী ব্রিজ পার হয়ে আমীনবাজার বাসস্ট্যান্ডের আগে গেলেই দেখা মেলে বাস্তব চিত্র। পণ্যবাহী ট্রাক, পিকআপ, মিনি পিকআপ ভরে ভরে বিশেষ কায়দায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, নানা নিরাপত্তা ঝুঁকি উপেক্ষা করে নিম্নআয়ের এসব মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন। অনেকে প্রাইভেটকার ভাড়া করে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন।

একটু সচ্ছল যারা তারা যাচ্ছেন বিভিন্ন প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস ভাড়া করে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তারা ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকেই যাত্রা শুরু করতে পারছেন। তবে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড ও মাজার রোড এলাকা থেকে তাৎক্ষণিক এসব পরিবহন ভাড়া করেও যাচ্ছেন অনেকেই। এমন একজন নূর হোসেন। তিনি তার মা ও বোনকে নিয়ে দিনাজপুর যাবেন। তাই এদিকে এসে একটি মাইক্রোবাসের সাথে কথা বলেছেন। তিনজনের জন্য সারে সাত হাজার টাকা ভাড়ায় দিনাজপুর পৌঁছে দেবে এমন কথা হয়েছে সেই মাইক্রোবাস চালকের সাথে। মোট সাতজন নিয়ে যাবে ওই মাইক্রোতে। প্রায় ১৫ হাজার টাকায় মাইক্রোবাসটি ভাড়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

রাজবাড়ী প্রতিনিধি জানায়, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটজুড়ে ছোট গাড়ি ও যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো তোয়াক্কা করছে না কেউ। গাদাগাদি করে গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে যাত্রীরা। এসময় ঘাটে ছোট গাড়ির চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে।

দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘবিরতির পর শুরু হয়েছে স্থানীয় যাত্রীবাহী পরিবহনগুলোর চলাচল। ঘরমুখী হচ্ছে সাধারণ মানুষ। স্থানীয় গণপরিবহন থাকলেও ছোট গাড়ির চাপ বেশি রয়েছে। এ সময় ভাড়ায় চলাচল করছে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, অটো এবং মোটরসাইকেল। এদিকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় ঘরমুখী যাত্রীরা নদী পার হচ্ছেন ফেরিতেই। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাকে তোয়াক্কা না করেই হাজার হাজার মানুষ পার হচ্ছেন স্পিডবোটে করেও। 

গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্টরা জানান, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে অবৈধভাবে যেসব মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে, তাদের আটক করে যাত্রী নামিয়ে ৩ হাজার টাকা জরিমানার মামলা দায়ের করা হচ্ছে। তবে জনবল সংকটের কারণে এখানে যে পরিমাণ গাড়ির চাপ তা সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তাই সুযোগে কেউ কেউ যাত্রী নিয়ে চলে যেতে পারছেন।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেছেন, অবৈধ পন্থায় যাতে কোনোভাবে যাত্রী পরিবহন না হয় সেদিকে কড়া নজরদারি রয়েছে। মাঠে বিআরটিএসহ পুলিশ কাজ করছে। প্রয়োজনে জেলা পর্যায়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। যেখানে অনিয়ম, সেখানে ব্যবস্থা নিতে হবে। কাউকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। গণপরিবহন পরিচালনায় সরকার যখন যে নির্দেশনা দেবে, তা কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads