• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

খুলছে বঙ্গবন্ধু টানেল

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০২১

পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়ার পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেল সরকারের অন্যতম মেগাপ্রকল্প কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। আগামী শুক্রবার মধ্যরাতে টানেলটির দ্বিতীয় মুখ উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভা (একনেক) শেষে এ তথ্য জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক সভায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক প্রধান শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে নির্বাচনি সমাবেশে এই টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বছরই আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসার পর এই টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

কর্ণফুলী নদী দেশের বাণিজ্যিক নগরী চট্টগ্রামকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে। এই নদীর ওপর ইতোমধ্যে তিনটি সেতু নির্মিত হলেও গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলের জন্য তা যথেষ্ট নয়। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর ওপর সেতু নির্মাণে তলদেশে পলি জমে সমস্যা তৈরি করে যা চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য বড় হুমকি। এই সমস্যার মোকাবিলায় কর্ণফুলীতে নতুন কোনো সেতু নির্মাণ না করে তলদেশে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

অবশেষে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১২ সালে সেতু কর্তৃপক্ষ, সিসিসিসিএল ও অভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে টানেল নির্মাণের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করে। এরপর ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীন সরকারই সিসিসিসিএলকে এই টানেল নির্মাণের জন্য মনোনীত করে। এবিষয়ে ২০১৪ সালের ৩০ জুন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সিসিসিসির মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয়।

এরপর ২০১৫ সালে হাতে নেওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন রয়েছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এছাড়া ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা অর্থায়ন করছে চীন সরকার।

এই টানেলটি চার লেন বিশিষ্ট দুটি টিউব সম্বলিত ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। নদীর তলদেশে প্রতিটি টিউব চওড়া ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট এবং উচ্চতা ৪ দশমিক ৮ মিটার বা অন্তত ১৬ ফুট। একটি টিউব থেকে অপর টিউবের পাশাপাশি দূরত্ব ১২ মিটার। টানেলের প্রস্থ ৭০০ মিটার এবং দৈর্ঘ্য তিন হাজার ৪০০ মিটার। এছাড়া টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার এপ্রোচ রোড এবং ৭২৭ মিটার ওভার ব্রিজ সম্পন্ন টানেলটি চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করবে।

ফিজিবিলিটি স্টাডি প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্ণফুলী টানেল চালুর প্রথম বছর ৬৩ লাখ গাড়ি টানেলের নিচ দিয়ে চলাচল করবে। যেটি ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে দেড় কোটিতে গিয়ে দাঁড়াবে। চালুর প্রথম বছরে চলাচলকারী গাড়ির প্রায় ৫১ শতাংশ হবে কনটেইনার পরিবহনকারী ট্রেইলর ও বিভিন্ন ধরনের ট্রাক ও ভ্যান। বাকি ৪৯ শতাংশের মধ্যে ১৩ লাখ বাস ও মিনিবাস। আর ১২ লাখ কার, জিপ ও বিভিন্ন ছোট গাড়ি চলাচল করবে।

দেশে প্রথমবারের মতো কোনো নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন এই টানেলের নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এটি নির্মিত হলে দেশের জিডিপি শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বর্তমানে টানেল প্রকল্পকে ঘিরে দক্ষিণ চট্টপ্রামে ইকোনমিক জোনসহ বিশাল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড), বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বড় সার কারখানা (কাফকো), চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা লিমিটেডে (সিইউএফএল) এবং চট্টগ্রাম বন্দর কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি স্টেশনসহ বহু শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে।

এছাড়া মিয়ানমার হয়ে প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযুক্তিসহ ৭টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে টানেল নির্মাণকাজ। টানেল নির্মাণে চট্টগ্রাম শহরসহ সারা দেশের সঙ্গে কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত যোগাযোগব্যবস্থার সহজতর করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

জানা গেছে, কর্ণফুলী টানেলকে ঘিরে চীনের সাংহাই সিটির মতো চট্টগ্রামে গড়ে তোলা হচ্ছে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’। এতে উন্মোচিত হতে যাচ্ছে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার। যার ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা বদলে যাবে। কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হলে আশপাশে শিল্পোন্নয়ন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং সহজ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। ফলে দারিদ্র দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ফিনান্সিয়াল ও ইকোনোমিক আইআরআর এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এছাড়া ফিনান্সিয়াল ও ইকোনোমিক ‘বেনিফিট কস্ট রেশিও (বিসিআর)’ এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ১ দশমিক শূন্য ৫ এবং ১ দশমিক ৫। ফলে কর্ণফুলী টানেল চালু হলে জিডিপিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এটা সরকারের জন্য অবশ্যই অনেক বড় আনন্দের ব্যাপার। প্রায় কথা উঠেছে, কোনো প্রকল্প সময় মতো শেষ হয় না, আগায় না। এটি একটি বড় অভিযোগ। এ প্রকল্পে তেমনটি হয়নি, সময়ের আগেই শেষ হচ্ছে। মূলকাজ এখন শেষ হচ্ছে। তবে আরো অনেক কাজ বাকি আছে।

মন্ত্রী জানান, আমাদের বঙ্গবন্ধু টানেল আমাদের স্বপ্নের অন্যতম বড় মেগাপ্রকল্প, রোমাঞ্চকর প্রকল্প। এটা ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে তার আগেই শেষ হয়ে যাবে বলে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা একনেক বৈঠকে জানিয়েছেন।

সভায় কর্ণফুলী টানেল নিয়ে আলোচনা হয় জানিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘প্রকল্পটির কাজ আগেভাগেই শেষ হবে। আগামী শুক্রবার এর দ্বিতীয় মুখ খুলে যাবে। একটা মুখ তো আগে খুলেছিল, দ্বিতীয়টিও খুলে দেওয়া হবে। এতে আমাদের আসা-যাওয়ার পথ পুরোটাই উন্মুক্ত হবে, এক হবে। আশা ছিল, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এটি উদ্বোধন হবে। এখন আশা করা হচ্ছে, এত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, তার অনেক আগেই উদ্বোধন করা যাবে। তবে সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছি না, এটা কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads