• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

যোগাযোগ

লোকসানে এমভি বাঙালি!

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ১৯ এপ্রিল ২০২২

উদ্বোধনের পর থেকেই প্রতিদিন গড়ে ২ লাখ টাকা করে মাসে ৬০ লাখ টাকা লোকসান দিচ্ছে যাত্রীবাহী জাহাজ ‘এমভি বাঙালি’। কিন্তু এ  লোকসানকে পরিকল্পিত বলে অভিযোগ তুলেছেন অনেকে। ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ জাহাজটি উদ্বোধন করা হয়। এরপর থেকে বছরে লোকসান হয় ৬ কোটি ২০ লাখ। এ হিসেবে অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ( আট বছরে)  লোকাসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

জানা গেছে, লোকসানের নামে বিপুল অঙ্কের টাকার ভাগ এমভি বাঙালি জাহাজের সুকানি  থেকে ক্যান্টিন, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) কর্মকর্তা পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। শুধু বাঙালি নয়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) বর্তমানে অস্ট্রিচ, মাহসুদ, টার্ন,  লেপচা ও শিলা নামের জাহাজেও  লোকসান হচ্ছে।

এসব জাহাজেও প্রতিদিন গড়ে ৫০ হাজার টাকার  লোকসান হলে এই ৫টি জাহাজ মাসে ৭৫ লাখ টাকা  লোকসান দিয়ে আসছে। এভাবে বছরের পর  কোটি  কোটি  লোকসান দিয়ে রাষ্ট্রীয় এ জাহাজগুলো চালানো হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস হয়ে যাবে বলে অনেকে মনে করছেন। গত কয়েকদিন বাদামতলী ঘাট সরেজমিনে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব চিত্র পাওয়া গেছে।

জানা  গেছে,  তেল অপচয়, এমভি জাহাজে ৪০ জন স্টাফের  বেতন, অন্যান্য জাহাজের স্টাফদের খচর, জাহাজ  মেরামত, যাত্রী কম  দেখানো, জাহাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের নামে এই বিপুল অঙ্কের টাকা  লোকাসান  দেখানো হয়। বিআইডব্লিউটিসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এমভি বাঙালি রাত সাড়ে ৮টায় বাদামতলী ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও যাত্রী কমের অজুহাতে ৬টায়  ছেড়ে যায় বরিশালের  মোড়লগঞ্জের উদ্দেশে। পথে  মেঘনা ঘাটে গিয়ে এক  থেকে  দেড় ঘণ্টা বসে থাকে  মেঘনা এক্সপ্রেসের যাত্রী  নেওয়ার জন্য। এ ঘাট  থেকে বাঙালির ধারন ক্ষমতার  বেশি যাত্রী ওঠে। অনেক সময় অতিরিক্ত টাকার লোভে জাহাজের ক্যাপ্টেন, মাস্টারসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের  কেবিন পর্যন্ত ভাড়া দিয়ে  দেওয়া হয়।

‘এমভি বাঙালি’ জাহাজের যাত্রী ধারণক্ষমতা ৭৫০ জন। এর মধ্যে ভিআইপি/ফ্যামিলি স্যুট  কেবিন ৪টি, প্রথম  শ্রেণি ডাবল  কেবিন ৩৪টি, সিঙ্গেল  কেবিন ০৪টি, দ্বিতীয়  শ্রেণি ডাবল  কেবিন ১৮টি, দ্বিতীয়  শ্রেণি  চেয়ার ৮৪টি, ৩য়  শ্রেণি ( ডেক) ৫৫০ জন। সবমিলে  মেঘনা ঘাট  থেকেই এক  থেকে  দেড় হাজার যাত্রী হয়। ‘এমভি বাঙালি’ জাহাজটির  দৈর্ঘ ৭৫.৭৫ মিটার, প্রস্থ ১২.৫০ মিটার, উচ্চতা ৩.০০ মিটার এবং গভীরতা ১.৬০ মিটার। এর  বেগ ঘণ্টায় ১১.৫০ নটিক্যাল মাইল।

বাদামতলী ঘাট ও এমভি বাঙালি জাহাজ সরজমিনে জানা  গেছে, দীর্ঘ ৭৫ বছর পর বিআইডব্লিউটিসির যাত্রীবাহী জাহাজ বহরে যুক্ত নতুন জাহাজটি উদ্বোধনের ২৯ দিনের মাথায় ক্রটি  দেখা দেয়। পাঠানো হয় নারায়গঞ্জের ডকইয়ার্ডে। ১৫ দিন চলে সংস্কার কাজ।

সরেজমিনে কথা হয় এমভি জাহাজের সাবেক ক্যাপ্টেন লুৎফর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, বাঙালি জাহাজের  ডেক যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত নিচতলার চারদিকে আটকানো থাকায় যাত্রীদের উপস্থিতিতে স্থানটি অতিরিক্ত গরম হয়ে পড়ে। ফলে অসহনীয় গরমে  ডেকে যাত্রী কমে যাচ্ছিল। নিচতলায় এই প্রচন্ড গরমের বিষয়টি যাত্রীরা লিখিতভাবে বিআইডব্লিউটিসির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। তিনি আরো জানান, যাত্রীদের বসার  চেয়ারগুলো আরামদায়ক নয়, দ্বিতীয়  শ্রেণির  কেবিনগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়।

এছাড়া জাহাজের বিভিন্ন সমস্যার কারণে যাত্রী কম হয়। কিন্তু বরিশালের  মোড়লগঞ্জের আবুল  হোসেন নামে এক যাত্রী বিরোধিতা করে বলেন, জাহাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাই পকেট ভারি করার ফন্দিতে থাকেন। বাদামতলী ঘাট  থেকে কাগজপত্রে  দেখানো হয় যাত্রী কম। কিন্তু  মেঘনা ঘাট  থেকে শত শত যাত্রী ওঠানো হয়। ওই যাত্রীদের ভাড়ার টাকা সবাই মিলে ভাগ করে নেয়।

বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা  গেছে, ৮০ বছরের পুরনো ৫টি জাহাজ ও ১০টি সি ট্রাক দিয়ে যাত্রী সার্ভিস পরিচালনা করে সংস্থাটি। কিন্তু জাহাজগুলোর প্রতিটিই  মেয়াদোত্তীর্ণ পুরনো ও লক্কর ঝক্কর মার্কা।  কোনটি ৫০ থেকে ৮০ বছরের পুরনো। বয়সের ভাবে নূয়ে পড়া এসব জাহাজ দিয়ে যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। বেশিরভাগ সময় এসব জাহাজ  মেরামতের নামে  কোটি  কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়।

জানা গেছে, রকেট জাহাজ হিসেবে পরিচিত অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহনের প্যাডেল জলযানগুলোর ইঞ্জিন প্রথম দিকে কয়লাচালিত ছিল। পরে এগুলো ডিজেলে রূপান্তর করা হয়। রূপান্তরিত ইঞ্জিনও এরই মধ্যে  মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে  গেছে। বাঙ্গালী-২ এ জাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো পিএস মাসুদ ও পিএস অস্ট্রিচ। এ দুটি জাহাজ  তৈরি হয়েছে ১৯২৯ সালে। এ হিসাবে জাহাজ দুটির বয়স ৮৪ বছর। তবে পিএস মাসুদের ১৯৮৩ ও পিএস অস্ট্রিচের ইঞ্জিন ১৯৮৫ সালে ডিজেলে রূপান্তর করা হয়। পিএস  লেপচার নির্মাণকাল ১৯৩৮ আর ডিজেলে রূপান্তর হয় ১৯৮৩ সালে। পিএস টার্নের নির্মাণকাল ১৯৫০ ও ডিজেলে রূপান্তর হয় ২০০২ সালে।

এছাড়া এমভি সেলা নির্মিত হয় ১৯৫১ সালে। এর ইঞ্জিন ডিজেলে রূপান্তর হয় ১৯৮৮ সালে। এমভি সোনারগাঁওয়ের নির্মাণকাল ১৯৮২ ও পুনর্নির্মাণকাল ২০০৯। এদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় প্রতি বছরই এসব নৌযান মেরামতে বিআইডব্লিউটিসিকে ব্যয় করতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। ২০০৯-১০  থেকে ২০১১-১২ অর্থবছরে  ছোট-বড় ২১টি  নৌযান  মেরামতে সংস্থাটির খরচ হয়েছে ১২ কোটি ২৬ লাখ ৬ হাজার ৭৯৬ টাকা। এর মধ্যে ২০১১-১২ অর্থবছরেই খরচ হয়েছে ৫ কোটি ৪৩ লাখ ৮ হাজার ৯৭০ টাকা।

এছাড়া ২০১০-১১ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৩  কোটি ৯১ লাখ ৯৬ হাজার ৯৬০ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে ২ কোটি ৯১ লাখ ৮৬৬ টাকা। জানা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে যাত্রীবাহী স্টিমার পিএস লেপচা মেরামতেই বিআইডব্লিউটিসির ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৯৪ লাখ ৪৪ হাজার ৯০৭ টাকা। একইভাবে ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে পিএস অস্ট্রিচ  মেরামতে ১ কোটি ৬৯ লাখ ৭১ হাজার ৩৩৮ টাকা ব্যয় দেখানো হয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে এমভি  সোনারগাঁও  মেরামতে ব্যয় হয় ২ লাখ ৯৪ হাজার ৯৪০ টাকা। এ ভাবে প্রতি অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় দেখানো হচ্ছে। বিআইডব্লিউটিসির অন্যান্য  নৌযান  যেমন পিএস মাসুদ, পিএস টার্ন, এমভি  সেলা, এমভি  সোনারতরী  মেরামতেও প্রতি বছর বড় অঙ্কের অর্থব্যয়  দেখানো হচ্ছে। এভাবেই  লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে বছরের পর বছর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিসির এক কর্মকর্তা জানান, গত  ফেব্রুয়ারি মাসে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এমভি বাঙালি জাহাজটি বিআইডব্লিউটিসির কাছে হস্তান্তর করে। ডিসেম্বরে হস্তান্তর করার কথা থাকলেও নকশায় পরিবর্তন আনায় হস্তান্তর করতে কিছুটা  দেরী হয়। পরিবর্তিত নকশা অনুযায়ী জাহাজ দুটির সামনে নতুন করে ব্যালকনি যুক্ত করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, সড়কের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নদীপথে যাত্রীসেবা দিতে নতুন দুটি জাহাজ বানানো হয়েছে। এর আগে ২০১২ সালের অক্টোবরে জাহাজ দুটি নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিআইডব্লিউটিসির অর্থায়নে জাহাজ দুটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৫১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে জানার জন্য বিআইডব্লিটিসির চেয়ারম্যান আহমদ শামীম আল রাজীর (অতিরিক্ত সচিব) সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তার কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads