• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

প্রশ্নফাঁসে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইস

ফাইল ছবি

অপরাধ

ভয়ঙ্কর কাণ্ড

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৮ এপ্রিল ২০১৮

কী ভয়ঙ্কর! সর্বনাশা কাণ্ড। শুনলেই গা শিউরে ওঠে। বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা হয়েও তাদের কাছে এসব বিষয় কোনো অপরাধই নয়, বরং টাকা কামানোর মেশিন। কোনো অনুশোচনায় ভোগা ছাড়াই দিনের পর দিন এসব ন্যক্কারজনক কাজ করে গেছে এই চক্র। কাজটি নির্বিঘ্নে করার জন্য প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় চলে আসত চক্রের সদস্যরা। শুক্রবারে করত প্রশ্নপত্র ফাঁস। এর আগে নির্দ্বিধায় এমন কর্ম করে এলেও চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় তা আর করতে পারেনি তারা। শেষ পর্যন্ত খেলো ‘ধরা’। পুলিশের হাতে ‘পাকড়াও’ হওয়ার পরই তাদের এই অপকর্মগুলো সামনে আসতে শুরু করে। তবে চক্রের মূল ‘পাণ্ডা’কে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এই ‘পাণ্ডা’ ভয়ঙ্কর ধূর্ত। সে কখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা আবার কখনো সরকারি কর্মকর্তা আবার কখনো ফেরিওয়ালা। পুলিশ এখন তাকেই হন্যে হয়ে খুঁজছে।

এই জালিয়াত চক্র বিসিএস, মেডিকেলে ভর্তি ও ব্যাংকের নিয়োগসহ সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করত। কোনো কারণে আগেভাগে না পারলেও পরীক্ষা শুরুর ৫ মিনিটের মধ্যে ওই ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বাইরে ফাঁস করে দেওয়া হতো। এরপর বাইরে থাকা প্রশ্ন এক্সপার্টদের মাধ্যমে ডিভাইসের সঙ্গে সংযুক্ত কানে লাগানো ক্ষুদে হেডফোনে এমসিকিউ বৃত্ত ভরাট করত চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থীরা।

অন্যদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন এহসানুল কবির। তিনি রংপুর কোতোয়ালি থানার ওসি বাবুল মিয়ার ছেলে। গ্রেফতার হওয়ার পর এহসানুল প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আর তার বাবা বাবুল মিয়া বলেছেন, ‘আমার ছেলে বোকাসোকা। তাকে একটি চক্র ফাঁসিয়েছে।’ 
 Trap

এদিকে শনিবার দুপুরে রাজধানীর ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন লোমহর্ষক তথ্য জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন। এ সময় ডিবির (উত্তর বিভাগ) এডিসি গোলাম সাকলাইন সিথিল জানান, ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংক, সরকারি চাকরি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত এক প্রভাবশালী চক্রের ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে শুক্রবার রাতে রাজধানীর মিরপুর, নিউমার্কেট ও ফার্মগেট এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ক্ষুদে ব্যাটারি, ইয়ারফোন, মোবাইল ফোনের মতো কথা বলার সিমযুক্ত মাস্টারকার্ড জব্দ করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে তিনজনই ব্যাংক কর্মকর্তা। তারা হলেন পটুয়াখালী সোনালী ব্যাংকের আইটি অফিসার অসীম কুমার দাস, হবিগঞ্জের পূবালী ব্যাংকের প্রবেশনারি অফিসার মো. মনিরুল ইসলাম ওরফে সুমন এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রবেশনারি অফিসার মো. সোহেল আকন্দ। এদের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন মো. জহিরুল ইসলাম, সাদ্দাদুর রহমান ওরফে সোহান, নাদিমুল ইসলাম, মো. এনামুল হক ওরফে শিশির, শেখ তারিকুজ্জামান, অর্ণব চক্রবর্তী ও আরিফুর রহমান ওরফে শাহিন। সবাই এখন পুলিশের হাতে বন্দি।

সংবাদ সম্মেলনে আবদুল বাতেন বলেন, জনৈক পুলকেশ দাস ওরফে বাচ্চু এই চক্রের মূল পাণ্ডা। তার বিশ্বস্ত সহযোগী জনৈক কার্জন। কার্জন পরীক্ষায় জালিয়াতির জন্য বিশেষ ডিভাইসগুলো সরবরাহ করে। আবদুল বাতেন বলেন, চক্রের সদস্যরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তিনটি কাজ করে থাকে। পরীক্ষায় পাস করানোর জন্য মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হতে আগ্রহী পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কয়েকজন। চক্রের আরেক অংশ পরীক্ষা শুরুর পর কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার জন্য ডিভাইস ব্যবহার ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আরেকটি অংশ ডিভাইস সরবরাহে সহযোগিতা করে।

আবদুল বাতেন প্রশ্ন সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে বলেন, এদের প্রযুক্তি এতই সুনিপুণ যে, কার্ডের সাহায্যে শুধু ‘ইনকামিং কল’ হয়। সেই কল অটো রিসিভ হয়ে যায়। ওপার থেকে উত্তর শুনে সেট কোড মিলিয়ে শুধু চুক্তিবদ্ধ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়। বিশেষ করে এমসিকিউ অংশের প্রশ্ন সমাধানের জন্য এই প্রযুক্তির ব্যবহার হয়ে থাকে। তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে এ ব্যাপারে আরো তথ্য বেরিয়ে আসবে।

তিনি আরো জানান, প্রতারক চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত থাকলেও প্রতি শুক্রবার ঢাকায় এসে মিলিত হতো। পান্থপথে তাদের একটি ওয়ানস্টপ সেন্টার রয়েছে। যেখান থেকে কেন্দ্রে থাকা পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ, প্রশ্নপত্রের সমাধান ও উত্তর পাঠানোর কাজগুলো করা হয়। দীর্ঘদিন তারা বিভিন্ন নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষায় এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে জালিয়াতি করে আসছিল। চলতি এইচএসসি পরীক্ষায়ও এই ডিভাইস ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের চেষ্টা করেছিল। তারা সফল হওয়ার আগেই গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তিন ব্যাংক কর্মকর্তা জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি পেয়েছেন। তাদের দ্বারা আরো অনেকেই সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছে। পুলকেশ দাস বাচ্চু এই চক্রের মূল হোতা। তার বিশ্বস্ত সহযোগী কার্জনের সহযোগিতায় এই বিশেষ ডিভাইস সংগ্রহ করা হয়। অন্য সদস্যরা পরীক্ষার্থী সংগ্রহ, তাদের সঙ্গে চুক্তির কাজ করে। ৭-৮ বছর যাবৎ তারা এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।

আবদুল বাতেনের মতে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও রূপালী ব্যাংকে লোক নিয়োগে তারা ভূমিকা রেখেছে। প্রতি প্রার্থীর সঙ্গে তারা ৮-১০ লাখ টাকা চুক্তিতে কাজ করে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস ‘অ্যাসেম্বল’ করে এই চক্রটি আরেকটি ডিভাইস তৈরি করে। সেটি তারা পরীক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেয় এবং তা গোপনে বহন করতে বলে। এরপর পরীক্ষার প্রশ্ন সংগ্রহ করে তার উত্তর পরীক্ষার্থীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়। এই চক্রের মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে জালিয়াতি করে চাকরি পেয়েছে এমন লোকজনও রয়েছে। তারা নিজেরা জালিয়াতি করে চাকরি পেয়ে এখন একইভাবে লোকজনকে চাকরি দেবে বলে টাকা আদায় করছে। এবার তাদের টার্গেট ছিল এইচএসসি পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র সমাধান করে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। চক্রের অন্য সদস্যদেরও পুলিশ খুঁজছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads