• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
মৃত্যুভয়ে ১১তলা থেকে পাইপ বেয়ে নামে শাওন

গৃহকর্মী শিশু জাহিদুল ইসলাম শাওন

সংরক্ষিত ছবি

অপরাধ

মৃত্যুভয়ে ১১তলা থেকে পাইপ বেয়ে নামে শাওন

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২২ জুন ২০১৮

‘২০ তারিখের মধ্যে টাকা ফিরিয়ে না দিলে তোকে আগের মতো ইলেকট্রিক শক দেব। গ্রামে লোক পাঠিয়ে তোর বাবাকে ধরে আনব’- টানা সাত মাস ধরে শারীরিক নির্যাতন আর গৃহকর্তার শ্যালক মো. ইকবালের এমন হুমকি-ধমকিতে মৃত্যুভয় ঢুকে পড়ে ১২ বছরের গৃহকর্মী শিশু জাহিদুল ইসলাম শাওনের ভেতর। এ কারণে গত ২০ জুন আশ্রিত বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে।

অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বাড়িওয়ালা আর দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে বের হওয়া মুশকিল। তাই সন্ধ্যার পর বাথরুমে প্রবেশ করে ভেন্টিলেটর দিয়ে বের হয়ে প্লাস্টিকের পাইপ বেয়ে ১১তলা থেকে নিচে নেমে আসে সে। এলাকাবাসীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে টের পেয়ে যান গৃহকর্তা। এসে শাওনকে গার্ডরুমে আটকে মারধর শুরু করেন। বিষয়টি টের পেয়ে স্থানীয় একজন জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এ ফোন দেন। দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন পুলিশ সদস্যরা। আটক করা হয় তিনজনকে।

বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর রমনা থানায় কথা হয় শাওনের সঙ্গে। এ সময় শাওন তার ওপর চালানো রোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা দেয়। ওই ঘটনায় ইকবাল (গৃহকর্তার শ্যালক), তার স্ত্রী তামান্না খান ও তানজিলুর রহমানকে (ইকবালের ভাগ্নে ও গৃহকর্তার ছেলে) আটক করা হয়। তবে গৃহকর্তা ও তার স্ত্রী এখনো পলাতক রয়েছেন।

শাওন বলে, ‘ওই বাসায় পাঁচজন থাকত। সবাই আমাকে মারধর করত। একবার তাদের একটি সুটকেসের চাবি হারিয়ে যায়। তাদের ধারণা আমি চাবিটি চুরি করে টাকা নিয়েছি। এজন্য কখনো আমাকে রড দিয়ে কখনো বৈদ্যুতিক ক্যাবল দিয়ে পেটায়। একবার ইলেকট্রিক শকও দেয়। রড দিয়ে পিটিয়ে আমার পায়ের তালুও থেঁতলে দেওয়া হয়।’

শাওনের বাড়ি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থানার উত্তর সাহেবগঞ্জে। সে ফরিদগঞ্জের বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় পড়ত। তার বাবার নাম জাহাঙ্গীর হোসেন কালু। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় জাহাঙ্গীর তানজিলুরের দাদাকে দেখাশোনা করত। সেই সূত্রে শাওনকে ঢাকায় কাজ করতে পাঠায় জাহাঙ্গীর হোসেন।

শাওন গত সাত মাস ধরে রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনের ১২/এ, নম্বর বাড়ির ১১তলার ১১০২ নম্বর ফ্ল্যাটে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছিল।

শাওন বলে, ‘আমাকে ঢাকায় পড়াশোনা করানোর কথা বলে আনা হয়। কিন্তু পড়াশোনা তো দূরের কথা দিন-রাত ঘরের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। প্রতিদিনের বাজার থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা আমাকে দিয়ে করানো হয়নি। কাজের বিনিময়ে আমাকে কোনো টাকা দেওয়া হতো না।’

শাওন জানায়, ‘এক দিন বাসার একটি সুটকেসের চাবি হারিয়ে যায়। সুটকেসে নাকি অনেক টাকা ছিল। গৃহকর্তার শ্যালক ইকবালের ধারণা, আমি চাবি চুরি করেছি। তাই আমাকে চিকন রড দিয়ে মারধর করে। তার ভাগ্নে তানজিলুর ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকরি করছে। সেও এই কথা শুনে বাড়ি ফিরে আমাকে অনেক মারে। চাবি হারানোর পর এক দিন বলে, ১০ হাজার টাকা পাচ্ছে না, আরেক দিন বলে ২০ হাজার টাকা পাচ্ছে না। প্রতিদিনই আমাকে টাকার জন্য মারধর করত। ইকবাল এক দিন সবাইকে ডেকে আমাকে ইলেকট্রিক শক দেয়। টাকা চুরির কথা স্বীকার না করলে আবার শক দেওয়ার হুমকি দেয়। আমি ভয়ে বলি, আমিই টাকা চুরি করেছি। ওই ঘটনার কয়েক দিন পর ইকবাল নিজেই সুটকেসের চাবি খুঁজে পায়। এরপর আর কিছু বলেনি।’ খবর জাগোনিউজের।

মারধরের সময় আমি মাঝে মাঝে ফোনে বাবার সঙ্গে কিংবা গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতাম। তখন আমি যাতে নির্যাতনের কথা না বলতে পারি সেজন্য সবসময় আমার সামনে বসে থাকত তানজিলুর। এক দিন ফোনে কথা বলার আগে ছুরি এনে আমার গলায় ধরে রাখে। আমি যদি ফোনে মারধরের বিষয় বাড়িতে জানাই তাহলে আমাকে হত্যা করবে বলে হুমকি দেয়। আমি ভয়ে বাড়িতে কিছু বলিনি।

রোজার শেষের দিকে তারা আমার বিরুদ্ধে আড়াই লাখ টাকা চুরির অভিযোগ আনা হয়। যদিও আমি চুরি করিনি। ২০ জুনের মধ্যে টাকা ফিরিয়ে না দিলে আমাকে মারধর করবে আর বাবাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে বলে তারা হুমকি দেয়। ওই ভয়ে আমি বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে বেরিয়ে পাইপ বেয়ে নিচে নামি।

পাইপ বেয়ে নিচে নামার সময় ভয় লাগেনি? জানতে চাইলে শাওন বলে, ‘ছোটকালে গাছে উঠতাম। একটু অভ্যাস ছিল, ভয়ও লেগেছে। কিন্তু পাইপ বেয়ে না নামলে রাতে আমাকে অনেক অত্যাচার করা হতো। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিই।’

প্রাণ বাঁচাতে গত বুধবার রাতে পাইপ বেয়ে শাওন নিচে নেমে আসে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পড়ে যায়। এরপর শুরু হয় নতুন করে নির্যাতন। বিষয়টি স্থানীয় এক বাসিন্দার নজরে এলে তিনি ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন দিয়ে সহায়তা চান। তাৎক্ষণিক এগিয়ে আসে রমনা থানা পুলিশ। তারা অভিযান চালিয়ে ওই বাসার গার্ডরুম থেকে শাওনকে বন্দি অবস্থায় উদ্ধার করে।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত রমনা থানার এসআই মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমি তাকে উদ্ধার করতে গেলে তারা আমাকে ভুল তথ্য দেয়। নির্যাতনের শিকার শিশুকে চোর বলে আটকে রাখে। পরে বাড়িতে থাকা তিনজনকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা মারধরের কথা স্বীকার করে।’ শিশুটির হাতে-পায়ে, পায়ের তালুতে ও পিঠে নির্যাতনের দাগ রয়েছে। তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হবে বলে জানায় পুলিশ।

পুলিশের রমনা জোনের এডিসি এইচএম আজিমুল হক বলেন, আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নির্যাতনের বিষয়টি স্বীকার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের উপযুক্ত ধারায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে। ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আরো যারা যারা পলাতক আছেন তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads