• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
কুল রক্ষায় চুল কর্তন!

লক্ষ্মী রানী রায় (১৭) এক কিশোরীর মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

কুল রক্ষায় চুল কর্তন!

  • নীলফামারী প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১২ জুলাই ২০১৮

নীলফামারী সদর উপজেলায় জোর করে লক্ষ্মী রানী রায় (১৭) নামে এক কিশোরীর মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। রামনগর ইউনিয়নের ওই কিশোরী বলছে, ভিন্ন ধর্মের এক ছেলের সঙ্গে বাড়ি ছাড়ায় ‘হিন্দু শাস্ত্রমতে’ সোমবার গভীররাতে তাকে এভাবে প্রায়শ্চিত্ত করানো হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, পুরোহিত এবং মানবাধিকারকর্মীরাও বলছেন, ধর্মের দোহাই দিয়ে কাজটি করা ঠিক হয়নি; জড়িতদের বিচার হওয়া উচিত। এভাবে চুল কেটে কুল রক্ষা করা যায় না। তবে মেয়েটির মা বলছেন, এ নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। পুলিশ জানিয়েছে, এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলেন- রামনগর ইউনিয়নের সদানন্দ রায় (৩০), দীনবন্ধু রায় (৩২) ও পুষ্প কুমার রায় (২৮)।

এলাকাবাসী জানায়, গ্রামের প্রয়াত ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের মেয়ে লক্ষ্মী প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে গত ২ জুলাই বাড়ি ছেড়ে পাশের কচুকাটা ইউনিয়নের দুহুলী গ্রামের আবদুস সাত্তারের ছেলে রবিউল ইসলামের বাড়ি গিয়ে ওঠে। সেখানে অবস্থানকালে গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে ৯ জুলাই সোমবার রাতে তাকে বাড়িতে ফেরত নেওয়া হয়। তারপর ভোররাত ৪টায় তার মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়।

লক্ষ্মী রানী জানায়, ২০১৩ সাল থেকে জেলা শহরের পরচুলা তৈরির এক কারখানার শ্রমিক সে। কর্মস্থলে যাতায়াতের পথে অটোবাইকচালক রবিউলের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক হয় দেড় বছর আগে। গত ১ জুলাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সে রবিউলকে বিয়ে করে এবং পরদিন সে রবিউলের বাড়ি গিয়ে ওঠে। বিষয়টি দুই পরিবার মেনে না নেওয়ায় ৯ জুলাই রাতে রবিউলের বাড়িতে সালিশ হয়। সালিশের মাধ্যমে তাকে বাবারবাড়ি ফেরত আনা হয়।

লক্ষ্মী রানী বলে, ‘আমাকে আনার পর প্রতিবেশীরা প্রায়শ্চিত্ত করতে বলেন। এরপর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারা আমার মাথা ন্যাড়া করে দেন। বাধা দেওয়ায় মারধরও করা হয়। অনেক লোকের সামনে প্রতিবেশী দিনবন্ধু রায় ও সদানন্দ রায় ব্লেড দিয়ে আমার মাথা ন্যাড়া করে দেন।’ লক্ষ্মী রানীর মা বুলো বালা (৪৫) বলেন, মেয়ে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান ধর্মে গিয়েছিল। তাকে প্রতিবেশীরা ফিরিয়ে এনেছেন। মাথা ন্যাড়া করে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে তাকে প্রতিবেশীরা গ্রহণ করে নিয়েছে সমাজে। এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে কিশোরীর ঠাকুমা বিজো বালা রায় (৬৫) বলেন, ‘মেয়েটা তো নাবালক। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। নাড়িয়া না করেও ধর্মের প্রায়শ্চিত্ত করা যায়।’

সালিশে অংশ নেওয়া প্রতিবেশী বিবেকানন্দ রায়, কনক চন্দ্র রায়, সুধীর চন্দ্র রায়, সুরেশ চন্দ্র রায় বলেন, ওই কিশোরী হিন্দু ধর্ম ছেড়ে মুসলিম হয়েছিল। সেখান থেকে আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রায়শ্চিত্তের অংশ হিসেবে তার মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়েছে। এখন অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার প্রস্তুতি চলছে। এটা হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি। হিন্দুসমাজের লোকজন উপস্থিত থেকে ওই বিধান দিয়েছেন।

জানতে চাইলে রামনগর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রুহুল আমিন বলেন, ‘রবিউলের বাড়ি থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করে পরিবারের জিম্মাই দিই। ধর্মের দোহায় দিয়ে তারা যে কাজ করেছেন, তা ঠিক নয়। জনপ্রতিনিধি হিসেবে ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করেন তিনি।

নীলফামারী কেন্দ্রীয় কালীমন্দিরের পুরোহিত অশোক কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘সনাতন হিন্দু ধর্মে মাথা ন্যাড়া করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে- এমন নিয়ম নেই। বিধান মতে, চুলের অগ্রভাগে এক থেকে দেড় ইঞ্চি কেটে ফেলে যে যার প্রায়শ্চিত্ত করবে।’

মানবাধিকার কমিশন নীলফামারী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান দুলাল বলেন, ‘ধর্মের দোহায় দিয়ে প্রায়শ্চিত্তের নামে মেয়েটির মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া চরম মানবাধিকার লঙ্খন। যারা এটা করেছেন, তাদের প্রত্যেকের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া উচিত।

নীলফামারী সদর থানার ওসি বাবুল আকতার বলেন, ওই কিশোরীর মাথা ন্যাড়া করার ঘটনায় মঙ্গলবার রাত ২টায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads