• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯
কলেজের অবকাঠামো উন্নয়নে লুটপাট

কলেজের অবকাঠামো উন্নয়নে লুটপাট চলছে

সংরক্ষিত ছবি

অপরাধ

আইএমইডির প্রতিবেদন

কলেজের অবকাঠামো উন্নয়নে লুটপাট

# তিন বছরের প্রকল্পে লাগছে ৯ বছর # হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় # কাজের মান নিয়ে অসন্তোষ

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ২৭ আগস্ট ২০১৮

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় জেলা পর্যায়ে সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য ৭৯ হোস্টেল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। হোস্টেল নির্মাণসহ এসব কলেজের অবকাঠামো উন্নয়নের সময়সীমা ছিল ২০১৩ সাল পর্যন্ত। নির্ধারিত সময়ের পাঁচ বছর বেশি সময়ে নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে মাত্র চারটি হোস্টেলের। বিভিন্ন জটিলতায় পাঁচটির কাজ এখনো শুরু হয়নি। অধিকাংশ হোস্টেলের কাজ অর্ধেকে সীমাবদ্ধ আছে। ৫৮ ছাত্রী হোস্টেলের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কথা থাকলেও কাজ শুরু হয়নি ৫৫টির। ১০তলা ভিত্তির ১১ একাডেমিক ভবনের একটিরও কাজ শুরু হয়নি গত আট বছরে। ইতোমধ্যে শেষ হওয়া কিছু কাজের মান খুবই খারাপ। নির্মাণের পরপরই টাইলস খসে পড়েছে অনেক ভবনের। এক কথায় কলেজের অবকাঠামো উন্নয়নে লুটপাট চলছে। এসব কলেজের উন্নয়নে নেওয়া এক প্রকল্পে এমনই বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানিয়েছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।

বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তিন বছরের জন্য নেওয়া প্রকল্পে দুই দফায় ছয় বছর বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে নেওয়া প্রকল্পটির সময় দুবার বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি। দেড় বছরের কম মেয়াদ থাকা প্রকল্পে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে সংশোধিত বরাদ্দের ৪৩ শতাংশ অর্থ। বাকি কাজ শেষ করতে দেড় বছরে ৯৫৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে। অথচ চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে এ প্রকল্পে বরাদ্দ আছে মাত্র ২০০ কোটি টাকা। এ অবস্থায় দুবার মেয়াদ বাড়ানো প্রকল্পটির কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে না বলে জানিয়েছে আইএমইডি। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি আবারো ব্যয় বাড়বে বলে আশঙ্কা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বিভাগটির।

সূত্র জানায়, ৬৫৫ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয় ধরে শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে জেলা শহরে অবস্থিত সরকারি পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট কলেজগুলোর উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের  মাধমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। ২০১০ সালের আগস্টে নেওয়া প্রকল্প নির্ধারিত সময় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ না হওয়ায় তিন বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ দফায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৯৭৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকায়। আবারো ধীরগতির কারণে এক হাজার ৬৯০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়। প্রকল্পে স্থবিরতার কারণে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৩৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি।

সম্প্রতি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে প্রকল্পটির বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে আইএমইডি। সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সালের তুলনায় পরবর্তী ১০ বছরে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির হার বেড়েছে তিনগুণ। সরকারি পর্যায়ের পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনের সীমাবদ্ধতার কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রবণতা বেশি। এসব কলেজে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। সহায়ক পরিবেশের অভাব, প্রশিক্ষিত শিক্ষক ও উপকরণের অভাবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত কলেজে কাঙ্ক্ষিত মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় শিক্ষার মান বাড়াতে জেলা পর্যায়ের ৭০টি কলেজের উন্নয়নে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো বছরেই এডিপির আওতায় প্রত্যাশিত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, প্রথম অর্থবছর ৫০ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে দেওয়া হয়েছিল মাত্র দুই কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছর ২৪২ কোটি টাকা চাহিদা থাকলেও প্রকল্প অফিস চেয়েছিল ৯৩ কোটি টাকা। এর বিপরীতে দেওয়া হয় মাত্র ৩৫ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর ১০০ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ গত অর্থবছর ৩০৪ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে দেওয়া হয় মাত্র ১৭০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত চাহিদার মাত্র ৫৩ দশমিক ৮০ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে প্রকল্পটিতে।

অপ্রতুল বরাদ্দ ছাড়াও রেট শিডিউল পরিবর্তনের কারণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করায় কাজে বিলম্ব হয়েছে বলে জানিয়েছে আইএমইডি। মহানগর এলাকার কলেজগুলোয় অবকাঠামো নির্মাণে অতিরিক্ত ভিতের প্রয়োজন হওয়ায় কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। তা ছাড়া কিছু কলেজে ভবন নির্মাণের জায়গা বুঝে পেতে বিলম্ব হওয়ায় কাজে বাড়তি সময় লেগেছে বলে প্রতিবেদন পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। প্রশাসনিক জটিলতা, বৈরী আবহাওয়া, পরীক্ষা চলাকালে কাজ বন্ধ থাকা, ঠিকাদারের গাফিলতিসহ বিভিন্ন কারণে কাজে বিলম্ব হয়েছে বলে প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক যুগ্ম সচিব মো. তাহিয়াত হোসেন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, সম্প্রতি আইএমইডি থেকে তিনি প্রতিবেদনটি পেয়েছেন। রেট শিডিউল পরিবর্তনের কারণে শুরুতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ করতে না চাওয়ায় প্রকল্পটি প্রত্যাশিত গতি পায়নি। তা ছাড়া প্রকল্প শুরুর পর কিছু কাজ বাড়তি যোগ হয়েছে। ফলে সময় ও ব্যয় বেড়েছে। তিনি আরো জানান, এ প্রকল্পে ৯০ শতাংশের বেশি পূর্ত কাজ রয়েছে। আর এসব পূর্ত কাজ করে থাকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর। ২০১৯ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার বিষয়ে তিনি আশাবাদী। সম্ভব না হলে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।

আইএমইডি জানায়, প্রকল্পের আওতায় চার হাজার শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য ১৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। আর্থিক অগ্রগতি মাত্র এক শতাংশ। যানবাহন ক্রয়ে ৭৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দের পুরোটাই ব্যয় হয়েছে। প্রকল্প অফিসের আসবাব কেনায় তিন লাখ ৩২ হাজার টাকা বরাদ্দের শতভাগ ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পভুক্ত ৭০ কলেজের জন্য ৭০ সেট যন্ত্রপাতি কেনায় দুই কোটি ৬৯ লাখ ২১ হাজার টাকার শতভাগ ব্যয় হয়েছে। ৭০ সেট বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কেনায় চার কোটি ৯০ লাখ টাকার এক পয়সাও ব্যয় হয়নি। ৭০ সেট কম্পিউটার কেনায় বরাদ্দের ৩০ কোটি ২৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকার শতভাগ ব্যয় হয়েছে।

কেনাকাটার কাজ অধিকাংশ শেষ হলেও পিছিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। তথ্য অনুযায়ী ভূমি উন্নয়নে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দের এক পয়সাও ব্যয় হয়নি। ৭০ কলেজের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে ৩৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বরাদ্দের মাত্র ৮ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। ৭৯ হোস্টেল নির্মাণে ৪৪৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ২৩৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আট বছরে অগ্রগতি মাত্র ৫৩ শতাংশ। ৭০ একাডেমিক ভবন নির্মাণে ৪০৩ কোটি দুই লাখ টাকা বরাদ্দের মাত্র ৫১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে।

নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না বলে জানিয়েছে আইএমইডি। বাস্তবায়নে ধীরগতিকে প্রকল্পের বড় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads