• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
‘স্বাভাবিক জীবনের’ ডাকে ইয়াবা কারবারিদের সাড়া

‘স্বাভাবিক জীবনের’ ডাকে ইয়াবা কারবারিদের সাড়া

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

১৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ

‘স্বাভাবিক জীবনের’ ডাকে ইয়াবা কারবারিদের সাড়া

  • আজাদ হোসেন সুমন ও জাবেদ ইকবাল চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত টেকনাফের শতাধিক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছেন। দীর্ঘদিন এ ব্যবসা থেকে অর্জন করা অর্থের লোভ ত্যাগ করে এসব মাদক ব্যবসায়ী কক্সবাজার জেলা পুলিশের কাছে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা আত্মসমর্পণ করবেন।

এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মুঠোফোনে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, যেসব মাদক কারবারি ১৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করবে তাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রথমেই অভিনন্দন জানিয়ে বলছি, স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সরকার সব রকম সহায়তা দেবে। যাদের মামলা আছে সেসব মামলায় আইনি সহায়তা দেওয়া হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। যারা দরিদ্র তাদের অথবা তাদের পরিবারের সদস্যদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। যাতে তারা অর্থনৈতিক দৈন্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। এ ছাড়া মাদক কারবারি যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের যেন পরবর্তী সময়ে কোনো পুলিশ সদস্য হয়রানি না করে সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সম্প্রতি ইয়াবার বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই অভিযানে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ইয়াবা পাচারকারীদের মৃত্যুর হারও বাড়তে থাকে। এই অবস্থায় মৃত্যু শঙ্কায় অনেক ইয়াবা পাচারকারী স্বপ্রণোদিত হয়েই আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশায় বিদেশ থেকেও ফিরে এসেছে অনেকেই। টেকনাফের ইয়াবা কারবারিদের একটি অংশ ‘আত্মসমর্পণ’ করতে পুলিশের নিরাপত্তা  হেফাজতে গিয়েছে।

জানা গেছে, শতাধিক কারবারি নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণের নির্ধারিত দিন পর্যন্ত এই তালিকা আরো লম্বা হতে পারে।

একটি সূত্র মতে, ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখ দিন ধার্য করেছে। তবে কতজন আত্মসমর্পণ করবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ইয়াবা কারবারিদের অনেকেই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন বলে জানা গেছে।

এদিকে বিশাল সীমান্ত এলাকায় অভিযান এবং আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এই ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অনেকে। প্রতিদিন নতুন নতুন নাম যোগ হচ্ছে এই ব্যবসায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবকয়টি সংস্থার সমন্বয়ে অভিযানের মাধ্যমে ইয়াবা কারবারিদের রুখতে হবে, এমনটাই দাবি করেছেন সচেতন মহল।

জানা গেছে, ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনলে তিনিও এতে সম্মতি দেন। এরপরই জেলা পুলিশ এ নিয়ে কাজ শুরু করে। ১৬ ফেব্রুয়ারি  টেকনাফে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান অতিথি থাকবেন। এ ছাড়া সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির স্ত্রী সংসদ সদস্য শাহীন আক্তার, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।

অর্ধশত ইয়াবা প্রাসাদে আঁচড় : পুড়েছে ইয়াবা ট্রলারও

টেকনাফের জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া এক সময় ছিল হতদরিদ্রের ভাঙাচোরা ঘরবাড়ির এক অপরিচ্ছন্ন পাড়া। প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা বদলে দেয় এখানকার জীবনচিত্র। ভাঙা ঘরের বদলে হঠাৎ গড়ে উঠতে থাকে সুরম্য সব আলিশান প্রাসাদ।

অধিকাংশ বাড়িই গড়ে তোলা হয়েছে ইয়াবা বিক্রির টাকায়। এসব বাড়ির বাইরের দৃশ্য যেমন চোখ ধাঁধানো তেমনি ভেতরের প্রতিটি কক্ষ সাজানো হয়েছে বিদেশি আসবাবপত্র ও সামগ্রী দিয়ে।

শুধু জালিয়াপাড়া বা নাজিরপাড়া নয়, টেকনাফের প্রায় প্রতিটি গ্রাম ও  পৌর শহরে এখন শোভা পাচ্ছে ইয়াবা কারবারিদের আলিশান বাড়ি-বহুতল ভবন। গত বছরের মে মাসে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে এসব আলিশান বাড়ির দিকে নজর পড়ে প্রশাসনের। অক্টোবর  থেকে এসব বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে প্রশাসন, যা এখনো চলমান। ইতোমধ্যে রাতের আঁধারে অনেক ইয়াবা কারবারির প্রাসাদোপম বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু ইয়াবা ট্রলারও। টেকনাফের পশ্চিমের মেরিন ড্রাইভ সড়ক সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর সৈকতে কৌশলে মাছ ধরার কথা বলে এসব কাঠের বোট বা ট্রলারে করে ইয়াবা পাচার করে এক শ্রেণির কারবারিরা।

তবে কিছু কিছু চিহ্নিত ইয়াবা কারবারির বিলাসবহুল বাড়িতে এখনো কোনো আঁচড় লাগেনি। কেন লাগেনি তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন স্থানীয়দের। সরেজমিন দেখা গেছে, এ রকম দুই শতাধিক বাড়ি সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রশাসনের এ দ্বৈতনীতির। এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এবিএমএস দৌহা বলেন, আসলে ইয়াবা কারবারিদের বাড়িঘরে রাতে কে বা কারা ভাঙচুর করেছে তা বলা যাচ্ছে না। কেউ অভিযোগও দেয়নি। গত তিন বছরের কম বেশি সময়ে নির্মিত এসব বাড়িতেই প্রকাশ্যে চলেছে ইয়াবা কারবার। এ জন্য বাড়ির পাহারায় সার্বক্ষণিক লোক নিয়োগের পাশাপাশি বসানো হয় একাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা।

নিহত টেকনাফেই বেশি

গত বছরের ৪ মে থেকে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর প্রায় প্রতিদিনই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সন্দেহভাজন মাদক কারবারিদের হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এ সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শুধু কক্সবাজারেই ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে টেকনাফে নিহতের সংখ্যা ৩৯ জন। তাদের মধ্যে ২৫ জন টেকনাফের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে  টেকনাফে র্যাব-৭-এর অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ইয়াবা কারবারি নিহত হয়। 

পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সর্বশেষ করা ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ১ হাজার ১৫১ জনের নাম রয়েছে। এরমধ্যে ৭৩ জন প্রভাবশালী ইয়াবা কারবারি রয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকা ওই হালনাগাদ তালিকায় সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদিসহ ৩৪ জন সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি এবং বদির ভাই, বোন, ভাগ্নেসহ ২৬ জন আত্মীয়ের নাম রয়েছে। আরেক সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর স্বজনের নামও রয়েছে। রয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের স্বজনদের নামও। তবে উল্লিখিত জনপ্রতিনিধিরা বার বার তাদের স্বজনরা ইয়াবা কারবারে জড়িত নয় বলে দাবি করে আসছেন।

থেমে নেই পাচার

এত হাঁকডাকের পরও মিয়ানমার থেকে এই মরণ নেশা ইয়াবা পাচার থেমে নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে কৌশল নিচ্ছে-পাল্টা নিত্যনতুন কৌশলে ইয়াবা কারবারিরা সমুদ্র, নাফ নদী এবং সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টের ফোকর গলে ইয়াবা নিয়ে আসছে। কারবারিদের সঙ্গে রয়েছে রোহিঙ্গাদেরও যোগসাজশ। শরণার্থীর নামে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ইয়াবা আনা অব্যাহত রেখেছে। এসব চালানের সিংহভাগের গন্তব্য ঢাকায়। তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হলেও ঢাকায় ইয়াবা আসা বন্ধ নেই। প্রতি পিস ইয়াবা কক্সবাজারে ৫০ থেকে ৬০ টাকায় ক্রয় করে ঢাকায় পৌঁছাতে পারলেই সেটার দাম হয়ে যায় দেড় থেকে ২০০ টাকা। খুচরা বাজারে এর মূল্য তিন থেকে পাঁচশ টাকা। বেশি মুনাফার কারণে অতিলোভী ইয়াবা কারবারিরা ঝুঁকির মধ্যে এ ব্যবসা পরিচালনা করছে। আবার সরকার মাদক নির্মূলে আন্তরিক হলেও সরকারের প্রশাসনযন্ত্রে ঘাপটি মেরে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্য মাদক কারবারিদের ইন্ধন দিচ্ছে মাসোয়ারার বিনিময়ে। শর্ষেতে ভূত থাকাসহ নানা কারণে দেশ থেকে এই মরণ নেশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে সরকারকে।

আইজিপি যা বললেন

আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, পুলিশের পাশাপাশি ইয়াবার আগ্রাসন রোধে সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, সমাজের সচেতন ও বিত্তবান অংশ, সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের সবার সহযোগিতা দরকার। মাদকের চাহিদা যেখানে থাকে সেখান থেকে মাদক নির্মূল করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সীমান্তে কঠোর নজরদারি, কারবারিদের আত্মসমর্পণ, উৎসস্থলে নক করাসহ নানা পদেক্ষপ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি মাদকের কুফল সম্পর্কে জনসেচতনা সৃষ্টি করতে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশটা আমাদের সবার। আর এই দেশের ভবিষ্যৎ হচ্ছে উঠতি বয়সী তরুণ ও যুব সমাজ। ইয়াবার বিষাক্ত ছোবলে এদের জীবনে অন্ধকার নেমে আসছে। সুতরাং এটা যেকোনো মূল্যে রোধ করতে হবে। আমরা আপাতত মাদক নির্মূল করতে না পারলেও সবার সহযোগিতা পেলে মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে পারব বলে আশা রাখি।

তিনি বলেন, মাদকের প্রশ্নে কোনো আপস নেই। বাংলাদেশ পুলিশের কোনো সদস্য যদি মাদকে যুক্ত হয় তার দায়ভার তার নিজেকেই বহন করতে হবে। আমরা আগেও বলেছি ব্যক্তির দায় বাহিনী নেবে না। সুতরাং কেউ এ অপকর্মে যুক্ত হলে তাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads