• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯
শ্বাপদরূপে মানুষ গড়ার কারিগর

ছবি : সংগৃহীত

অপরাধ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি

শ্বাপদরূপে মানুষ গড়ার কারিগর

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ০৫ জুলাই ২০১৯

শিক্ষকের যৌন হয়রানির বলি নুসরাত ট্র্যাজেডির রেশ কাটতে না কাটতেই নারায়ণগঞ্জে ২০ স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে গত ২৭ জুন ২ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবারও একই জেলার ফতুল্লায় ১২ ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এক মাদরাসাশিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, এমনকি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠশালা কিন্ডারগার্টেন— কোথাও নিরাপদ নয় মেয়ে শিক্ষার্থীরা। পিতৃতুল্য শিক্ষকদের ঘৃণ্য যৌনলালসার শিকার হচ্ছে তারা। মানুষ গড়ার কারিগরখ্যাত শিক্ষকদের কেউ কেউ স্বীয় পেশার আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ছাত্রীদের জীবনে আবির্ভূত হচ্ছেন শ্বাপদরূপে। এ পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে দ্রুত। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতির পাশাপাশি সামাজিক অবস্থান বিবেচনায় লোকলজ্জার কারণে বিচারের দ্বারস্থ না হওয়াকে এর কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

সামাজিক ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে, বিবেকহীন কিছু মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠছে— তারা নিজেদের বিকৃত কাম-বাসনা চরিতার্থ করতে স্কুল-কলেজগামী কোমলমতি শিশু-কিশোরীদের টার্গেট করছে। এ নিয়ে ভাবনা এবং কাজ করার সময় হয়েছে। দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে শিক্ষক দ্বারা ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নেবে। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষক দ্বারা ছাত্রী ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি ও যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

ফেনীর সোনাগাজি মাদরাসাছাত্রী নুসরাতের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নারায়ণগঞ্জে স্কুলগামী ২০ শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে দুই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ১২ ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে আল আমিন নামে এক মাদরাসাশিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের সভানেত্রী অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে— সময় নেই। ঘটনাগুলো ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে সমাজে। প্রতিদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে- শিক্ষক নামের কিছু বিকৃতরুচির মানুষ ছাত্রীদের ধর্ষণ করছে, যৌন হয়রানি করছে। যে শিক্ষকের কাছে বিশ্বাস করে অভিভাবক তার সন্তানকে তুলে দেন সেই শিক্ষকই রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে, এটা খুব দুঃখজনক। তিনি আরো বলেন, আমাদের সামাজিক সচেতনতা আরো অনেক অনেকগুণ বাড়াতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গিতেও আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে আমরা ধর্ষণকারীর বিচারে তৎপর হওয়ার চেয়ে মেয়েটিকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে তৎপর হয়ে উঠি। ধর্ষিতাকে বিচারের নামে অপমান করা হয়। থানায় অপমান করা হয়, মেডিকেল পরীক্ষার নামে অপমান করা হয়, আদালতের কাঠগড়ায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে অপদস্থ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষিতা বা যৌন হয়রানির শিকার হলে মেয়েরা বিচার চাইতে যায় না। যারা যায় তারাও বিচার না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে আসে। ফলে ধর্ষণকারীরা পার পেয়ে যায়, পার পেয়ে যায় বলেই এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। প্রয়োজনে এসব ক্ষেত্রে আইনের সংশোধন ও সংযোজন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকেই আগে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি দুপুরে বরগুনা সদর উপজেলার সাহেবের হাওলা রাফেজিয়া দাখিল মাদরাসাসংলগ্ন শিক্ষকের বাসায় ৮ম  শ্রেণির এক ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে সাইফুল নামে এক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে র্যাব।

গত ১৬ এপ্রিল বিকালে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার চৌধুরীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক  মোজাম্মেল  হোসেন খানের কাছে প্রাইভেট পড়তে যায় ওই স্কুলের ৫ম  শ্রেণির এক ছাত্রী। সে সময় তার অন্য সহপাঠীরা প্রাইভেটে আসতে একটু বিলম্ব হওয়ায়  মোজাম্মেল  হোসেন খান তাকে একা পেয়ে যৌন হয়রানি করেন। এক পর্যায়ে ওই ছাত্রী ভয়ে বই খাতা ফেলে পাশের একটি বাড়িতে দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরে ছাত্রীর মা-বাবাকে খবর দিলে তারা তাৎক্ষণিক ওই বাড়িতে ছুটে আসেন। পরে তাদের বিষয়টি অবহিত করে ওই ছাত্রী। অভিযোগ পেয়ে থানা পুলিশ পরদিন ওই শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে। গত ২৮ জুন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অক্সফোর্ড হাইস্কুলের বিশ জনের অধিক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগে ২ শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। শিক্ষক আশরাফুল আরিফ ও মদতদাতা প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জুলফিকারের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করা হয়েছে। ৯ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার সলিমগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রদীপ দাসের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে বিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর বড় ভাই বাদী হয়ে গত রোববার অভিযুক্ত প্রদীপ দাসসহ ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে নবীনগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।

গত ৫ মে গাজীপুরের কালীগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল আহেদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছাত্রীরা ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। ১৬ মে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা ইউনিয়নের লক্ষ্মীকোলা শাহ্ রওশন জালাল উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে স্কুলের ছাত্রীদের, শিক্ষিকাদের এবং শিক্ষকদের স্ত্রীদের  যৌন হয়রানিসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। এসবের বিচার চেয়ে গত ১৬  মে নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর নানা ও ১৯ মে নয়জন শিক্ষক-শিক্ষিকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকতার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।

গত ২৫ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক বিষ্ণু কুমার অধিকারীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি অভিযোগ এনে পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা  দেন।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, ‘আমি আমার বিভাগের শিক্ষক বিষ্ণু কুমার অধিকারীর দ্বারা বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি ও মানসিকভাবে উত্ত্যক্তের শিকার হই। যার কারণে আমি মানসিকভাবে অনেক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমি পড়াশুনা এবং অন্য কোনো কাজেই মনোযোগ দিতে পারছি না।’

শিক্ষক নামধারীদের যৌন হিংস্রতার থাবা কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয় ও মাদরাসায় সীমাবদ্ধ নয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালকেও কলুষিত করছে শিক্ষক নামধারী কিছু শকুন। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। একই বছর ২৫ আগস্ট খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শরীফ উদ্দিন ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করার দায়ে চাকরিচ্যুত হন। ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রক্যািল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ডক্টর সাঈদ সালামের বিরুদ্ধে শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। ২০১৭ সালের ২ মে ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে একই বিভাগের শিক্ষক মিনহাজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে। পুলিশের কাছে এ অভিযোগ করা হলে ৭ মে পুলিশ তাকে  গ্রেপ্তার করে। একই বছরের ৩ জুন দিনাজপুর হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানি, মানসিক নির্যাতন ও অনৈতিক কাজে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে। পরে তদন্ত কমিটি ঘটনার সত্যতা পেয়ে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

ওই বছরের ২৪ আগস্ট ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামানকে ২৩৬তম সিন্ডিকেটের সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি এবং পিএইচডি জালিয়াতির অভিযোগে পৃথক তদন্তের ভিত্তিতে প্রমাণসাপেক্ষে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ বছরেরই নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্সের অধ্যাপক ড. রফিকুল হকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে সিআইডি পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো আছে। কিন্তু মানুষের মননে-মেধায় যদি পচন ধরে তখন আপনি কী করবেন। ইদানীং তো এ ধরনের অপরাধের ঘটনা অহরহ ঘটছে। আমরা পুলিশ বাহিনী কী করতে পারি। অভিযোগ পেলে সেটার তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা  নিয়ে থাকি। তিনি আরো বলেন, এটা খুব দুঃখজনক ঘটনা। আমি নিজেও মেয়ের বাবা। আমার মেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। প্রতিটি বাবা-মাই চান তার সন্তান উচ্চশিক্ষা নিয়ে মানুষের মতো মানুষ হোক। সেই আশায় তারা সন্তানদের স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। কিন্তু সেখানেও যদি এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, শিক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে শিক্ষকরা যদি সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেয়, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads