• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে খালেদের শতকোটি টাকা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৫ অক্টোবর ২০১৯

ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ওরফে ক্যাসিনো খালেদের দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে প্রায় শত কোটি টাকা জমা রয়েছে। পুলিশের পর দ্বিতীয় দফায় ১০ দিনের রিমান্ডে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ এ তথ্য জানিয়েছেন। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদে কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যের নাম বলেছেন। একই সঙ্গে কোন ক্যাসিনো থেকে কত টাকা পেতেন এবং চাঁদাবাজির অর্থের পরিমাণও জানিয়েছেন তিনি। খালেদকে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। পুলিশের পর দ্বিতীয় দফায় ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে খালেদকে বর্তমানে জিজ্ঞাসাবাদ করছে র্যাব।

এদিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১১ জন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর পরিচালনা, মাদক ব্যবসা, ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ ও পরিবহন চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এলাকার বিভিন্ন ক্লাব, সামাজিক সংগঠন, মার্কেট ও ফুটপাত নিয়ন্ত্রণে নেন তারা। খেলাধুলার নামে এসব ক্লাবে শুরু করেন ক্যাসিনো ও জুয়ার আসরসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও তাদের কারো কারো ক্যাসিনো ব্যবসা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় উঠে এসেছে এসব বিতর্কিত কাউন্সিলরের নাম। বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

খালেদের মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা র্যাব-৩-এর উপপরিচালক ফাইজুল ইসলাম বলেন, খালেদের রিমান্ড চলছে। খালেদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। রিমান্ড শেষে বিস্তারিত জানা যাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আশির দশকের শেষদিকে ফ্রিডম পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিলেন খালেদ। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলাকারী ফ্রিডম মানিক ও ফ্রিডম রাসুর হাত ধরে তার রাজনৈতিক পথচলা শুরু। শাহজাহানপুরে বেড়ে ওঠা খালেদ একসময় বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ভাই মির্জা খোকনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শুরু করেন যুবলীগের রাজনীতি। ধীরে ধীরে যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আসীন হন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় খালেদ জানান, এরপরই শুরু হয় তার চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি। আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়েও কাজ করেন তিনি। বৈধ-অবৈধ অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতেন সব সময়। ক্যাসিনো, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করতেন। এসব অর্থ যুবলীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের অনেক সিনিয়র নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভাগ দিতেন। 

র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ জানিয়েছেন, মতিঝিলের ইয়ংমেন্স ক্লাব থেকে তার মাসিক আয় ছিল ৪০ লাখ টাকা। মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব থেকে মাসিক আয় ছিল ৩ লাখ টাকা। শাহজাহানপুর রেলওয়ে গেটসংলগ্ন মাছের বাজার থেকে মাসিক আয় ছিল ৬০ হাজার টাকা। শাহজাহানপুর এলাকার লেগুনা থেকে মাসিক আয় ৩০ হাজার টাকা। বিভিন্ন ফুটপাত থেকে মাসিক আয় ছিল ২০ হাজার টাকা।

খালেদের দেওয়া তথ্যমতে, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রেখেছেন তিনি। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার আরএইবি ব্যাংকে ৬৮ লাখ টাকা জমা রয়েছে। সিঙ্গাপুরের ইউওবি ব্যাংকে দেড় কোটি টাকা, ব্যাংকক অব ব্যাংকে এক লাখ বাথ, বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে ৬ থেকে সাড়ে ৬ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকে আড়াই কোটি টাকা, এনসিসি ব্যাংকে নিজের নামে ১৯ কোটি টাকার এফডিআর, ব্র্যাক ব্যাংকে স্ত্রী সুরাইয়া আক্তারের নামে ৫০ লাখ টাকা, এনসিসি ও ব্র্যাক ব্যাংকে অর্পণ প্রোপার্টিজের নামে ১৫ লাখ টাকা করে ৩০ লাখ টাকা গচ্ছিত রয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, ২০১৫ সালে খালেদ সুমন নামে একজনের মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন শীর্ষ নেতাকে ৬০ লাখ টাকা দেন খালেদ। আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতাকে পূর্বাচলের একটি প্রজেক্টের জন্য ৫ কোটি টাকা দেন। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের শীর্ষ একজন নেতাকে সম্প্রতি ৫০ লাখ টাকা ও আরেকজন পলাতক নেতাকে ৪০ লাখ টাকা দেন তিনি। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দুজন মধ্যম সারির নেতাকে দুই কোটি টাকা, যুবলীগের এক শীর্ষ নেতাকে দুই দফায় ২০ লাখ টাকা এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মতিঝিল বিভাগের একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার ও ডিবির একজন অতিরিক্ত উপকমিশনারকে নিয়মিত টাকা দিতেন যুবলীগের এই নেতা।

জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগ নেতা খালেদের ক্যাডার বাহিনীর মধ্যে ঘনিষ্ঠদের নাম জানিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে গোড়ানের কাউন্সিলর আনিস ও তার সহযোগী পিচ্চি রুবেল, ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ, তার সহযোগী হাসান উদ্দিন, আরামবাগ ক্লাবের প্রহরী জামাল ও কাজি সুমন তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ জানিয়েছেন, গোড়ানের রাউফুল আলম শুভর (বহিষ্কৃত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক) কাছে ৪-৫টি বিদেশি পিস্তল রয়েছে। এ ছাড়া ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রিজভী, মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এনামুল হক আরমান ওরফে ক্যাসিনো আরমান, রানা মোল্লা, কাইল্লা আমিনুল, অঙ্কর, উজ্জ্বল মোর্শেদ, ক্যাসিনো বকুল, ল্যাংড়া জাকির ও ড্রাইভার জিসান তার অন্যতম সহযোগী ছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও দুবাইয়ে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের যুব সংগঠনের রাজনীতি শুরু করেন খালেদ। প্রথম দিকে সম্রাটের অধীন হয়ে কাজ করলেও সম্প্রতি তিনি নিজেই ক্যাডার বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করতেন। তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা ছিল রাজধানীর মতিঝিল, শাহজাহানপুর, রামপুরা, সবুজবাগ, খিলগাঁও ও মুগদা। এসব এলাকায় থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, রেল ভবন, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার ফকিরাপুল জোনসহ বেশিরভাগ সংস্থার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। কমলাপুর এলাকায় ‘ভূঁইয়া অ্যান্ড ভূঁইয়া’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তার।

র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে খালেদ অনেক তথ্য জানিয়েছেন। আবার অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছেন। খালেদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্য ও সহযোগীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আটজন ও উত্তর সিটি করপোরেশনের তিনজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো, জুয়া, মাদক ও চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযুক্তদের কেউ কেউ সিটি করপোরেশনের নিয়মিত বোর্ড সভায়ও অনুপস্থিত থাকেন। ওয়ার্ডের নাগরিকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানেও তাদের পাওয়া যায় না। কারো কারো বিরুদ্ধে সরকারের অনুমতি ছাড়া একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণেরও অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রত্যেকেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) যেসব কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা হচ্ছেন- ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আনিসুর রহমান, ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আশ্রাফুজ্জামান, ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজি এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ, ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোস্তফা জামান (পপি), ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ রতন, ২২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. তরিকুল ইসলাম সজীব, ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হাসান (পিল্লু) ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) কাউন্সিলররা হলেন- সাত নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোবাশ্বের হোসেন চৌধুরী, ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরান ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, কোনো কাউন্সিলর যদি ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকেন তবে তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। মেয়র হিসেবে আমি এ কাজে সর্বাত্মক সমর্থন, সাহায্য ও সহযোগিতা করব।

কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আসলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখছে। একজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার পর আমরা তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি। আইনানুযায়ী, কোনো কাউন্সিলর বা জনপ্রতিনিধি যদি আদালত দ্বারা দণ্ডিত হন তাহলে তার বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আছে। তবুও আমরা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads