• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯
নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ইলিশ ধরার মচ্ছব

ছবি : বাংলাদেশের খবর

অপরাধ

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ইলিশ ধরার মচ্ছব

জনবল সংকটে অভিযান ঢিলেঢালা

  • নাজমুল হুসাইন
  • প্রকাশিত ২৬ অক্টোবর ২০১৯

নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও প্রশাসনের অভিযানের পরেও বন্ধ নেই ইলিশ ধরা। জেলেদের আইন অমান্য করার প্রবণতার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার প্রভাবশালী মহলের অপতৎপরতায় মা ইলিশের নিধনযজ্ঞ চলছেই। তাই সারা দেশ থেকে প্রচুর ইলিশ জব্দ ও জেলেদের গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রতিদিনই। প্রজনন মৌসুমে এমন আইন অমান্য করার ‘মচ্ছব’ এ বছরের পর্যাপ্ত ইলিশ প্রাপ্তিতে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে । 

মৎস্য অধিদপ্তর চলতি মাসের ৯ থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ রেখেছে। তবে তথ্য বলছে যে, প্রজনন এলাকায় শুধু গোপনে আহরণ নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইলিশ পরিবহন ও মজুত, গোপনে ক্রয়-বিক্রয় সবই চলছে দেদার।

বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য বলছে, রাতভর ইলিশ শিকার হচ্ছে প্রজনন এলাকাজুড়ে। অনেক এলাকায় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইলিশ শিকারে নতুন পন্থা নিয়েছেন অসাধু জেলেরা। জেল-জরিমানা থেকে বাঁচতে ইলিশ শিকারে এখন তারা শিশুদের ব্যবহার করছে। কারণ বয়সের বিবেচনায় শিশুদের দণ্ড দিতে পারছে না প্রশাসন।

অন্যদিকে শিকারের পর ভোরে সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে তীরবর্তী বিভিন্ন গ্রামের বাজারে। অনেক এলাকায় মোবাইলের মাধ্যমে ইলিশ বিক্রির অর্ডার নিয়ে সেগুলো বাসা-বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোথাও গোপনে হাটও বসার খবর মিলেছে। আর এসব কার্যক্রমে সহায়তা করছে এলাকার প্রভাবশালী মহল থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু সদস্যরাও। ইতোমধ্যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মা ইলিশ পরিবহনের দায়ে শরীয়তপুরে তিন পুলিশ সদস্যকে বরখাস্তও করা হয়েছে। তারা এসব অবৈধ ইলিশ মজুতের জন্য সংগ্রহ করেছিলেন।

অন্যদিকে প্রাপ্তি বাড়ায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ শিকারে মরিয়া হয়ে উঠেছে জেলেরা। তারা এতটাই বেপরোয়া যে আইন মানছে না, উল্টো সহিংসতার ঘটনাও ঘটিয়ে যাচ্ছে। গত বুধবার রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলায় ইলিশ রক্ষা অভিযানে যাওয়া পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সংঘবদ্ধ জেলেদের আঘাতে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, দুই পুলিশ সদস্যসহ ১২ জন আহত হয় ওইদিন।

এদিকে মৎস অধিদপ্তরের তথ্যে, সারা দেশে এ পর্যন্ত ৯ হাজার ৬৩টি অভিযান পরিচালনা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এতে ৩ হাজার ৬৭৫ জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে জেল দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ১ হাজার ৯২৯টি ভাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৬৯ লাখ ৩৯ হাজার টাকা।

চলমান অভিযান বিষয়ে ইলিশ ব্যবস্থাপনা শাখার সহকারী পরিচালক মাসুদ আরা মমি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, জেলেরা এবার অনেক বেশি হারে মাছ শিকারে যাচ্ছে। এতে আমাদের অভিযানে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে এ বছর গ্রেপ্তার ও অভিযান দুই-ই বেশি।

আবার নিষেধাজ্ঞার সময় অন্য বছরের মতো এ বছরও বাংলাদেশের সীমানায় অবৈধভাবে ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা ইলিশ শিকার করছে। মাছ ধরার সময় ওই দুই দেশের জেলেদের আটকের একাধিক ঘটনা ঘটেছে এখন পর্যন্ত। আর রাজশাহীতে পদ্মায় ইলিশ ধরাকে কেন্দ্র করে ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসফের সঙ্গে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) গুলিবিনিময়ের ঘটনাও ঘটেছে এ বছর।

এদিকে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে সরেজমিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছে চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (সাবেক ইলিশ গবেষণা কেন্দ্র) কর্মকর্তারা। ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বলেন, দুঃখজনক হলেও কিছু এলাকায় ইলিশ নিধন ঠেকানো যাচ্ছে না। তিনি বলেন, দেশে ইলিশের বৃহৎ অঞ্চলের মধ্যে সাগর মোহনায়গুলোয় ইলিশ ধরা বন্ধ থাকলেও উপরের অঞ্চলে নদী মোহনায় আইন মানার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে চাঁদপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী অঞ্চলে ইলিশ ধরা হচ্ছে ব্যাপক হারে।

তিনি বলেন, পরিপক্ব ইলিশ এ সময় ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে উপকূলের মিঠাপানির নদ-নদীতে চলে আসে। আর এসব নদী মোহনায় হঠাৎ ইলিশের ব্যাপ্তি বাড়ায় ওইসব এলাকার জেলেরা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। এমন পরিস্থিতি হলে স্বাচ্ছন্দ্যে ও বাধাহীন পরিবেশে ইলিশ ডিম ছাড়তে পারবে না।

তিনি আরো বলেন, আশ্বিনের পূর্ণিমার আগে ও পরে ৮০ শতাংশ মা ইলিশ মিঠাপানিতে এসে ডিম ছাড়ে। তার মধ্যে ৭০-৭৫ শতাংশ ইলিশ রক্ষা করা সম্ভব না হলে তা সার্বিক উৎপাদনে প্রভাব ফেলবে।

চলমান ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে ৩১ অক্টোবর। এরপর আগামী ১ নভেম্বর থেকে আট মাসের জন্য শুরু হবে জাটকা ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা। চলতি নিষেধাজ্ঞায় ইলিশ ডিম ছাড়বে আর সেগুলো বড় হওয়ার জন্য পরবর্তী নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞায় উপকূলে সরকার ঘোষিত ছয়টি ইলিশের অভয়াশ্রমে ব্যাপক নজরদারি দরকার হয়। নতুবা এর প্রভাব পড়ে ইলিশের উৎপাদনে এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

যদিও তথ্যমতে দেশে প্রতি বছর বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশ উৎপাদিত হয় প্রায় ৪ লাখ ৯৬ হাজার টন। আর পরের বছর ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। এ বছর উৎপাদন আরো বাড়বে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

অভিযানের আগেই জেনে যায় জেলেরা : বাংলাদেশের খবরের দুমকী (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, পটুয়াখালীর নদীবেষ্টিত দুমকি উপজেলার পায়রা ও লোহালিয়া নদীতে জেলেরা প্রকাশ্যে দিনের বেলায় অবাধে মা ইলিশ শিকার করছেন। পাশাপাশি অভিযান পরিচালনা হলেও কাজে আসছে না। কারণ মৎস্য বিভাগের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের গোপন যোগাযোগে জেলেরা আগেভাগেই টের পেয়ে আত্মগোপন করে। অভিযান টিম কোথায় বা কোন দিকে যাচ্ছে মোবাইল ফোনের সেই তথ্য জেনেই নদীতে নামে জেলেরা। এছাড়া নদীর তীরেও জেলেদের নিজস্ব লোকজন পাহাড়ায় থাকে। দূর থেকে স্পিড বোট বা ট্রলারের শব্দ পেলেই জেলেদের সতর্ক সংকেত জানিয়ে দেয়। অভিযানের টিম ওই জায়গায় পৌঁছানোর আগেই জাল নদীতে বা তীরে ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে রেখে পালিয়ে যায়।

জনবল সংকটে নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে : শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, শরীয়তপুরেরও নদ-নদীতে মা ইলিশ শিকারের মহোৎসব চলছে। কেউ কোনো নিয়মনীতি মানছে না। প্রতিদিন হাজার হাজার জেলে পদ্মা নদীতে কারেন্ট জাল দিয়ে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মা ইলিশ শিকার করছে।

এ বিষয়ে জাজিরা থানার ওসি মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, আমরা সম্মিলিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করছি। তার পরেও বিশাল বড় নদী এক দিকে অভিযান করলে অন্য দিকে জেলেরা নেমে পড়ছে।

শরীয়তপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ বৈরাগী বলেন, এত বড় বিশাল জলপদ যৎ সামান্য লোকবল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন গেলে তখন জেলেরা দৌড়ে পালায়। আবার ফাঁকা পেয়ে মৌমাছির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে জেলেরা নেমে পড়ে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads