• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
লিবিয়া থেকে মানবপাচারে সক্রিয় ১১ দেশি সিন্ডিকেট

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

লিবিয়া থেকে মানবপাচারে সক্রিয় ১১ দেশি সিন্ডিকেট

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০২০

বাংলাদেশ থেকে ভালো বেতনের প্রলোভন দিয়ে বেকার যুবকদের টার্গেট করে লিবিয়ায় নেয় সেখানে সক্রিয় বাংলাদেশিদের ১১ সদস্যদের একটি সিন্ডিকেট। যারা ভারত, দুবাই, লিবিয়া ও মিসরের মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। চক্রটি অভিবাসন প্রত্যাশী পাচার হওয়া মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন কায়দায় অর্থ আদায় করে থাকে। কখনো না খাইয়ে রেখে, কখনো বেতন আটকে রেখে, কখনো নির্যাতন করে, কখনো লিবিয়ার এক শহর থেকে আরেক শহরে পাচার করে অথবা ইতালি পাঠানোর কথা বলে সাগরে নৌকায় তুলে দেওয়ার কথা বলে তারা পদে পদে টাকা নেয়।

চক্রটি কখনো বাংলাদেশে থাকা তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে অথবা নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা আদায় করে থাকে। লিবিয়ায় থাকা এরকম অন্তত ১১ জন সক্রিয় পাচারকারীর তথ্য পাওয়া গেছে ।

সূত্র মতে, বিদেশে গিয়ে কাজ করে ভাগ্য ফেরাতে চান এমন লোকদের পাচার করে অর্থ আত্মসাতের শক্তিশালী এক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে লিবিয়ায়। এই সিন্ডিকেটের দালালরা দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ করে। লিবিয়ায় গত মে মাসে ২৬ বাংলাদেশি খুন হওয়ার পর সারাদেশ থেকে গত চার মাসে ৮৬ জন দালাল ও মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের ছয় মূলহোতা লিবিয়ায় থাকায় এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই সিন্ডিকেটের কয়েকজন লিবিয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়লেও বেশিরভাগ এখনো সক্রিয়। যাদের ইন্টারপোলের সহায়তায় গ্রেপ্তার করে দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।

গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানবপাচারকারী ও অপহরণকারীদের গুলিতে নিহত হন ৩০ জন। এদের মধ্যে ২৬ জনই বাংলাদেশি। ওই ঘটনায় গুরুতর আহত ১২ জনের মধ্যে ৯ জনকে গত ৩০ সেপ্টেম্বর একটি বিশেষ বিমানে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়,  এই ঘটনায় সারাদেশে ২৬টি মামলা হয়েছে। ভিকটিমদের পরিবার ও পুলিশ বাদী হয়ে এসব মামলা করেছে। এরপর পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট একযোগে সারাদেশে পাচারকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করে। এ পর্যন্ত ৮৬ মানবপাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব, পুলিশ, ডিবি ও সিআইডি। তবে তাদের দালালরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

লিবিয়া থেকে দেশে ফেরা অভিবাসীদের মধ্যে রয়েছেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবের মো. জানু মিয়া। তিনি পেটে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। জানু মিয়া বলেন, ‘আমার এলাকার আরো অনেক লোকজন লিবিয়ায় থাকে। তাদের কাছে শুনে আমি ঢাকায় আসি। ঢাকার মতিঝিলে শ্যামল ও সোহাগ নামে দুই ব্যক্তি আমাকে ভারত, দুবাই, মিসর হয়ে লিবিয়ার বেনগাজিতে পাঠায়। শ্যামল ও সোহাগ মতিঝিলের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির হয়ে কাজ করত। বর্তমানে পলাতক রয়েছে। লিবিয়ার বেনগাজিতে রাহাত নামে ভৈরবের এক পাচারকারীর কাছে শ্যামল ও সোহাগ লোক পাঠায়। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া মানুষকে রাহাত বেনগাজিতে রাখে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাহাতের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়। তার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথ্য সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে সে লিবিয়াতেই রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বেনগাজিতে পাচার হওয়া মানুষকে জিম্মি করে খাওয়া বাবদ অর্থ আদায় করাই রাহাতের প্রধান কাজ। বাংলাদেশ থেকে অনেক দালাল তার কাছেই মানুষ পাচার করে। এসব মানুষকে না খাইয়ে রেখে তাদের বাড়ি থেকে কিছুদিন পরপর খাওয়া বাবদ ৫০ ডলার করে নেয়। ডলার না দিতে পারলে সেই অভিবাসীকে না খাইয়েই রাখে সে।

তানজিমুল ইসলাম ওরফে তানজিল। কয়েক বছর ধরে লিবিয়ায় আছে। তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের শ্রীনগর এলাকায়। বেনগাজিতে পাচার হওয়া মানুষকে লিবিয়ার রাজধানীতে ত্রিপোলিতে পাচারের কাজ করে সে। বেনগাজি থেকে ত্রিপোলি নিতে প্রতি জনের কাছ থেকে ৬০ থেকে ৭০ হাজার করে টাকা নেয়। মাইক্রোবাসে অবৈধভাবে পাচার হওয়া মানুষদের ঝুঁকি নিয়ে সড়কপথে বেনগাজি থেকে ত্রিপোলিতে পাঠায়। এই সড়কে বর্তমানে লিবিয়ার বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সক্রিয় রয়েছে। প্রায়ই অপহরণ, দাঙ্গা, দখল ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

গত ১৬ মে তিনটি মাইক্রোবাসে করে ৩০ বাংলাদেশিকে বেনগাজি থেকে ত্রিপোলি পাঠায় পাচারকারীরা। ত্রিপোলি থেকে অদূরের শহর মিজদাহে তিনটি মাইক্রোবাস থেকে ২৯ বাংলাদেশিকে অপহরণ করে। পরবর্তীতে ৩১ মে মুক্তিপণ না পেয়ে ২৬ জনকে অপহরণকারীরা গুলি করে হত্যা করে। তানজিল এসব অপহূত বাংলাদেশিকে নিরাপদে ত্রিপোলিতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছিল।

লিবিয়া ফেরত জানু মিয়া বলেন, ‘আমি বেনগাজি থেকে ত্রিপোলিতে যাওয়ার আগে তানজিলকে বারবার জিজ্ঞাস করেছি কোনো বিপদ হবে না তো। সে আমাকে প্রতিবারই বলছে সব দায়িত্ব তার।’

মাদারীপুরের বাসিন্দা মো. ফিরোজ, বাবা খালেক বেপারী। ভাগ্য ফেরাতে তার এলাকার লিবিয়াপ্রবাসী নজরুল ইসলামের কথায় ঋণ করে পাড়ি দিয়েছিলেন লিবিয়ায়। সাড়ে চার লাখ টাকা নজরুলের স্ত্রীর কাছে দিয়েছিল তার পরিবার। এ বছরের ১ জানুয়ারি কলকাতা, মুম্বাই, দুবাই, মিসর হয়ে লিবিয়ার বেনগাজিতে পৌঁছান তিনি। বেনগাজিতে পাঁচ মাস তাদের একটি ক্যাম্পে আটকে রেখেছিল পাচারকারীরা। এসময় তাদের কাছ থেকে জোর করে খাবার বিল নেওয়া হতো। ফিরোজকে বেনাগাজি থেকে ত্রিপোলিতে নেওয়ার জন্য আরো ৩২শ’ দিনার নেয়, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৬০ হাজার টাকা।

ফিরোজ বলেন, ‘মাদারীপুর সদরেই নজরুলের বাসা। তার স্ত্রীর কাছে আমরা টাকা দেই। কিন্তু ঘটনার পর আর তার খোঁজ পাচ্ছি না। তার স্ত্রীও দাবি করেছে নজরুলের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। নজরুল বর্তমানে লিবিয়াতেই রয়েছে।’

মো. সজল। বাবার নাম সাফিল উদ্দিন। কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার জগন্নাথপুরের এই যুবক তারই এলাকার আরেক মানবপাচারকারীর খপ্পরে পড়ে লিবিয়ায় পাচার হন। তার পাচারকারীর নাম জাফর। সজল বলেন, ‘জাফরকে চার লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে আমি লিবিয়ায় যাই। লিবিয়ার বেনগাজিতে অনেকদিন ছিলাম। পরবর্তীতে জাফরকে দ্বিতীয় দফায় টাকা দিয়ে বেনগাজি থেকে ত্রিপোলিতে যাওয়ার জন্য ৭০ হাজার টাকা দেই।’

সজলের বোন জেনি বলেন, ‘জাফর আমাদের পাশের এলাকার মানুষ। আমার ভাইকে সে লিবিয়ায় নিয়ে যায়। কিন্তু তার জন্যই আমার ভাই মরতে বসেছিল। এই ঘটনার পর জাফরের বাড়িতে থাকা তার স্ত্রী ও পরিবার পলাতক রয়েছে। জাফর নিজেও লিবিয়ায় আত্মগোপনে রয়েছে। তাকে ফোনেও পাওয়া যায় না।’

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আলেম নগরের করম আলী বেপারীর ছেলে সাইদুল ইসলাম। মাদারীপুরের নূরপুর এলাকার রবিউল ইসলাম নামে এক মানবপাচারকারীর মাধ্যমে চার লাখ টাকা চুক্তিতে লিবিয়ায় যান। সাইদুল অল্পের জন্য সেই মৃত্যুকূপ থেকে ফিরতে পেরেছেন। তবে সেই নৃশংস ঘটনার কথা তিনি ভুলতে পারেন না।

সাইদুল জানান, রবিউল ইসলামের ছেলে সজীব তিন চার বছর ধরে লিবিয়ায় থাকে। তার বাবা দেশের মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়। আর সজীব লিবিয়ায় অবৈধভাবে মানুষ পাচার করে। রবিউল ইসলামকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছে। তবে তার ছেলে সজীব ধরাছোঁয়ার বাইরে লিবিয়ায়। সে ইতালিতে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে।

লিবিয়ায় বেপরোয়া মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা ফরিদপুরের বক্কর সরদার নামে এক ব্যক্তি। সে লিবিয়ায় বসে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার দালালদের মাধ্যমে বেকার যুবকদের টার্গেট করে পাচার করে। তার ভায়রাভাই ও স্ত্রী বাংলাদেশে এজেন্ট হিসেবে কাজ করে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খেজুরতলা গ্রামের হাসান মন্ডলের ছেলে বকুল হোসেন। বিদেশ গিয়ে গ্রামের অনেকেই ভাগ্য উন্নয়ন করেছে দেখে বকুলও আশায় আশায় লিবিয়ায় পাড়ি দেন। বক্করের স্ত্রী ও ভায়রার কাছে তিন লাখ টাকা দেন বকুল। কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। অপহরণকারীদের গুলিতে হাতের দুই আঙুল উড়ে যায় তার। প্রায় পঙ্গু হয়ে দেশে ফিরেছেন তিনি।

মানবপাচারকারী বক্কর সরদারের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যে কয়জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হবে, বক্কর সরদার তাদের মধ্যে অন্যতম।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার সৈয়দা জান্নাত আরা বলেন, ‘আমরা কয়েকজনের নাম পেয়েছি। তারা বিদেশে পলাতক রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাদের গ্রেপ্তারে সহায়তা চাইবো।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads