• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

অপরাধ

ছেঁড়া কাগজ চিনিয়ে দিল খুনিদের

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২০ অক্টোবর ২০২০

রশি দিয়ে হাত-পা বাঁধা অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ, পুরো শরীর ছিল বেডশিট-মশারি ও পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। মুখ ছিল বৃিকত করা। ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে লাশের পরিচয় যাতে শনাক্ত করা না যায় সেজন্য হাতের আঙ্গুলও বিকৃত করা হয়। এমন একটি অজ্ঞাতনামা যুবকের অর্ধগলিত লাশ গত ১২ অক্টোবর সকাল সাতটায় হাতিরঝিল লেকের মেরুল-বাড্ডা প্রান্ত থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

এরপর হত্যা সম্পর্কিত ক্লুর খোঁজে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে মৃতদেহের চারপাশ খুঁজতে থাকে হাতিরঝিল থানা পুলিশ। লেকের যে স্থানে মৃতদেহটি ভেসে ছিল সেখান থেকে প্রায় ৫০ মিটার উত্তরে একটি ছেঁড়া কাগজ পায় পুলিশ। সেখানে লেখা একটি মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে মৃতব্যক্তির পরিচয় সনাক্তের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ।

১৩ অক্টোবর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে এসি আশিক হাসানসহ একটি টীম রাত ১টা থেকে পরদিন সকাল প্রায় ৭টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে খিলক্ষেত থানার উত্তরপাড়া এলাকা থেকে আহসান ও তামিম, হাতিরঝিল থানাধীন মহানগর আবাসিক এলাকা থেকে আলাউদ্দিন এবং রামপুরা এলাকা থেকে রহিমকে গ্রেপ্তার করে। তারা জানান, মৃত ব্যক্তির নাম আজিজুল ইসলাম মেহেদী। বয়স ২৪ বছর। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিচিতজনদের পাসপোর্ট ও ভিসা প্রসেসিংয়ে সহায়তা করতেন মেহেদী।

গ্রেপ্তারকৃত আহসান নিহত মেহেদীর বাল্যবন্ধু। সে গুলশানের একটি রেস্টুরেন্টে এক্সিকিউটিভ শেফ হিসেবে চাকরি করতো। করোনায় রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়ায় সে আলাউদ্দিনের কাছে কিছু টাকা ধার চায়। আলাউদ্দিন পেশায় ড্রাইভার হলেও পাসপোর্ট অফিসে দালালি ও পরিবহন পুলের পুরাতন গাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত।  সে আহসানকে টাকা ধার না দিয়ে পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজ (নামের বানান সংশোধন, জন্ম তারিখ সংশোধন, বয়স বাড়ানো কমানো) দিতে বলে। এ কাজে যে টাকা পাওয়া যাবে তা দুজনে ভাগ করে নেবে। এরপর আহসান বাল্যবন্ধু মেহেদীকে জানায় পাসপোর্টে সমস্যা সংক্রান্ত কোনো কাজ থাকলে সে সমাধান করে দিতে পারবে।

চট্টগ্রামের তিনটি পাসপোর্টের নাম ও বয়স সংশোধনের জন্য গত ১২ আগস্ট ঢাকায় আসে মেহেদী। দুই সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট তিনটির নাম ও বয়স সংশোধন করে দেওয়ার বিনিময়ে আলাউদ্দিনকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও আহসানকে ১ লাখ টাকা দেয় মেহেদী। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট সংশোধন করতে না পারায় মেহেদী তাদেরকে চাপ দিলে তারা এক সপ্তাহ সময় চেয়ে নেয়। এই সময়েও পাসপোর্ট সংশোধনের কাজ করতে না পারায় পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত চায় মেহেদী।

তারা টাকা ফেরত না দিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। একপর্যায়ে মেহেদী তাদের জানায় পাসপোর্ট ও টাকা ফেরত না দিলে ঢাকায় এসে তাদের অফিসে অভিযোগ করবে। চাকরি হারানোর ভয়ে আহসান ও আলাউদ্দিন মেহেদীকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য মেহেদীকে ১০ অক্টোবর ঢাকায় আসতে বলে।

মেহেদী ১০ অক্টোবর রাত ১১টা ১০ মিনিটে ঢাকায় এসে পৌঁছায়। এরপর মেহেদীকে খিলক্ষেত উত্তরপাড়ায় অবস্থিত ভাড়া বাসায় নিয়ে যায় আহসান। খাবারের সঙ্গে মেহেদীকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পর  ব্যক্তিগত কাজের কথা বলে বাইরে চলে যায় আহসান। রাত অনুমানিক দেড়টার দিকে ঘুমন্ত মেহেদীকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে হাত-পা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে বেডশিট, মশারি ও পলিথিনে মুড়িয়ে ফেলে আলাউদ্দিন। এরপর সে আহসানকে ফোনে হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করে।

আহসানের পাশের রুমের ভাড়াটিয়া তামিম (রেস্টুরেন্টে কর্মরত কলিগ) আকস্মিকভাবে রুমে ঢুকে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতে পারে। আহসানের অনুরোধের তামিম বিষয়টি কাউকে বলবে না এবং লাশটি সুবিধাজনক স্থানে ফেলে দিতে আহসানকে সহায়তা করবে বলে জানায়। সে রাতে লাশ সরাতে না পেরে বিছানার নিচে রেখে দুপুর বারোটার দিকে রেস্টুরেন্টে ডিউটিতে যায় আহসান ও তামিম। কাজ শেষে দুজন একসঙ্গে বাসায় ফেরে। রাত একটার দিকে আলাউদ্দিনের নোয়া মাইক্রোবাসটি নিয়ে ড্রাইভার রহিম লাশ গুম করতে আহসানের বাসায় যায়।

আহসান ও তামিম লাশটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে হাতিরঝিল এলাকায় প্রবেশ করে। পথে তামিম নেমে যায়। হাতিরঝিল লেকের মেরুল-বাড্ডা প্রান্তে লোকজনবিহীন ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখে তারা লাশটি গাড়ি থেকে পানিতে ফেলে দেয়। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট ও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার জন্য ব্যবহূত মেহেদীর বাস টিকিট জব্দ করা হয়। পাশাপাশি যে মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করে মেহেদীর লাশ হাতিরঝিলে ফেলে দেওয়া হয়েছে, সেটিও জব্দ করা হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃত আহসান, আলাউদ্দিন ও রহিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এবিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, এটি একটি ক্লু-লেস হত্যাকাণ্ড। একটি ছেঁড়া কাগজে লেখা মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে লাশের পরিচয় সনাক্তকরণের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার ও সব আলামত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। এ মামলাটি পুলিশি তদন্তের উৎকর্ষতার প্রমাণ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads