পুলিশের চোখ এড়াতে বিলাসবহুল গাড়িতে করে মাদক, শরীরে পেঁচানো ফেনসিডিল, ইয়াবা, পাকস্থলীতে করে ইয়াবা আনা পাচারের এসব কৌশল এখন পুরনো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে মাদক পাচারকারীরা যে কত ধরনের কৌশল নিচ্ছে তা আসলে চোখে না দেখে বিশ্বাস করাটাও কঠিন। নিত্যনতুন কৌশল যেমন তারা আবিষ্কার করছে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দক্ষ সোর্স দ্বারা সেগুলো ধরেও ফেলছে। মূলত মাদক পাচারের জন্য বহু কৌশল করেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা মাদক কারবারিরা। তার পরও দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আসছে তাদের চালান।
লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে ফেনসিডিলের চালান
গত ৬ অক্টোবর লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে করে ফেনসিডিল পাচার হচ্ছে-এমন তথ্য পায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। সেই অনুপাতে ফাঁদও পাতে তারা। এক পর্যায়ে সফলও হয়।
সরেজিমন দেখা যায়, লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িতে কাফনের কাপড়ে মোড়ানো ফেনসিডিল। দেখতে অবিকল মরদেহ। অবাক করা হলেও সত্যি, লাশবাহী গাড়ি থেকে তিন হাজার বোতল ফেনসিডিলসহ সাতজনকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এই দলটি। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কুমিল্লা থেকে আসা এমন একটি লাশবাহী গাড়ি রাজধানীর বঙ্গবাজার এলাকা থেকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। পাওয়া যায় তিন হাজার বোতল ফেনসিডিল। আটক করা হয় ছয় মাদক ব্যবসায়ীকে।
গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, খুবই বিস্মকরভাবে দেখলাম লাশবাহী ফ্রিজিং করা গাড়িতে মৃত লাশের মতো করে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বস্তার ভেতরে তারা ফেনসিডিল নিয়ে আসছে। এর মানে হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা ও মাদকখোররা নানাভাবে মাদক নিয়ে আসছেন।
মশিউর রহমান বলেন, আমাদের সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনীতে যারা আছেন তারা যথেষ্ট স্মার্ট ও প্রযুক্তিনির্ভর। তারা যদি আরেকটু আন্তরিক হন তাহলে এগুলো আসবে না। অপরাধীদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ঘটবে না।
বাস্কেটের পাতের নিচে ইয়াবা : গত ৬ অক্টোবর ৫৫ থেকে ৬০ বছরের ব্যক্তি অনেকগুলো আপেল, কমলা, বেদানা নিয়ে যাচ্ছেন। দেখে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই যে তিনি মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানার কর্মকর্তাদের কাছে খবর আসে, ওই ব্যক্তি ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত।
সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তিকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়। এরপর তার বাস্কেট থেকে সমস্ত ফল নিচে রাখা হয়। এরপর বাস্কেটের ওপরের পাত খুলে দেখা যায় নিচে আরেকটা পাত। আর ওই পাতেই স্তরে স্তুরে সাজানো ইয়াবার প্যাকেট। সন্দেহ আর গোপন তথ্য যে সঠিক ছিল বাস্কেট খুলে ইয়াবার চালান পাওয়ায় ভ্রূ কুঁচকে পুলিশ কর্মকর্তাদের। শুধু কি বাস্কেটের ভেতর বেদানার ভেতরে ১০০ পিস করে ছোট ছোট করে তার ভেতরেও ঢুকানো ছিল ইয়াবা।
কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন বলেন, খুবই অবাক করা ঘটনা পাচারকারীরা কত নিখুঁত কৌশল আর এমন ব্যক্তিকে ব্যবহার করেছেন যাতে করে কোনোভাবেই বোঝার উপায় থাকে না যে এ ব্যক্তি এ রকমভাবে ইয়াবা পাচার করছেন।
তিনি বলেন, কৌশলের পর কৌশল করে যাচ্ছে মাদক কারবারিরা। কিন্তু আমরাও সতর্ক থাকার কারণে সেগুলো ধরে ফেলতে সক্ষম হচ্ছি।
ছাতার হ্যান্ডলে ইয়াবা : এটিও চট্টগ্রামের ঘটনা। ছাতা হাতে মাঝবয়সী ব্যক্তি। পুলিশের সামনেই দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। পুলিশের কাছে তথ্য আসে ওই ব্যক্তির ছাতার হাতলে ভরে ইয়াবা নিয়ে যাচ্ছেন। পুলিশ তাকে আটক করে। আটকের পর ছাতার হ্যান্ডল খুললেই বেরিয়ে আসে সুন্দর করে পলিথিন দিয়ে মোড়ানো ইয়াবার প্যাকেট। দুটি ছাতা নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। দুটো থেকেই পাওয়া যায়।
মোটরসাইকেলের তেলের ট্যাঙ্কিতে ফেনসিডিল : মোটরসাইকেলের জ্বালানি পেট্রোল অকটেন থাকার ট্যাঙ্কেও ফেনসিডিল উদ্ধার হয়েছে। যশোরের অভয়নগরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিজিবির একটি টহল টিম দুজন মোটরসাইকেল আরোহীকে আটক করে। এরপর মোটরসাইকেলের তেলের ট্যাঙ্কের ভেতরে বিশেষ কায়দায় লুকানো ফেনসিডিল জব্দ করা করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাদক পাচারের জন্য কারবারিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চোখ এড়াতে নানা কৌশল ব্যবহার করেছেন। অনেক সময় নারীদেরকেও ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ কায়দায় নারীর শরীরে ফেনসিডিল, ইয়াবা এবং হেরোইন রেখে দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি পাকস্থলীতে করে ইয়াবা পাচার ঘটনায় আটকের নজির রয়েছে বহু।
নিত্যনতুন কৌশল করে হয়তো কিছুদিন সুবিধা নিতে পেরেছে কারবারিরা কিন্তু ধরা পড়তে হয়েছে। আর সেই সময় ফাঁস হয়েছে পাচারের কৌশল। বর্তমান সময়ে পাচারের যে অভিনব কৌশলগুলো ধরা পড়ছে তাতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বিস্ময় প্রকাশ করছেন। কীভাবে, কেমন করে এমন কৌশল রপ্ত করে তারা এ পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি দেশে মাদকের ঢুকছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা সত্ত্বেও মাদক কারবারিরা নানা কৌশল করে মাদক পাচার করছেন। বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদকের চালানগুলো আসছে রাজধানীর দিকেই। আর রাজধানী থেকেই মাদক আবার চলে যাচ্ছে বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মশিউর রহমান বলেন, মানুষের অন্তিম যাত্রার সঙ্গী। চলাচলে যাতে বিঘ্ন না ঘটে সে দিকে থাকে সবার নজর। কারণ একটাই, লাশবাহী গাড়ি। দেখলেই ভিন্ন রকম এক অনুভূতি হয়। কিন্তু অপরাধের সীমা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। এই গাড়িগুলোতেই বহন করা হচ্ছে ফেনসিডিল। দেখে বোঝার উপায় নেই। অবিকল কাফনে মোড়ানো।
তিনি বলেন, এতে করে বোঝা যাচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীরা নানাভাবে দেশের সীমান্ত পেরিয়ে অভ্যন্তরে মাদক নিয়ে আসছে। তবে তারা যতই কৌশল করুক ধরা তো পড়ছে। আমরা সতর্ক রয়েছি।
রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল বাতেন বলেন, মাদকের প্রশ্নে একেবারে জিরো টলারেন্স। যতই কৌশল করুক মাদক কারবারিদের ধরা হবে।
তিনি বলেন, অতিসম্প্রতি মাদক কারবারিদের একটি তালিকা হয়েছে। আর এ তালিকা ধরেই এখন অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, মাদকের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার জন্য ইতিমধ্যে রেঞ্জের সমস্ত জেলার পুলিশ সুপার ও থানার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
চটগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, কক্সবাজারকেন্দ্রিক মাদকের জোয়ার থামাতে সবকিছুই করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চলমান।
তিনি বলেন, কারবারিরা যত ধরনের কৌশল করুক আমরা তাদের ধরে ফেলব।