• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯
পাশবিক নির্যাতনের হাসপাতাল

সংগৃহীক ছবি

অপরাধ

পাশবিক নির্যাতনের হাসপাতাল

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১১ নভেম্বর ২০২০

প্রশাসনের নাকের ডগায় বছরের পর বছর ধরে নামে বেনামে চলছে বিভিন্ন রকমের অবৈধ হাসপাতাল। অনিয়মের এই ধারাবাহিকতায় অপচিকিৎসার বলি হয়ে প্রাণ হারালেন পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করীম।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চিকিৎসার নামে পাশবিক নির্যাতন চালানো হতো রাজধানীর ‘মাইন্ড এইড মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট’ হাসপাতালে আসা রোগীদের। হাসপাতালের ভেতরে ঠিক ওই রকমই ব্যবস্থা করা রয়েছে। সাউন্ড প্রুফ রুম রয়েছে যেখানে রোগীদের এনে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের আর্তচিৎকার যেন বাইরে না আসে সেই জন্যই এ ব্যবস্থা। এক কথায় হাসপাতালটি টর্চারসেল বললেও ভুল হবে না। যে কারণে সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিমকেও নির্যাতন করে হাসপাতালের কর্মচারীরা। এতেই তার মৃত্যু হয়।

এদিকে ‘মাইন্ড এইড মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট’টি হাসপাতাল হিসেবে পরিচালিত হলেও কার্যত তার কোনো অনুমোদনই ছিল না। মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের অনুমোদনের আড়ালেই হাসপাতাল হিসেবে পরিচালিত হতো এটি।

জানা যায়, রাজধানীর আদাবরের বাইতুল আমান হাউজিং সোসাইটিতেই অবস্থিত এটি। মূল সড়কের পাশেই ২৮১ নম্বর বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘মাইন্ড এইড মাইন্ড কেয়ার ইনস্টিটিউট’। তিনতলা বাড়িটি খুবই সাজানো-গোছানো। ভবনের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই নজরে পড়বে হাসপাতালটির দেয়ালজুড়ে টাঙানো দৃষ্টিনন্দন নানা চিত্রকর্ম। ভেতরের প্রতিটি রুমই পরিপাটি করে সাজানো। প্রতিটি রুমে দামি বিছানা, এসি, কাঠের আসবাবপত্র। প্রথম তলায় অফিসসহ রুম আছে সাতটি। আর প্রতিটি ফ্লোর একই রকমভাবে সাজানো-গোছানো। তবে নিচতলার পূর্ব পাশে একটি রুমকে বানানো হয়েছে ‘সাউন্ড প্রুফ’। যেটির দেয়ালের ভেতরের অংশ ফোম দিয়ে মোড়ানো। দেখতে নির্যাতন সেলের মতোই। সেখানেই চিকিৎসার নামে রোগীদের আটকে নির্যাতন করা হতো। সাধারণভাবে যে কেউ কক্ষটিতে প্রবেশ করলেই আঁতকে উঠবে। কারণ, রুমটিতে একটিমাত্র দরজা। নেই কোনো জানালা। বাতাস চলাচলেরও কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এসি, লাইট আর সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো।

গত সোমবার দুপুরে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে এসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্যাতনে নিহত হন পুলিশের সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম। ওই নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে যা ভাইরাল হয়। পুলিশ কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় তার পরিবার একটি মামলা করে। সেই মামলায় হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ দশজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের রিমান্ডেও আনা হয়েছে।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, হত্যার ঘটনায় কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যারাই জড়িত থাক, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি কোনো অনুমোদন না থাকলেও হাসপাতালটি দুই বছর ধরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ বছরের শুরুতে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল না। তাই অনুমতি পায়নি।

অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মচারী জানান, এখানে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের আটকে রাখা হতো ৫ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত। নানা সময় নির্যাতন করা হতো এসব রোগীদের। বন্দি রাখা রোগীদের নজরদারি করা হতো সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে। বাইরে থেকে শুধু খাবারই দেওয়া হতো। রোগীকে প্রাকৃতিক কাজ করতে হতো সেই রুমেই। রুমটিতে নেই কোনো টয়লেট। এমন কি বাইরে থেকে পানি না দিলে ভেতরে থাকা রোগীর পানি পান করারও কোনো উপায় নেই।

সরেজমিনেও মিলেছে এমন অমানবিক নির্যাতনের চিত্র। আর আশপাশের বাসিন্দারা বলছেন, তারা জানতেনই না এখানে চিকিৎসার নামে রোগীদের পাশবিক নির্যাতন করা হতো।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এ হাসপাতালে সার্বক্ষণিক ডাক্তার ছিল না। শেরেবাংলা নগরের জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউট হাসপাতাল থেকে দালালের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে আনার পর ডাক্তারকে ফোন করে আনা হতো। এমনকি হাসপাতালের অন্যান্য কর্মচারীদের রোগী ভাগিয়ে আনার জন্য সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হতো। রোগী আনতে পারলে পেতেন মোটা অঙ্কের কমিশন।

দেখা গেছে, ৪৩ বেডের এই হাসপাতালটিতে একটি ফার্মেসি, রান্নাঘর এবং দুটি কেবিন রয়েছে। পুরো হাসপাতালে কর্মরত নার্স মাত্র তিন জন।

হাসপাতালটির একজন রোগী ওই দিনের ঘটনার সময়ের বর্ণনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পুলিশের ওই কর্মকর্তাকে প্রথমে দ্বিতীয় তলার পূর্ব পাশের সাউন্ড প্রুফ রুমে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে কয়েকজন মিলে ধরে দড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়। এ সময় তিনি অনেক চিৎকার আর আর্তনাদ করছিলেন। কিন্তু কোনো তোয়াক্কা না করে আরো কয়েকজন তাকে বাঁধতে যোগ দেয়। এরপর দুজন হাতের কনুই দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করতে থাকেন। এসময় নির্যাতিত ওই পুলিশ কর্মকর্তা চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও’। আমি মরে যাচ্ছি। এর কিছু সময় পরই তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন।

 

এদিকে পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুরে ১০ জনকে আদালতে নিয়েছে আদাবর থানা পুলিশ। সবাইকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হবে। অবৈধভাবে পরিচালিত হাসপাতালটিতে আর কারা জড়িত সে বিষয়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পুলিশের এই মেধাবী কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের বিচার চেয়ে আদাবরে মানববন্ধন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা। তারা দোষীদের ফাঁসি দাবি করেন।রাজধানীর আদাবরের যে মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে গিয়ে জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম ‘হত্যাকাণ্ডের’ শিকার হয়েছেন, সেখানে কোনো মানসিক চিকিৎসক নেই বলে জানিয়েছে পুলিশ।

কোঅর্ডিনেটর, কোম্যানেজার ও ওয়ার্ডবয়দের দিয়ে চলছিল মাইন্ড এইড। এ ছাড়া হাসপাতালটির কোনো লাইসেন্সও নেই।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির তেজগাঁও জোনের ডিসি হারুন অর রশীদ বলেন, হাসপাতালটির কোনো কাগজপত্র নেই, ডাক্তার নেই। এ ধরনের হাসপাতাল চালানোর জন্য যেসব লাইসেন্স থাকা দরকার, তা নেই। মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের কোনো লাইসেন্সও তাদের নেই।

তিনি বলেন, হাসপাতালটির পরিচালক পর্ষদ কোঅর্ডিনেটর, কোম্যানেজার ও ওয়ার্ডবয়দের দিয়ে হাসপাতাল চালাচ্ছিল; যারা মেডিকেলে লেখাপড়া করেনি। আমরা সবাইকে গ্রেপ্তার করেছি। এখন তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

যারা আমাদের এই সিনিয়র এএসপিকে ওই কক্ষে তুলে নিয়ে গেছেন, তারা কেউ ডাক্তার না। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে চারজন ওয়ার্ডবয়। একজন কোঅর্ডিনেটর; যিনি তিতুমীর কলেজ থেকে বিএ পাস করেছেন। রেদওয়ান নামে এক তরুণ একটি কলেজে বিবিএ পড়ছেন। তারা যেভাবে এএসপি আনিসুলকে টর্চার করেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে এটি বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড।

ডিসি হারুন বলেন, হাসপাতালটিতে একজন রোগী আছে। তিনি চলে গেলে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, জাতীয় মানসিক হাসপাতাল থেকে হঠাৎ করে রোগীটা কীভাবে মাইন্ড এইড হাসপাতালে চলে গেল? এই দুই হাসপাতালের সঙ্গে কোনো দালাল জড়িত আছে কি না, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।

মাইন্ড এইড হাসপাতালের মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে ডিসি হারুন বলেন, আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads