• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

পুরান ঢাকায় নকল প্রসাধন তৈরি চলছেই

তালিকায় বাদ যায়নি শিশুদের ব্যবহার্যও

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৩ নভেম্বর ২০২০

পুরান ঢাকায় এখনো তৈরি হচ্ছে নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল প্রসাধনী পণ্য। যার ফলে অলিগলিতে মিলছে রাসায়নিকের অবৈধ গোডাউন। এতে প্রসাধন ব্যবহারকারীরা আছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। একই সঙ্গে যেকোনো সময় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটারও শঙ্কা আছে। এই নকল প্রসাধন সাম্রাজ্যের বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও প্রভাবশালীদের দাপটে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারছে না প্রশাসন।

স্মরণ করা যেতে পারে চকবাজারের চুড়িহাট্টার সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা। যে আগুন কেড়ে নিয়েছিল ৭১ জনের প্রাণ। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে আগুন লাগে। ওই ভবনে কেমিক্যাল গোডাউন থাকায় মুহূর্তে ভয়াবহ রূপ নেয় আগুন। ঘটনাস্থলেই পুড়ে মৃত্যু হয় ৬৭ জনের। দগ্ধ ১৫ জনের মধ্যে ৪ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে মারা যান। তারও আগে ২০১০ সালে ৩ জুন ঘটে নিমতলী ট্র্যাজেডি। ভয়াবহ আগুনে ঝরে যায় ১২৪টি প্রাণ। রাসায়নিকের গুদামে রক্ষিত দাহ্য পদার্থের কারণেই পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীতে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে তদন্তে উল্লেখ করা হয়। তার পরও পুরান ঢাকায় দাহ্য পদার্থ মজুত হচ্ছে। নকল অসংখ্য কারাখানা গড়ে উঠেছে।

এদিকে নকল পণ্যের তালিকায় বাদ যায়নি শিশুদের ব্যবহার্য প্রসাধনও। নকল বিদেশি অয়েল, শ্যাম্পু, পাউডার সবই বিক্রি হচ্ছে দেদার। এসব ভেজাল পণ্যের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণও অনেক সময় বুঝতে পারেন না অভিভাবকরা। তাদের অভিযোগ, অন্তত শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনা করে হলেও পুরান ঢাকার এই ভেজাল সাম্রাজ্য সমূলে উৎপাটনের উদ্যোগ নেওয়ার সময় হয়েছে। অন্যদিকে বছরের পর বছর এই অবৈধ ব্যবসাকে ‘ঐতিহ্য’ হিসেবেই নিয়েছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। মাসের পর মাস অভিযানে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড দিয়েও কাজ হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, নকল ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।

গত সপ্তাহে বিভিন্ন বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল শিশু প্রসাধন তৈরির অপরাধে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। দুজনকে দেন এক বছর করে কারাদণ্ড। জব্দ করেন জনসন অ্যান্ড জনসনের আদলে তৈরি মোড়কে বেবি লোশন, বেবি শ্যাম্পু, পাউডার, ইউনিলিভারের পন্ডস, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলিসহ ২৮ ধরনের নকল প্রসাধন সামগ্রী।

র‍্যাব সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ২০১৬ সাল থেকে ৩১ অক্টোবর ২০২০ সাল পর্যন্ত ভেজাল পণ্যসংক্রান্ত ৯১৭টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। প্রায় ৭০ ভাগ অভিযান হয়েছে রাজধানীতে। যার অর্ধেকের বেশি হয়েছে পুরান ঢাকায়। এই কয়েক বছরে চকবাজার, মৌলভীবাজার, লালবাগ, ইসলামবাগ, ইমামগঞ্জ ও নবাবপুর মিলে প্রায় ২০০টি নকল পণ্যের কারখানা বন্ধ করে সিলগালা করে দিয়েছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। জরিমানা করা হয়েছে সাড়ে ৮ কোটি টাকারও বেশি। যেখানে চার বছরে সারাদেশে র্যাবের অভিযান মোট জরিমানা করা হয়েছে ১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৯৬ হাজার ৩৩৯ টাকা।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, পুরান ঢাকার নকল পণ্যের এ পসরা অনেকটা ওপেন সিক্রেট। অজ্ঞাত কারণে এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তবে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় ভেজাল পণ্যের সিন্ডিকেট কাজ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। তারা পাচ্ছেন প্রতি মাসে কোটি টাকার মাসোহারা। বিপরীতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক ভোক্তারা।

নকল প্রসাধন র‍্যাব গোয়েন্দা ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশ এলাকায় চার শতাধিক নকল প্রসাধন সামগ্রী তৈরির কারখানা রয়েছে। যার মধ্যে পুরান ঢাকাতেই আছে সিংহভাগ।

সরেজমিন দেখা যায় মৌলভীবাজারের হাজি হাবিবুল্লাহ মার্কেটের সব দোকানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যান্ডের প্রসাধনীতে ঠাসা। সাবান, শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, ক্রিম, লোশন, পাউডার, শ্যাম্পু, তেলসহ ৭০-৮০ ধরনের নকল প্রসাধনী দেখা গেছে এখানে।

অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে চকবাজারে নকল প্রসাধনী তৈরির চারটি কারখানা ও ছয়টি গোডাউন সিলগালা করে দেওয়া হয়। কাউকে আটক না করলেও বিক্রির অভিযোগে আট দোকান মালিককে সাড়ে ৪৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। বউ সাজও ছিল ওই তালিকায়।

পুলিশের লালবাগ বিভাগ বলছে, নকল প্রসাধনী তৈরিতে যেসব ব্যবসায়ী জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিএসটিআইর সহায়তায় পুলিশ অভিযান চালায়। পুরান ঢাকায় নকল পণ্যের খোঁজ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। অভিযান সংশ্লিষ্ট র‍্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, পরিত্যক্ত মোড়ক ও কৌটাতে নকল প্রসাধনী ঢুকিয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে তারা। তা ছাড়া অবৈধ পথে ভারত, চীন, মালয়েশিয়া থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে ব্র্যান্ডের প্যাকেট, কৌটা আর বাহারি মোড়কে ভেজাল প্রসাধনী ভরে বিক্রি করা হচ্ছে আসল দামে।

চকবাজার ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একের পর এক অভিযানের ফলে সমিতির পক্ষ থেকে নকল পণ্য উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের কড়াভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু টাকার লোভে তারা থামছে না। একবার বন্ধ করা হলে ধাপে ধাপে টাকা দিয়ে নতুন করে আবার কারখানা খুলে বসে। নকল পণ্যের বাজার অনেক বড়। মাস গেলে এদের মধ্যে হাতবদল হয় শত কোটি টাকা।  

মৌলভীবাজারের হাজি হাবিবুল্লাহ মার্কেটের বউ সাজ স্টোরের বিক্রয়কর্মী জামিল হোসেন বলেন, আমাদের দোকানে প্রায় ৫০টি আইটেম আছে। সব বাইরের। আমাদের এখান থেকে দিনে ৪০-৫০ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি হয়। র‍্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, ‘পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদামের মতোই ভয়ংকর এ নকল পণ্য ও অবৈধ কারখানাগুলো। এদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযান চালানো হয়েছে। কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জামিনে বের হয়ে আবার তারা আগের ব্যবসায় ফিরে যায়।

সারওয়ার আলমের মতে, পুরান ঢাকা বিশেষ করে চকবাজার-মিটফোর্ড এলাকার অলিগলিতে রয়েছে নকল প্রসাধনী, নকল ওষুধ, নকল ইলেকট্রিক সরঞ্জাম, অবৈধ পলিথিনের কারখানা। আবার এগুলোতেই কাঁচামাল হিসেবে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুত আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বসতবাড়িতেই এসব রাসায়নিকের গুদাম। অবৈধ কারখানাগুলো চলছে স্থানীয় প্রভাবশালী ও বাড়ির মালিকের ছত্রছায়ায়। প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করে এই ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বাড়ির মালিকদের দ্বিগুণ ভাড়া দেন। তাই অভিযানে বাড়ির মালিকদেরকেও জবাবদিহিতায় আনা হয়।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) পরিচালক সাজ্জাদুল বারী বলেন, আমাদের আওতাধীন ১৮১টি বাধ্যতামূলক পণ্যের বিষয়েই আমরা মান যাচাই করি। নকল ও ভেজাল কসমেটিকসের পাশাপাশি ভেজাল খাদ্য নিয়েও বিএসটিআই নিয়মিত কাজ করছে।

বিএসটিআইর মহাপরিচালক ড. নজরুল আনোয়ার বলেন, পণ্য উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ-সব পর্যায়ে পণ্যের মান, ওজন ও পরিমাপ নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। বিএসটিআই বিদ্যমান মানের সঙ্গে নতুন করে পোলট্রি ফিড, পাস্তুরাইজড দুধ, এলপিজি সিলিন্ডার, হ্যান্ডওয়াশ, বেবি অয়েল, বেবি সোপ, স্কিন ক্রিমসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের জাতীয় মান প্রণয়ন করা হয়েছে। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ১৮১টি পণ্যমান বাধ্যতামূলক করেছে বিএসটিআই। পণ্য মান অনুযায়ী হচ্ছে কি না, তার তদারকি জোরদার করা প্রয়োজন। তবে ভোক্তা পণ্যের মান নিশ্চিত করতে বিএসটিআইর সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। তিনি বলেন, নকল ও ভেজাল রোধে শুধু বিএসটিআই নয়, সরকারের ১৯টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বিত জোরদার পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তাহলে সব পণ্যের মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হলেও এর পর্যাপ্ত জনবল, পরীক্ষাগারসহ অন্যান্য সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। তাই এ সংস্থা গঠনের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়নি। এ জন্য অসাধু চক্র সুযোগ নিচ্ছে। তারা নকল, ভেজাল ও মানহীন পণ্য বিক্রিতে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এসব বন্ধে অনেক আইন আছে। এখন প্রয়োজন বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads