• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

অপরাধ

রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে সিইও আলামিন

কোটিপতি বানানোর ছক এঁকে প্রতারণা এসপিসির

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৪ নভেম্বর ২০২০

অল্প দিনেই কোটিপতি? চোখের সামনেই মিল ফ্যাক্টরি কিংবা নামিদামি হাসপাতালের মালিক। চোখে এমন রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে ভুয়া এমএলএম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমডি ও সিইও এমন লোভ দেখিয়ে ২২ লাখ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

বলা হয়, অল্প কয়েক বছরের মধ্যে দেশের সবচেয়ে নামিদামি হাসপাতাল, মিল, ফ্যাক্টরি, কারখানা, গার্মেন্টের অংশীদারিত্ব হবে আপনার। পাশাপাশি আসবে নগদ টাকা। সদস্য সংখ্যা বাড়াতে পারলে সেই টাকা কিছু দিনের মধ্যে পৌঁছে যাবে লাখের কোঠায়। হয়ে যাবেন আপনি নিজেও শিল্পপতি। রিমান্ডে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে এসব তথ্য দেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের আড়ালে চালানো এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডের এমডি ও সিইও আলামিন (৩২)।

এক বছর আগেও ১০-১২ হাজার টাকার চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতেন ৩২ বছর বয়সি এই যুবক। এখন তিনি চালান কোটি টাকা দামের হ্যারিয়ার গাড়ি। জুতা পরেন অর্ডার দিয়ে বানিয়ে। সকালের নাশতা ও রাতের খাবার সারেন রাজধানীর অভিজাত হোটেল-মোটেলে।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পর্যায়ের লোকজন সাধারণ মানুষকে যেভাবে প্রলোভন দেখিয়েছে তাতে যে কেউই তাদের এই এমএলএম ব্যবসার ফাঁদে পা দিয়ে অল্প সময়ে বড়লোক হতে চাইবে। তারা এসব ভুক্তভোগীর টাকা এবং তাদের মাধ্যমে নতুন সদস্য সংগ্রহ করে তাদের টাকা থেকেই এদের কমিশন দিত। কিন্তু বলত কোম্পানি থেকে দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া এই কোম্পানি দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় হাসপাতাল, শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছে। সেখানে প্রত্যেকটি সদস্যের অংশীদারিত্ব থাকছে। এমন প্রতারণায় তাদের আশ্বস্ত করত।

গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, ‘এসপিসির প্রতিষ্ঠাতা আলামিনকে সঙ্গে নিয়ে আমরা একাধিক অভিযান চালিয়েছি। তার কাছ থেকে বেশ কয়েকটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য পেয়েছি। তার স্ত্রী ও তার নামে সিটি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকসহ আটটি ব্যাংকের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্ট ধরে ব্যাংকগুলোর কাছে টাকা লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এছাড়া দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় থাকা তাদের সম্পদের তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে।’

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লি. এক বছরে দেশের ৬৪ জেলার পাশাপাশি বিশ্বের ১৭টি দেশে ২২ লাখ সদস্য সংগ্রহ করেছে। যার বেশিরভাগই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তবে এই ফাঁদে চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, গাজীপুর, ভোলার মানুষ সবচেয়ে বেশি পা দিয়েছেন। এসপিসির লভ্যাংশ গ্রহণকারীদের তথ্য সংগ্রহ করেছে ডিবি পুলিশ। অর্জুন, ওমর ফারুক, জিএম আদনান, অনিক, নাজমুল বাঁধন, ইব্রাহীমসহ ২০ জনের এক সিন্ডিকেটের তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি। যারা এ ব্যবসার সুবিধা ও লভ্যাংশ নিয়মিত ভোগ করেছেন। লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া এই সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

কর্মকর্তারা আরো বলেন, এমএলএম ব্যবসা আড়াল করার কৌশল হিসেবে কোম্পানিটি নামে কয়েকটি পণ্য (অ্যালোভেরা শ্যাম্পু, ফেইসওয়াশ, চাল, ডাল, মরিচের গুঁড়া, হলুদের গুঁড়া, তেল, টিভি, এসি, ব্লেন্ডার মেশিন, রাইস কুকার) শুধু তাদের রেজিস্টার্ড মেম্বারদের কাছে বিক্রি করত। লভ্যাংশ থেকে প্রতি আইডি হোল্ডারকে কোম্পানির বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখার বিনিময়ে ১০ টাকা করে প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হতো। রাজধানীর হাজারীবাগে নিম্নমানের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কারখানা এবং গাজীপুর ও মুগদায় ইলেকট্রনিক্স পণ্যের গোডাউনের সন্ধান পেয়ে অভিযান চালিয়েছে ডিবি পুলিশ।

বিকাশ, নগদ, রকেটকে গোয়েন্দা পুলিশের চিঠি

গোয়েন্দা পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তা বলছেন, আদালতের অনুমতিক্রমে মোবাইল ব্যাংকিং মাধ্যম বিকাশ, নগদ, রকেটকে চিঠি দিয়েছেন তারা। তাদের মাধ্যমে যেন অবৈধ এমএলএম ব্যবসার রেজিস্ট্রেশন ফি পরিশোধ করার সুযোগ না দেওয়া হয়।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টারনেটভিত্তিক মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে এমএলএম ব্যবসা পরিচালিত হয়। রেজিস্ট্রেশন ফি পরিশোধ করা হতো বিকাশ, নগদ ও রকেট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। আগ্রহীদের প্লে স্টোর বা এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডের ওয়েবসাইট থেকে একটি মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করে এর মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে। রেজিস্ট্রেশন করার সময় বাধ্যতামূলক পূর্ববর্তী রেজিস্ট্রিকৃত আপলিঙ্ক আইডির রেফারেন্সে কোম্পানির দেওয়া বিকাশ, নগদ, রকেট নম্বরে প্রতিটি আইডির জন্য ১২০০ টাকা পরিশোধ করতে বলে।

এসপিসির পণ্য

ডিবির অর্গানাইজড ক্রাইম প্রিভেনশন সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির এমডি ও সিইও আলামিন প্রধান আমাদের কাছে তিন দিন রিমান্ডে ছিল। সে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। তাকে আরো তিন দিনের রিমান্ড আবেদন করব। ইতোমধ্যে আলামিনের সহযোগী জসিমকে তিন দিনের শেষে আরো একদিনের রিমান্ডে পেয়েছি আমরা।’

ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডের ২২ লাখ সদস্যের বেশিরভাগই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো লাভ করেছেন। তবে প্রতিষ্ঠানটি আরো কিছু দিন থাকলে কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত।

এসপিসির ব্যবসা যেভাবে চলত

গত ১ জানুয়ারি ই-কমার্সের লাইসেন্স নিলেও অবৈধভাবে অনলাইনে এমএলএম ব্যবসা শুরু করে। এতে ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে অ্যাপসের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে হতো। নিবন্ধনের রেফারকারী কমিশন পেত। রেফারকারী তার নিচের তিনটি আইডি থেকে ৪০০ টাকা করে কমিশন পেত। তারপর ওই তিন আইডি থেকে যখন ৯টি আইডি হতো, তখন আপলিঙ্কের আইডি ২০ শতাংশ কমিশন পেত। আর ডাউনলিঙ্কে যত আইডি হবে, আপার আইডি ১০ শতাংশ কমিশন পেত, যা পিরামিড আকৃতিতে বৃদ্ধি পেত।

প্রসঙ্গত, ই-কমার্সের আড়ালে এমএলএম ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগে গত ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত আলামিন প্রধানসহ এ চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অর্গানাইজড ক্রাইম প্রিভেনশন টিম। প্রতিষ্ঠানটি গত ১০ মাসে ২২ লাখ সদস্য সংগ্রহ করে তাদের থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ২৬৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ঘটনায় রাজধানীর কলাবাগান থানায় ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে ডিবি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads