ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গিরা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক শক্তির নেটওয়ার্ক গড়ে নাশকতার পরিকল্পনা করছে তারা। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ছদ্মবেশে থেকে এ অঞ্চলে সারা দেশ থেকে নতুন নতুন সদস্য সংগ্রহ করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌর এলাকায় সর্বশেষ জঙ্গি আস্তানার খোঁজ পায়। এখানেই অভিযান চালিয়ে র্যাব ৪ জঙ্গিকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে তারা আত্মসমর্পণ করে। এর আগে রাজশাহী মহানগরীর শাহ মখদুম এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ অঞ্চলের নব্য জেএমবি মাহমুদসহ ৪ জনকে আটক করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যে শাহজাদপুরের আস্তানার খোঁজ পায় র্যাব।
চলতি মাসের ৭ তারিখে বগুড়ায় নব্য জেএমবির আরেকটি ৪ জনের গ্রুপকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। গত ১০ দিনের মধ্যে অস্ত্র, বিস্ফোরকসহ ১২ জঙ্গি গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটল।
গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, নব্য জেএমবির ৪ জনের একেকটি গ্রুপ তৈরি হয়ে তারা নাশকতার পরিকল্পনা করছে।
সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী ও বগুড়ায় গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, ড্রোন, বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জামও উদ্ধার করা হয়।
র্যাব জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব জানতে পারে উত্তরাঞ্চলীয় নব্য জেএমবির প্রধান জুয়েল ওরফে হাবিবুল্লাহ মাহমুদ রাজশাহী মহানগরীর শাহ মখদুম এলাকায় অবস্থান করছে। এমন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গত বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে মাহমুদ আটক হয়, সঙ্গে তার তিন সহযোগীও। এরা হলো খুলনার খালিশপুরের আশরাফুল, সাঁথিয়া পাবনার আলিফ (২০) এবং নালথা সাতক্ষীরার জুয়েল (২২)।
র্যাব জানায়, আটকের পর এদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে তাদের শাহজাদপুরের কোটবাড়ির এই গ্রুপের সন্ধান দেয়। শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে র্যাব ১২-এর একটি দল সেখানে অভিযানে এলে বাসার ভেতরে থাকা জঙ্গিরা র্যাব সদস্যদের দেখে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। র্যাব সতর্ক অবস্থানে থেকে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে। আশপাশ থেকে সরিয়ে নেয় সাধারণ লোকজনদের। এরপর র্যাব সদর দপ্তর থেকে ছুটে যান মহাপরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয় র্যাব। আত্মসমর্পণ না করলে অভিযান চালানো হবে বলেও হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আত্মসমর্পণে রাজি হয় জঙ্গিরা। পরে সেখান থেকে একে একে ৪ জঙ্গি বেরিয়ে আসে। এরা হলো কিরণ ওরফে শামীম ওরফে হামিম (২২), সাঁথিয়া পাবনার নাঈমুল ইসলাম, দিনাজপুরের আতিউর রহমান ওরফে কলমসৈনিক, সাতক্ষীরার আমিনুল ইসলাম শান্ত।
আটককৃতদের ভাড়া বাসা থেকে ২টি বিদেশি পিস্তল, ছোট বেয়ারিং বল, গান পাউডার, ফিউজ, ডেটোনেটর, ওয়্যার কেবল, রড কাটার, রড কাটিং টুল, জিহাদী বই, বিভিন্ন নির্দেশিকা, চাপাতি ১টি ও রামদা ২টি উদ্ধার করা হয়। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, দুই অভিযানে মোট ৮ জঙ্গিকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে রাজশাহীর আঞ্চলিক কমান্ডার বা আমির হাবিবুল্লাহ মাহমুদকে আটক করা হয়েছে। তার গ্রামের বাড়ি নাটোরের বাগাতিপাড়ায়। তিনি বলেন, মাহমুদ প্রথমে আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য ছিল। এরপর সে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যায়। ২০১৯ সালে ১০ অক্টোবর মামলায় জামিন পেয়ে জেলহাজত থেকে বেরিয়ে আসে। জেলে থাকা অবস্থায় নব্য জেএমবির আরেক সদস্য রাশেদুল ইসলাম সুমনের কাছ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নব্য জেএমবিতে যোগদান করে। জেল থেকে বেরিয়ে সে উত্তরাঞ্চলে নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করার কাজ করতে থাকে। এরই মধ্যে আমিরও নির্বাচিত হয়।
আশিক বিল্লাহ বলেন, মাহমুদকে আমরা খুঁজছিলাম। এরই মধ্যে তার সন্ধানও পাওয়া যায়। শুক্রবার রাতে আমরা রাজশাহী মহানগরীর শাহ মখদুম এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাহমুদসহ তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। পরে তাদের দেয়া তথ্যেই সিরাজগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করা হয়।
তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গিরা উত্তরাঞ্চলে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। এ তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। বিশেষ করে মাহমুদ সারা দেশ থেকে সদস্য সংগ্রহ করে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য এ এলাকায় নিয়ে আসছে। বিভিন্ন স্থানে ৪/৫ জন করে একেকটি গ্রুপ করে তাদের থাকা খাওয়া এবং প্রশিক্ষণের কাজ করে আসছিল। শাহজাদপুরে তারা তাবলিগের কথা বলে বাসা ভাড়া নিয়েছিল।
তিনি বলেন, নাশকতার জন্য তারা তৈরি হচ্ছিল। এ জন্য অস্ত্র, বোমা তৈরির গানপাউডারও সংগ্রহ করেছিল।
তিনি বলেন, এদের কেউ কেউ বোমা বানানো ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ এমনকি গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণও নিচ্ছিল।
তিনি বলেন, জঙ্গিরা যেন সংগঠিত হয়ে নাশকতা চালাতে না পারে এ কারণে গোয়েন্দা নজরদারি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রাপ্ত তথ্য যাছাই বাছাই করে অভিযান অব্যাহত থাকছে।
এদিকে গত ৭ নভেম্বর বগুড়ায় একই জঙ্গি গ্রুপ নব্য জেএমবির ৪ জঙ্গিকে গ্রেফতার করে বগুড়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। আটক চার জঙ্গি হলেন- গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলার তরশ্রীরামপুর এলাকার মোহাম্মদ আলীর ছেলে তানভীর আহম্মেদ ওরফে আবু ইব্রাহিম (২৫), টাঙ্গাইল জেলার ভুয়াপুর উপজেলার জগতপোড়া এলাকার জাকারিয়া জামিল (৩১), ময়মনসিংহ জেলার সদরের চকশ্যামরামপুর এলাকার আবদুর রহমানের ছেলে আতিকুর রহমান (২৮) ও আবদুল হাকিমের ছেলে আবু সাঈদ (৩২)।
আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ওয়ান শুটার গান, এক কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য (পটাশিয়াম ক্লোরেট), ২ রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগাজিন, দুটি কার্তুজ, তিনটি বার্মিজ চাকু, একটি চাপাতি ও চারটি ব্যাটারিসহ বেশ কিছু তার উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা নব্য জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে। উদ্ধার করা বিস্ফোরক দিয়ে ৫০টি বোমা তৈরি করা সম্ভব।
আটক ৪ জঙ্গির মধ্যে জাকারিয়া জামিল নব্য জেএমবির মিডিয়া শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিল। টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর থানার জগতপোড়া এলাকার খন্দকার গোলাম সারোয়ারের ছেলে জামিল ঢাকার শেরেবাংলা নগরের পশ্চিম রাজাবাজারে বসবাস করতো। সে অনলাইনে আরবিতে প্রকাশিত জঙ্গিবাদ সংক্রান্ত সব প্রকাশনা বাংলায় অনুবাদ করে প্রচার করতো। তার বিরুদ্ধে ঢাকার আশুলিয়ায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা রয়েছে। আটক তানভীর আহম্মেদ ওরফে আবু ইব্রাহিম জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিভাগের ছাত্র। গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার তরশ্রীরামপুর গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে তানভীর নব্য জেএমবির আইটি শাখার সদস্য ছিল। তবে তিনি ঢাকার খিলগাঁওয়ের বনশ্রী এলাকায় বসবাস করতো। এ বছরের জানুয়ারি মাসে ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ড্রোন তৈরির সামগ্রীসহ তার স্ত্রীকে আটক করা হয়েছিল। অবশ্য তখন তিনি পলাতক ছিলেন। অপর দুই জঙ্গির মধ্যে ময়মনসিংহ জেলার চকশ্যামরামপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে আতিকুর রহমান নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র। নব্য জেএমবির নতুন এই সদস্য অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করতো। একই এলাকার আব্দুল হাকিমের ছেল আবু সাঈদও সংগঠনের নতুন সদস্য। সে যুদ্ধ করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি আবদুল বাতেন বলেন, এ অঞ্চলে জঙ্গিরা যেন নেটওয়ার্ক গড়তে না পারে সে জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। বগুড়ায় আটক জঙ্গিদের কাছ থেকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি।
তিনি বেলন, জঙ্গিরা ড্রোন দিয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। বর্তমানে তারা ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নাশকতার চেষ্টা করছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে তারা পেরে উঠছে না।
আবদুল বাতেন আরো বলেন, গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। আমরা পুরো এ অঞ্চল নজরদারির মধ্যে রেখেছি।