• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

তেষট্টি হাজার অবৈধ সংযোগ

অর্ধশত কোটি টাকার গ্যাস চুরি

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২২ ডিসেম্বর ২০২০

প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে উচ্চমূল্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে সরকার। বর্তমানে দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে ভর্তুকি দিয়ে এলএনজির দাম সমন্বয় করে গ্যাস বিক্রি করা হয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের অসাধু কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারির যোগসাজশে বিভিন্ন কোম্পানির সরবরাহ করা গ্যাসের একটি বড় অংশই চুরি হয়ে যাচ্ছে।

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক তদন্তে বর্তমানে সারা দেশে ৬৩ হাজার অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে। এসব সংযোগ থেকে প্রতিমাসে প্রায় অর্ধ শত কোটি টাকার গ্যাস চুরি হচ্ছে। এবার চলতি মাসের মধ্যেই এসব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে মন্ত্রণালয়।    

এদিকে গ্যাস বিতরণ সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। অন্যথায়, অননুমোদিত গ্যাস সংযোগগুলোর পুরোপুরি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। ফায়ার সার্ভিসসহ বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে বছরের পর বছর অবৈধ গ্যাস সংযোগ সম্পর্কে প্রতিবেদন দিয়েছে। এসব প্রতিবেদনে, তারা অবৈধ গ্যাস সংযোগের জন্য বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের এবং বিতরণ সংস্থার কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের জড়িত থাকার কথাও উল্লেখ করেছেন।

অন্যদিকে বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়ার পরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিতাস গ্যাসের দুর্নীতি ও অনিয়মের ২২টি উৎস চিহ্নিত করেছে। দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী তারা সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে অবৈধ গ্যাস সংযোগের তথ্য পেয়েছে। দুদকের টিম দেখেছেন, আবাসিকের থেকে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশি অবৈধ সংযোগ রয়েছে। গ্যাস বিতরণে সারা দেশের গ্রাহক পর্যায়ে এখনো ৬ শতাংশ সিস্টেম লস রয়েছে। কিন্তু এটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন মাত্র ২ শতাংশ সিস্টেম লস মেনে নিয়েছে। তারপর বাকি ৪ শতাংশ সিস্টেম লস নিয়ে কী হবে তার অনুসন্ধানে নামে কমিশন। এরপরেই বেরিয়ে আসে ভয়াবহ গ্যাস চুরির এই তথ্য। 

সরকারের কাছে যে তথ্য রয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ও বাণিজ্যিকসহ ২৯৭ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস লাইন রয়ে গেছে। সরকারি কোনো বিতরণ কোম্পানি এই লাইন নির্মাণ না করলেও স্থানীয়ভাবে একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে ঠিকাদাররা মিলেমিশে এসব গ্যাসলাইন নির্মাণ করেছে। এসব সংযোগ থেকে চোরচক্র নিয়মিত বিল বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করছে।

এদিকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের সব অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়কর্তৃক গঠিত অবৈধ গ্যাস বিচ্ছিন্নকরণ সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের জানয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন লাখ ১৭ হাজার ২৭৫টি অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে চলতি বছরের ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই লাখ ৫২ হাজার ৪৪৩টি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এ সময় ৩৪৪ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস সংযোগের পাইপলাইন উচ্ছেদ করা হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী এখনো এ ধরনের ২৬৩ কিলোমিটার পাইপলাইন রয়ে গেছে। এসব সংযোগে এখনো ৬৩ হাজারের মতো অবৈধ গ্রাহক রয়ে গেছে। যা দিয়ে প্রতি মাসে গ্যাস চুরি হচ্ছে প্রায় অর্ধ শত কোটি টাকার।

ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণ সংস্থার মধ্যে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড প্রায় ৫৮ শতাংশ গ্যাস বিক্রি করছে। সংস্থাটি ঢাকাসহ ১২টি জেলায় গ্যাস বিক্রি করছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মতে, তিতাস গ্যাস থেকেই সর্বাধিক অবৈধ গ্যাস সংযোগ রয়েছে।  

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ২০১৮ সালের আগ থেকে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির আগে, মন্ত্রণালয় থেকে সব গ্যাস বিতরণ সংস্থাগুলোকে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু কোনো সংস্থাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবৈধ সংযোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। এবার নির্দেশটি বাস্তবায়নের জন্য আমরা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছি। এখানে কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মোহাম্মদ নুরুল্লাহ বলেন, অবৈধ গ্যাস বিচ্ছিন্নকরণ কার্যক্রম চলছে। অভিযোগের ভিত্তিতে আমাদের বিশেষ টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পাশাপাশি জরিমানাও আদায় করেছে। আমরা এ মাসের মধ্যেই সব অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। 

সূত্র জানায়, সরকার এখন দেশীয় গ্যাসের পাশাপাশি প্রতিদিন ৬০ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করছে। এই এলএনজিগুলো উচ্চমূল্যে আমদানি করা হচ্ছে। আমদানিকৃত এলএনজির দাম বেশি হওয়ার কারণে সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সরকারের পাশাপাশি বৈধ সংযোগকারীরাও চুরির কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। সুতরাং, কম সময়ের মধ্যে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads