• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
রাজউকে এখনো সক্রিয় গোল্ডেন মনিরচক্র

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

রাজউকে এখনো সক্রিয় গোল্ডেন মনিরচক্র

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ৩০ ডিসেম্বর ২০২০

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মধ্যেও রাজউক ও গণপূর্ত বিভাগে এখনো সক্রিয় গোল্ডেন মনিরচক্র। মনিরের বিপুল পরিমাণ সম্পদ রক্ষার পাশাপাশি আত্মরক্ষায় এ চক্রের লোকজন প্রভাশালীদের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

রাজউকের প্লট সংক্রান্ত জাল-জালিয়াতি করা ফাইল খুেঁজ খুঁজে বের করে, সেখান থেকে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা ছিন্ন করতে বিভিন্ন কর্মকর্তার দারস্থ হচ্ছেন সংস্থার সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তা। মনিরচক্রে রয়েছেন রাজউকের পরিচালক শেখ শাহিনুল ইসলাম, গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বসু ও রাজউকের উচ্চমান সহকারী ও সিবিএ নেতা আব্দুল জলিলসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তারের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মনিরের দখল করা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দুইশ প্লটের নথি তলব করে। একই সঙ্গে রাজউকের পূর্বাচল, বাড্ডা ও উত্তরা তৃতীয় পর্ব আবাসিক প্রকল্পে মনির, তার স্ত্রী রওশন আক্তারের নামের প্লট ও জমির নথি, মনির ও তার স্ত্রীর কতগুলো প্লটের পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা ক্রয়সূত্রে মালিকানা অর্জন করেছেন সে-সংক্রান্ত তথ্য এবং রাজউকের মেরুল বাড্ডা প্রকল্পের খালি জায়গা দখল ও মালিকানা-সংক্রান্ত তথ্য চায় দুদক। এসব তথ্য দিতে গিয়ে টনক নড়ে মনিরচক্রে জড়িত রাজউকের বর্তমান ও সাবেক বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার। এদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় মনির আকর্ষণীয় স্থানে এত প্লটের মালিক হয়েছেন। এরা বিভিন্ন রকমের সুবিধা নিয়ে জাল-জালিয়াতি করে অন্যের বরাদ্দ পাওয়া প্লটের মালিকানা মনিরের নামে করে দিয়েছেন।

সূত্র জানায়, দুদকের চাহিদামাফিক মনিরসংশ্লিষ্ট সব প্লটের পরিপূর্ণ নথিপত্র দিতে পারছে না রাজউক। যেসব নথিপত্রের অংশবিশেষ দেওয়া হয়েছে তারও অনেক ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য বা কাগজপত্র নেই। কিছু প্লটের নথিপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে মালিকানা হস্তান্তর, প্লট বরাদ্দের কাগজপত্র নেই। আবার বরাদ্দ পাওয়া মূল মালিকের হদিশও নেই। মনিরের এসব অপকর্মের সরাসরি মদদ দেওয়া রাজউক ও গণপূর্তের বর্তমান-সাবেক কিছু কর্মকর্তা মনিরসহ নিজেদের বাঁচাতে সরকারের উচ্চমহলে তদবির করছেন। রাজউকের বিভিন্ন বিভাগের স্টাফদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পরিচালক শেখ শাহিনুল ইসলাম এসব অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসার সব লাইন ঠিক করে ফেলেছেন। অনেককে তিনি বলেছেন, সরকারের উচ্চমহলে  দুদক ম্যানেজ হয়ে গেছে।      

এদিকে দুদক সূত্র জানায়, সম্প্রতি শেখ শাহিনুল ইসলাম ও গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বসুকে জিজ্ঞাসা করেছে দুদকের একটি টিম। দুদকের এ টিমের প্রধান হচ্ছেন উপপরিচালক সামছুল আলম। এরই মধ্যে প্রদীপ কুমার বসুর সঙ্গে গোল্ডেন মনিরের সম্পৃক্তা তদন্তে তারা বেশ কিছু নথিপত্র সংগ্রহ করেছে। মনিরের প্লট জালিয়াতির সঙ্গে শাহিনুল ইসলাম ও প্রদীপ কুমার বসুর অনেক ধরনের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এছাড়া প্রদীপ কুমার বসুর নামে পূর্বের কর্মস্থলেও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

নথিতে দেখা যায়, প্রদীপ কুমার বসু গোপালগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানে ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণকাজ করায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দুর্নীতির বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরও শহীদ উল্লাহ খন্দকার স্বাক্ষতির অপর এক প্রজ্ঞাপনে তার একটি বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি এক বছরের জন্য স্থগিত রেখে লুঘু দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। দুদকের কর্মকর্তারা জানান, একজন ব্যক্তির দুর্নীতি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও তাকে লঘু দণ্ড দেওয়া এবং বিধি লঙ্ঘন করে দণ্ড দেওয়ার মাত্র ৮ মাসের আগে পদোন্নতি দেওয়ার নেপথ্যে বড় অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়েছে। এক্ষেত্রে গোল্ডেন মনির প্রদীপ কুমারের পক্ষ নিয়ে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেন।

দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, পরিপত্র গোপন রেখে শাস্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার ৮ মাস আগে প্রদীপ কুমার বসুকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৫তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার বসুকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে মূল ব্যাচের সঙ্গে ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার বিধিগত সুযোগ ছিল না। তার পরও পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে দুদক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। পাশাপাশি গোল্ডেন মনির কাকে কাকে ঘুষ দিয়েছেন সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কমিশন ইতোমধ্যে তার আত্মীয়স্বজনের নাম-ঠিকানা ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়েছেন। সেগুলো জব্দ করার প্রক্রিয়া চলছে।

অন্যদিকে গোল্ডেন মনিরের সম্পৃক্ততায় গত বুধবার রাজউকের পরিচালক শেখ শাহিনুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কমিশন। কমিশনের টিমের জেরায় তিনি অনেক প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান। এমনকি অনেক প্রশ্নের জবাব তিনি অন্যকে জড়িয়ে দিতে চেয়েছন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সামছুল আলম অনুসন্ধানের স্বার্থে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

দুদক সূত্র জানায়, গোল্ডেন মনিরের অবৈধ সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে যারা বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেছেন এবং মনিরের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়েছেন তাদের মধ্যে ৭ জনকে তলবি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। প্রদীপ কুমার বসু ও শাহীনুল ছাড়াও এই তালিকায় রয়েছেন রাজউকের সিবিএ নেতা আব্দুল জলিল আকন্দ, নিম্নমান সহকারী মো. ওবায়দুলাহ ও উচ্চমান সহকারী আব্দুল মালেক, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম ওরফে সোনা শফিক ও বিএনপি নেতা সাবেক কাউন্সিলর এম এ কাউয়ুম। এদের মধ্যে কাইয়ুম বিদেশে আত্মগোপনে রয়েছেন। অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।

স্বর্ণ চোরাচালান, অবৈধ সম্পদ অর্জন, বেআইনিভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখা, প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে গত ২১ নভেম্বর গোল্ডেন মনির ওরফে মনির হোসেনকে রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় তার নিজের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। ২০১২ সালের করা মামলায় গত ৩ ডিসেম্বর মনিরের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় দুদক। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অপর একটি অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads