• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯
বিষাক্ত অ্যালকোহল পানে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না

ছবি: বাংলাদেশের খবর

অপরাধ

বিষাক্ত অ্যালকোহল পানে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছে না

  • আমজাদ হোসেন মিন্টু, বগুড়া
  • প্রকাশিত ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বিষাক্ত অ্যালকোহল পানে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। প্রতিদিন বেড়েই চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা। বিষাক্ত অ্যালকোহল পানে অসুস্থ্য হয়ে বাড়িতে অথবা হাসপাতাল ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এ পর্যন্ত জেলায় ২০ জনের অধিক মৃত্যু হয়েছে।

পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে মৃত্যুর সংখ্যা ২০ জন বলা হলেও এর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। পুলিশ বলছে, তারা এ পর্যন্ত ১০ জনের ময়নাতদন্তে ব্যবস্থা নিয়েছে। বিষাক্ত অ্যালকোহল পানে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হওয়া আরো ৫ জনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন- বগুড়া সারিয়াকান্দিতে লাজু (২৭) ও ইউসুফ (৪০),শহরের কৈপাড়া এলাকার রামচন্দ্র (৬০), শাজাহানপুরের আহাদ আলী (৪০) ও মেহেদী হাসান (২৫)।

মঙ্গলবার থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত এই ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। অপর দিকে পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রন বিভাগ নিশ্চিত হয়েছে যে, রেকটিফায়েড স্পিরিটের সঙ্গে বিষাক্ত মিথানলের মিশ্রণ তৈরি করে বিক্রি করার কারণেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মিথানল আসবাবপত্র (ফার্ণিচার) রং করার কাজে ব্যবহৃত হয়। মুলত হোমিও ব্যবসার আড়ালেই এধরনের বিষাক্ত মদ তৈরি হয়ে আসছিলো। এছাড়া এই বিষাক্ত মদ তৈরির অন্যতম উপকরণ রেকটিফাইড স্পিরিট হোমিও ওষুধ তৈরির জন্য হোমিও প্রতিষ্ঠানগুলো আনার পর এর এটি নিয়ন্ত্রনহীন অবস্থায় থাকছে। অধিক লাভের জন্য রেকটিফাইড স্পিরিটের সঙ্গে কম মুল্যের মিথানল মেশানোর কারণে এটি বিষাক্ত হয়ে পড়ে। অপরদিকে অধিক মুনাফার জন্য বিষাক্ত মিথানল মিশ্রিত মদ ব্যবসার সঙ্গে আবার উঠে এসেছে এক সময়ে বগুড়ার প্রভাবশালী বিএনপি নেতা নুর মোহাম্মদের নাম। তিনি এখন ঢাকায় থাকেন। তার পারুল হোমিও  নামে তার একটি হোমিও ল্যাব বগুড়ার ফুলবাড়ি এলাকায় রয়েছে। ব্যবসা করেন শত কোটি টাকার। এখন তার খোঁজ চলছে। এদিকে বিষাক্ত মদপানের মৃত্যুর ঘটনার পর পুলিশ রেকটিফাইড স্পিরিট বিক্রেতা হোমিও প্রতিষ্ঠান গুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এঘটানায় পুলিশ মঙ্গলবার রাতে ৪ জনকে গ্রেপ্তার। এরা হলেন-পারুল হোমিও ল্যাবরেটরিজের নুরুন্নবী (৫৮), মুন হোমিও হলের আব্দুল খালেক(৫৫), হাসান হোমিও ফার্মেসীর আবু জুয়েল(৩৫) করতোয়া হোমিও হলের শহিদুল আলম সবুর(৫৫)। বুধবার দিনভর পুলিশ এসব কথিত হোমিও ল্যবরেটরিতে অভিযান চালিয়ে স্পিরিট দিয়ে মদ তৈরীর বিভিন্ন সরঞ্জাম আটক করে।

রোববার থেকে বগুড়ার বিভিন্নস্থানে বিষাক্ত মদপানে মৃত্যু ও অসুস্থ্য হওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে। হাসপাতালের মর্গে লাশের সারি পড়ে যায়। মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়তে থাকায় এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে তোলপাড়। পুলিশ জানিয়েছে, এ পর্যন্ত তারা ৫টি হোমিও প্রতিষ্ঠানকে বিষাক্ত মদ বিক্রির বিষয়ে চিহ্নিত করেছে। তারা রেকটিফাইড স্পিরিটের সঙ্গে মিথানল মিশ্রন করে বলে তদন্তে জানতে পেরেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান হলো- শহরের ফুলবাড়ি এলাকার একই পরিবারের পারুল ও পুনম হোমিও ল্যাবরটরিজ, হোটেল পট্টি এলাকার হাসান হোমিও, গালাপট্টি এলাকার মুন হোমিও  এবং চেলোপাড়া এলাকার করতোয়া হোমিও হল। রাতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে সদর থানা পুলিশ ৪ জনকে গ্রেফতার করে। এছাড়া বুধবার দিনভর শহরের বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে স্পিরিট ও মদ তৈরির সরঞ্জাম আটক করে।

পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রন বিভাগ জানিয়েছে, তারা প্রাথমিক তদন্তে দেখেছেন পারুল হোমিও থেকে বেশি বিষাক্ত মদের চালান হয়েছে। তারা আরো জানিয়েছেন, রেকটিফাইড স্পিরিটের সঙ্গে মিথানল মেশানোর কারণেই বিষাক্ত মদ তৈরি হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বগুড়ার ৮টি হোমিও ফার্মেসির রেকটিফাইড স্পিরিট তৈরীর অনুমোদন রয়েছে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে তাদের তালিকা রয়েছে। বিভিন্ন ডিসট্রিলারি থেকে হোমিও প্রতিষ্ঠানগুলো  ওষুধ ডায়ালোশনের জন্য রেকটিফায়েড স্পিরিট মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে উত্তোলন করে। এতে  পারুল হোমিও ল্যাবের সবচেয়ে বেশি ৪০০ লিটার রেকটিফাইড স্পিরিট উত্তোলনের লিমিট রয়েছে।

মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক মেহেদী হাসান জানান, এর বাইরে হোমিও প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে রেকটিফাইড স্পিরিট আমদানি করছে। এছাড়া রং করার কাজের ব্যবহৃত মিথানল স্পিরিটও আমদানি করা হয়। তবে রেকিটিফাইড স্পিরিটের তুলনায় এর দাম অর্ধেক। আবার দেশিয় ডিস্ট্রিলারীর স্পিরিটের চেয়ে আমদানি করা স্পিরিটের দাম অনেক সস্তা। এজন্য হোমিও ল্যাবরেটরির নামে শত শত ব্যারেল রেকটিফাইড স্পিরিট আমদানি করা হচ্ছে।

এক হোমিও ব্যবসায়ী জানান, গত জুন মাসে তিনি ও ঢাকার কয়েকটি হোমিও প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫শ’ ব্যারেল রেকিটিফাইড স্পিরিট আমদানি করেন। তিনি বগুড়ায় আনেন ১৪ ব্যারেল। মাদক নিয়ন্ত্রন বিভাগ সূত্র জানায়, দেশীয় রেকটিফাইড স্পিরিটের প্রতি লিটার প্রায় সাড়ে ৪ শ’ টাকা আর মিথানল স্পিরিটের দাম প্রতি লিটার ১২০ টাকার মতো। এ কারণে অধিক মুনাফার জন্য রেকটিফাইড স্পিরিটের সঙ্গে মিথানল মিশিয়ে হোমিও ব্যবসার আড়ালে বিষাক্ত মদ বিক্রি করছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রেকটিফাইড স্পিরিট নিয়ে আসার পর এ ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। হচ্ছে না কোনো নজরদারী। এদিকে বিষাক্ত মদে মত্যুর ঘটনা বাড়ার সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে এক সময়ের বিএনপি নেতা নুর মোহাম্মদের নাম। তিনি বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময় বগুড়া শহর বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। হোমিও ব্যবসার নামে মদের রমরমা কারবারে তার প্রভাব ছিলো চোখে পড়ার মতো। জোট সরকারের পতনের পর সে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়। নুর মোহাম্মাদ ও দুই ভাই পারুল এবং পুনম ল্যাবরেটরি নামে ২টি প্রতিষ্ঠান চালান। বিষাক্ত মদ খেয়ে বগুড়ায় এই মৃত্যুর মিছিলের কারনে দায়ের করা মামলায় নুর মোহাম্মাদ, নুরুল ইসলাম ও নুরুন্নবী এই ৩ ভাইকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বগুড়ার হোমিও ব্যবসার আড়ালে মদ বিক্রির জন্য আলোচিত নুর মোহাম্মাদ ঢাকা ও নায়ারয়নগঞ্জে হোমিও ওষুধ সহ কয়েকট পণ্যের ২টি কারখানার মালিক। এসব ব্যবসায় প্রায় ৩ শতাধিক কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বগুড়ার কয়েক কোটি টাকায় ৭ বিঘা জমি ক্রয় করেন। এখানে ইউনিসন ফার্মা নামে একটি ইউনানি প্রতিষ্ঠান গড়বেন বলে মন্তব্য করেছিলেন। 

বগুড়ার সদর থানা পুলিশ জানিয়েছে, তার অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। এই মামলায় জড়িত সকলকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে সদর থানার ওসি হুমায়ুন কবির জানিয়েছেন। মামলায় অভিযুক্ত খান হোমিও হলের শাহিনুর রহমান আলোচিত অভিযুক্ত নুর মোহাম্মাদের মতো লাপাত্তা রয়েছেন।

এদিকে বগুড়ার চাঞ্চল্যকর বিষাক্ত এ্যালকোহল পানে মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেপ্তার ৪ জনকে বিকেলে আদালতে হাজির করে অধিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে প্রত্যেকের ২দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads